সেই সে একজন

-আমরা কি বন্ধু হতে পারি?
-ইস, আপনার মতো একটা উজবুকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আমার বয়েই গেছে।
-আমি কি উজবুক?
এই কথা বলার সময় ছেলেটার মুখটা কালো হয়ে যায়। হয়তো রুমানার কথায় সে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু রুমানার কোনো অনুশোচনা হয় না। বরং ভীষণ ভালো লাগে। ও জীবনে প্রথম এমন একজন মানুষ পেয়েছে যাকে কষ্ট দেয়া যায়। যার সঙ্গে রাগ দেখানো যায়। অভিমান করে গাল ফুলিয়ে থাকা যায়। সব মেয়ের জীবনেই এমন একজন বিশেষ মানুষের দরকার। আর ওর নিজেরই এখন এমন একজন বিশেষ মানুষ আছে ভেবে রুমানার খুব গর্ব হয়। কী এক গভীর ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হতে হতে ও বলে
-ইস রাগ দেখানো হচ্ছে বুঝি! কিন্তু কথা না বললে আমি কিন্তু চলে যাব।
-আরে না তোমার সঙ্গে কী রাগ করে থাকা যায়! তুমি হলে গিয়ে আমার একটা ময়না পাখি।
-এই দুষ্টমি করলে কিন্তু আমি চলে যাব।
-কী রাগী মেয়েরে বাবা! কথায় কথায় খালি চলে যাওয়ার ভয় দেখায়।
-ভয় দেখাচ্ছি না জনাব, সত্যিই চলে যাব।
-আমি তোমায় যেতে দিলেই না তুমি যাবে।
-কি করবেন আপনি শুনি?
-ওড়নার কোণাটা আঙ্গুলে বেঁধে বসে থাকবো। এরপর তুমি যেখানে যাও সেখানেই যাব।
ওর কথা শুনে রুমানা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। ওর ভালো লাগে, খুবই ভালো লাগে। এইসব খুনসুটি, দুষ্টমি আর মান অভিমানের খেলা। আর এইসব কারণে রোজ ওর হোস্টেলে ফিরতে দেরি হয়ে যায়। তাই আজ রাতেও হোস্টেল সুপারের ঘরে ডাক পড়ে ওর। রুমানার খুব ভয় হয়। ওই মহিলার জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর আর কাটাকাটা কথার সামনে রুমানা বরাবরই মিইয়ে যায়। কোনো কথাই গুছিয়ে বলতে পারে না। অজুহাত দেয়া বা বানিয়ে বলা তো অনেক দূরের ব্যাপার। অথচ এমন না রুমানা কোনো কলেজে পড়া কোনো কিশোরী মেয়ে আর ওর বাবা-মা ওই মহিলকে ওর দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে গেছে। ও একজন চাকরিজীবি মেয়ে। অনার্স পড়তে পড়তেই ও একটা কর্পোরেট হাউসে জব খুঁজে নিয়েছে। এখন এমএ পড়ছে। যদিও নিয়মিত ক্লাস করা হয় না ওর। তবে ইচ্ছা আছে সামনের বছর ফাইনাল দেয়ার। আর এ ক্ষেত্রে ওর বন্ধুরাও ওকে অনেক হেল্প করে থাকে।
-হুম আজকেও আপনার লেট। রুমানা, এই নিয়ে আপনি পরপর তিন দিন রাত সাড়ে নয়টার পর হোস্টেলে ফিরলেন। এর মধ্যে একদিন তো দশটার পর ফিরলেন। আমার কাছে সব রেকর্ড করা আছে।
-আপা, এখন বছরের শেষ, ক্লোজ সেশন। অফিসে এত কাজের চাপ। তাই দেরি হয়ে যায়। তাছাড়া আপনি তো জানেন আমি একটা কর্পোরেট অফিসে কাজ করি।
– দেরি হবে সে কথা তো আপনি আগে জানাতে পারতেন।
-আপা হঠাৎ করেই দেরি হয়ে যায়। হয়তো বাসায় আসার জন্য রওয়ানা দেব তখন আবার কাজ এসে পড়ে। জরুরি কাজ ফেলেও আসতে পারি না।
-দেখুন, আমার এখানে অনেক কলেজে পড়া মেয়েরাও আছে। আপনাদেও দেখাদেখি ওরাও যদি অনিয়ম করতে শুরু করে তাহলে এই হোস্টেল কি চালানো যাবে? তাছাড়া এসব অনিয়মের কথা শুনলে অনেক অভিভাবক তো তাদের মেয়েদের এখানে রাখতেই চাইবেন না। আমার মাতৃছায়া হোস্টেলের একটা সুনাম আছে। আপনার জন্য সেই সুনাম আমি নষ্ট করতে পারবো না।আমি আজই আপনাকে শেষবারের মতো বলে দিলাম। এখানে থাকতে হলে আপনাকে রাত আটটার মধ্যেই ফিরতে হবে।
-আপা, আমি আপনার এখানে আছি দু বছর ধরে। আপনি ােত আমার সমস্যাটা জানেন।
-তাহলে তো অপনাকে চাকরি ছাড়তে হবে। এখানে থাকতে হলে আপনাকে এমন কোনো চাকরি খুঁজে নিতে হবে যেখানে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যায়।
-কি বলেন আপা, চাকরি ছাড়তে হবে!
-হ্যা, এখানে থাকতে হলে আপনাকে চাকরি ছাড়তে হবে। নয় তো অন্য কোনো হোস্টেল দেখে নিন, যেখানে রাতে যখন ইচ্ছা তখন আসা যাওয়া করা যায়।
হোস্টেল সুপারেরর এ কথার জবাবে রুমনাা আর কিছু বলতে পারে না। রুমে ফিরে কেবল কাঁদে। এছাড়া আর কি করতে পারে সে। এমনিতেই মিথ্যা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। সে তো রোজ ভাবে অফিস শেষে বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু ওই মানুষটা যখন ফোন করে তখন তো সে আর না করতে পারে না। তাছাড়া ওর নিজেরও যে মানুষটার সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগে একথাটা অস্বীকার করে কি করে। আর ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলেই কখন যে বিকেল শেষ হয়ে রাত নেমে আসে রুমানা টেরই পায় না। আর টের পেলেই বা কি তখন রুমানারও যে ওকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছা করে না। কতদিন এমন হয় রুমানাকে পৌঁছে দিতে মানুষটা ওদের হোস্টেলের গলি পর্যন্ত আসে। তখনও ওদেও গল্প শেষ হয় না। বড় রাস্তার মোড়ে, কখনও বা গলির মাথায় ল্যাম্পপোস্টটার নিচে দাঁড়িয়ে ওদের সেইসব ছেলেমানুষী আলাপ চলতেই থাকে।
এই মানুষটার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে রুমানার বিকেলগুলো কেমন ঝকঝকে আর চকচকে-যেন সোনায় মোড়া। আর আগে ওর বিকেলগুলো ছিলো পানসে ম্যাড়ম্যাড়া। সময়গুলো থেমে থাকতো, যেতেই চাইতো না। অফিস থেকে বেরিয়ে ও ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকতো, ধীরে ধীরে। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছানোর পরও দাঁড়িয়ে থাকতো। যেন কোনো বাস ওর পছন্দ হচ্ছে না। শেষমেষ ভিড় কমদেখে একটা বাসে ওঠতো সে। জানালার পাশের সিটটাতে বসে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। পায়রার বুকের মতো এমন নরম আর বাজের চোখের মতো উজ্জ্বল বিকেলে ওর হোস্টেলে ফিরতে ইচ্ছে করতো না। তাই তো কোনো কোনোদিন ছুটির পর অফিস সংলগ্ন হকার্স মার্কেটটাতে ঢুঁ মারতো। তেমন কিছু কিনতো না। কেবল ঘুরে ঘুরে দেখতো। সুন্দর বিকেলগুলোতে এভাবে সে কিছুটা সময় বাইরে কাটাতো। আসলে এই শহরে তার আপন বলতে কেউ নেই। না কোনো আত্মীয় বা বন্ধু বান্ধব যাদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যায়। কিংবা গল্প করে খানিকটা সুন্দর সময় কাটানো যায়। সে এই শহরের এক নতুন আগন্তুক। আর ছুটির দিনগুলো তো ছিলো আরও খারাপ। সেইসব বিবর্ণ দিনগুলোতে সে হোস্টেল ছেড়ে বেরই হতো না। ভালো না লাগলে মাঝে সাঝে নিচের ছোট্ট বাগানটায় গিয়ে বসে থাকতো। তখন তার একমাত্র আনন্দ ছিলো মায়ের ফোন। মায়ের সঙ্গে সেই তো সব গৎবাধা কেজো কথা! তারপরও সেগুলোই ভালো লাগতো।
-শরীর কেমন? খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করিস। যে করেই হউক পড়াশোনাটা কিন্তু শেষ করতে হবে মা।
কখনও বা বলতেন, ‘এ মাসে কিছু বেশি টাকা পাঠাতে পারবি? শামীমের পরীক্ষার ফিস দিতে হবে’।
এতবড় বিশাল শহরে তখন তো রুমার নিজের বলতে কেউ ছিলো না। ও ছিলো সম্পূর্ণ একা।

-আপনি কি জানেন কালকেও আমি হোস্টেল সুপারের কাছে বকা খেয়েছি। তাই আজ আমাকে আটটার মধ্যেই ফিরতে হবে।
-তোমার ওখানে থাকার দরকার কি! ছেড়ে দাও ওই হোস্টেল।
-তাহলে কোথায় থাকবো আমি? আপনার সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ঘুওে বেড়াব নাকি!
-রাস্তায় কেন থাকবে, আমার কি ঘরবাড়ি নাই! তুমি আমাদের বাড়িতে থাকবে। সেখানে তোমার কোনো সমস্যাই হবে না। কাউকে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। মা তোমাকে খুব ভালোবাসবে। আদর করে তোমার মাথার উকুন বেছে দিবে।
-আমার মাথায় উকুন নাই।
-খুব ভালো। তাহলে মা তোমার মাথায় বেনুনি করে দিবে।
আজকাল ইশারা ইঙ্গিতে ওকে অন্য কিছ বলতে চায় লোকটা। কিন্তু রুমানা এগুলো পাত্তা দেয় না।
-আপনার বাড়িতে কেন থাকবো আমি? চেনা নাই জানা নাই বললেই হলো।
-আরে পেইয়িং গেস্ট হিসাবে থাকবে। আজকাল ঢাকা শহরে কত ফ্যামিলিতে পেইয়িং গেস্ট রাখে জানো?
কী অবলীলায় কথা ঘুরিয়ে নেয়। লোকটা কী তাহলে এমনিই এসব বলে, ওর মন রাখার জন্য। রুমানা খানিকটা হতাশ হয়। তারপর ঝগড়ার মুডে বলে।
-আপনি খুব খারাপ। একটুও ভালো না।
-জানি তো। তুমি তো রোজই বলো।
-তাহলে ভালো হয়ে যান। ভালো হতে পয়সা লাগে না।
-তুমি সবসময় যদি কাছে থাক তাহলে আমি ভালো হয়ে যাব, খুব ভালো হয়ে যাব। বিশ্বাস কর।
-আমার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নাই। এ্যাই আটটা বেজে যাচ্ছে। আজ আর দেরি করা যাবে না। এখুনি উঠতে হবে।
-আর একটু থাক না প্লিজ। মাত্র তো সোয়া সাতটা।
-তাহলে সুপার আপা আমাকে আজ আর হোস্টেলেই ঢুকতে দিবে না।
-কী যে দারুণ একটা ব্যাপার হবে তাহলে! আমরা দুজন সারারাত হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াব। আর গল্প করবো।
-ইস শখ কত!

দেখা করার দিনগুলোতে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে আসে রুমানা। এমন না অফিসে অনেক কাজের চাপ তাই বের হতে পারছে না। ও কিন্তু ইচ্ছে করেই দেরি করে। মানুষটা এসে ওর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে সেই কখন থেকে। কেউ একজন ওর জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করছে এটা ওকে আনন্দ দেয়। নিজেকে খুব স্পেশাল মনে হয়। এর আগে কেউ ওর জন্য এতক্ষণ ধরে বসে থাকেনি। রুমানা পা টিপে টিপে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ও ঠিকই টের পেয়ে যায়। অভিমান করে বলে
-দেখো আমি গাছ হয়ে গেছি।
-হুম দেখছি, শিকড় ছাড়া গাছ!
-এতক্ষণ ধরে বসে থাকলে একদিন সত্যি সত্যি শিকড় গজাতে শুরু করবে। শুধু শিকড় নয় বটগাছের মত ঝুড়িও বের হতে পারে।
সেদিন বিকালে কি হয় কোনো ফোন আসে না। ও বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়। একসময় অফিস শেষ হয়। কিন্তু আর তার ফোন আসে না। এভাবে একদিন যায়, দুদিন যায় তারপর অনেকগুলো দিন চলে যায়। কেউ আর ফোন করে না রুমানাকে। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোনোর জন্য তাড়াও দেয় না। ওর অপেক্ষায় বসেও থাকে না কেউ। মানুষটা যেন বাতাশে মিলিয়ে গেছে। রুমানার কী যে কষ্ট লাগে! ওর একজন নিজস্ব মানুষ ছিলো যার সাহচার্য ওকে সাহসী আর অহঙ্কারী করে তুলেছিলো। সেই বিশেষ মানুষটা হারিয়ে গেছে। ওর বুকের ভিতরটা কেমন খালি খালি লাগে। এই অনুভূতি এবারই প্রথম। ও প্রতিদিন ওই জায়গাটাতে যায়। হৃদের পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকে। সে মনে মনে ভাবে, হয়তো আর একটু পরেই সে আসবে। ওর পাশে এসে বসে হাসতে হাসতে বলবে,‘ দেখো অপেক্ষা করতে কত কষ্ট লাগে। আমাকে তো রোজ অপেক্ষা করিয়ে রাখতে। এখন বোঝ মজা।’
কিন্তু এ সবই ওর মনে কল্পনা। কেউ আসে না। ওর দুঃখে সমাবেদনা জানাতে কেবল গাছ থেকে খসে পড়ে একটা দুটো শুকনো পাতা।
সন্ধ্যার মুখে ও উঠে দাঁড়ায়। ধীরে সুস্থে গন্তব্যের পথ ধরে। আর আটটা বাজার অনেক আগেই হোস্টেলে পৌঁছে যায়। হোস্টেলে ফেরার পর ওর খেতে ইচ্ছে হয় না। খালাকে জানিয়ে দেয়, রাতে ও খাবে না। খালা যেন ওর ভাগের খাবারটা খেয়ে নেয়। রুমানা লাইট নিভিয়ে রাত আটটা বাজতেই শুয়ে পড়ে। আসলে সে ঘুমায় না মরার মত নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে কেবল। কোনো কোনো রাতে মা ফোন দেন।
-কেমন আছিস রে বেটি। আজ রুপার রেজাল্ট দিয়েছে। ও এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। এখন ও ঢাকায় পড়তে চাচ্ছে। দেখিস তো কিছু করা যায় নাকি।
ছোটবোনের এত আনন্দের সংবাদেও ওর কোনো হেলদোল হয় না। ও নিষ্প্রাণ কণ্ঠে কেবল বলে
-খুব ভালো। আমি ওর ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ খবর নেব।
-কি রে তোর কি শরীর খারাপ?
-না। আমার খুব ঘুম পেয়েছে। আমি ফোন রাখছি।

-আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো! খুব চেনা চেনা লাগছে।
রুমানা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছে কিনা ও মনে করতে পারে না। রুমানা মনে করার চেষ্ট করে। আজকাল ও খুব আনমনা থাকে। আজও ছিলো। আর হুট করে লোকটা ওকে এই কথা বললো। এসময় ওর হঠাৎ করেই শারমিনে কথা মনে হয়। ওরা একসঙ্গে রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়েছে। শারমিন বলতো, মেয়েদের সঙ্গে ভাব জমাতে চাইলে নাকি ছেলেরা এইসব কথা বলে। এসব উটকো লোককে তাই পাত্তা দিতে নাই। কিন্তু শারমিনের উপদেশ এখন কীভাবে পালন করবে। মানুষকে যে অবিশ্বাস করতে পারে না রুমানা। তাছাড়া পরিচিত বা অপরিচিত কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার অভ্যাসও নেই ওর।
তাই রুমানা উত্তরে কেবল মজা করে বলে
-হয়তো স্বপ্নে দেখেছেন।
-হতে পারে। তাহলে তো সেই স্বপ্নের কথা আপনারও মনে থাকার কথা।
-আমি স্বপ্ন দেখি না।
-স্ট্রেঞ্জ, এই বয়সেই স্বপ্ন টপ্ন দেখা শেষ। তা আপনি নামবেন কোথায়?
-দেখি কোথায় নামি। উদাস কণ্ঠে উত্তর দেয় রুমানা।
আশ্চর্য লোকটাকে ও যতটা এড়াতে চাইছে ওর পক্ষে ততটা সম্ভব হচ্ছে না। আর মানুষটাকে এখন বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে ওকে মনে পড়ছে না। দূর গোল্লায় যাক সব! লোকটাকে এড়াতে এক স্টপেজ আগেই বাস থেকে নেমে পড়ে রুমানা। ওর পিছন পিছন লোকটাও নেমে আসে। ওর পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। এবার নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুটা কঠোর হওয়ার চেষ্টা করে রুমানা।
-আপনি এই এলাকায় থাকেন?
-তা নয়।
-তাহলে…
-আপনাকে নামতে দেখে আমিও নেমে পড়লাম।
-কী আশ্চর্য! আপনি কি ঝামেলা পাকাতে চাইছেন? দয়া করে আপনি আমাকে এভাবে বিরক্ত করবেন না। আমি কিন্তু তাহলে অন্য ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।
-আপনি আমার কথাটা শুনুন না, প্লিজ। আমার কেবল মনে হচ্ছিলো আপনি হারিয়ে যাবেন। অনেকদিন পর আপনাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। প্লিজ, আমার কথায় রাগ করবেন না। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবো না। শুধু আপনার সঙ্গে হাঁটবো। আপনার সঙ্গে হাঁটতে আমার খুব ভালো লাগছে। অনেকদিন পর এমন ভালো লাগছে। বিশ্বাস করুন!
রুমানা ইচ্ছে করেও রাগ করতে পারে না। তবুও রাগের ভান করে বলে।
-আপনাকে না পুলিশে দেয়া দরকার।
ওর কথা শুনে লোকটা হো হো করে হাসতে থাকে। যেন খুব মজার কথা বলেছে ও।
-এই যে ষাড়ের মতো হাসবেন না।
-ষাড় কি হাসতে জানে?
-আপনার মত ষাড়েরা হাসতে জানে।
এরপর রুমানার পক্ষে আর মুখ গোমড়া করে রাখা সম্ভব হয় না। ও হেসে ফেলে। কথা বলতে বলতে ওরা পথ চলে। কে বলবে একটু আগেই ওদের দেখা হয়েছে এবং ওরা এখনও পরষ্পরের কাছে অপরিচিত। একজন অন্যজনের নাম পর্যন্ত জানে না। রুমানার এখন মনে হয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক করার জন্য নাম খুব একটা জরুরি বিষয় নয়। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে পারস্পরিক ভালোলাগা আর বিশ্বাস। এই যে, রুমানা ইচ্ছে করেও লোকটাকে অবিশ্বাস করতে পারছে না এটা কি বিশ্বাস নয়। রুমানার তো ওর সঙ্গে পথ চলতে বেশ লাগছে। আসলেই রুমানার ভালো লাগছে, খুবই ভালো লাগছে। একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কত কথা যে বলে ওরা দু’জন। রুমানার মনে হয়, হয়তো আবার ও এমন একজন মানুষ পেয়েছে যাকে কষ্ট দেয়া যায়, অকারণে রাগ দেখানো যায়। সে রুমানার একজন বিশেষ মানুষ, পুরুষ মানুষ।

মাহমুদা আকতার