পাঠকের মুখোমুখি সাহিত্যিক ঝুম্পা লাহিড়ী

ঝুম্পা লাহিড়ীর পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন ও ভারতীয় বাঙালী বংশদ্ভুত লেখিক। তিনি তার গল্প সংকলন ‘ইন্টারপ্রেটার অফ ম্যালাডিস’ এর জন্য ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মানজনক পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। তিনি নিজের লেখালেখি নিয়ে পাঠকের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। পাঠকের সঙ্গে তার কথোপকথোন নিয়ে আমাদের আজকের এ আয়োজন। তার এ সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল ওয়াশিংটন পোস্টের ‘অফ দ্য পেইজ’ বিভাগে, ২০০৩ সালের ৭ অক্টোবর।
আমি তোমার বইয়ের অপেক্ষায় থাকি সব সময়, কিন্তু বইয়ের যে রিভিউগুলো হয়, তা পড়ে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। আমার প্রশ্ন হচ্ছে- তুমি কি তোমার বইয়ে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে মানুষকে ধরতে চাও? তোমার অভিপ্রায়টি কি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির ভিতরকার অনুরূপতা নির্দেশ করা? হতে পারে যে তোমার অভিপ্রায় উভয়ই। আমাদের মধ্যে বহু ভিন্নতা সত্ত্বেও বহুদিক থেকে মিলও আছে। কখনও মনে হয়, তুমি তোমার লেখার থিম এখনও খুঁজে পাওনি। সাংস্কৃতিক ভিন্নতা নিয়ে তুমি কি এমন কিছু বলবে, যা তোমার সাহিত্যকে বুঝতে সাহায্য করবে? 
ঝুম্পা লাহিড়ী : সবাইকে অভিবাদন। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি বলে আমি আনন্দিত। যে-প্রশ্নটি আমাকে করেছেন তাকে আমি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছি। হ্যাঁ, আমার অভিপ্রায় ছিল এমন একটি পরিবার নিয়ে গল্প লেখা যারা একটি নতুন দেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করছে। ফলে লেখাটিতে আমি ভিন্ন সংস্কৃতির অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলেছি। বলেছি কীভাবে দুই অচিন সংস্কৃতি পরস্পরের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ তৈরি করে, তাদের মিথষ্ক্রিয়া হয়, আর কেনই-বা মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে কোনও মিলন ঘটে না, বিনিময় হয় না। কিন্তু এসব মিলন বা বিরোধ নিয়ে আমি কোনও ভাষ্য কিংবা বিবরণী দেব না। আমি মনে করি এইসব বিষয় পাঠকের আবিষ্কারের জন্য লেখার ভিতর অপেক্ষা করে। আমি মনে করি, আমার লেখা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্যে ব্যক্তির মূল্য ও তাৎপর্যকে উজ্জ্বল করে দেখায়, আর এক বৈশ্বিক অনুভূতি দেয় যেখানে আপনি নিজের ঘরেই পুরো বিশ্বকে অনুভব করছেন।
একজন লেখক এবং ভারতীয় উপমহাদেশের একজন নেটিভ হিসেবে, আমি তোমার লেখার ভক্ত। আমি যখন কিছু লিখতে চাই, হোক তা ফিকশন কিংবা বাস্তব অভিজ্ঞতার বয়ান, লিখবার সময়ই আমি সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেলি, মনে হতে থাকে যে আমি ছাড়া এই গল্পগুলো আর কেউ ধরতে পারছে না, গল্পগুলো কাউকে স্পর্শ করছে না। তোমারও কি এমন হয়েছে কখনও? হলে কিভাবে কাটিয়ে উঠেছ? 
ঝুম্পা : এ তো লেখালেখিরই একটি প্রক্রিয়া যেখানে একজন লেখককে নিরুৎসাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়, বাধার পাঁচিলগুলোয় বারবার আঘাত করতে হয় আর নিজেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষ মনে করতে হয়। এসব প্রতিকূলতা আর বৈপরীত্যের মুখোমুখি না হলে তো আপনার পক্ষে সত্যিকার সৃষ্টি সম্ভব হবে না। খুব চেষ্টা করুন যাবতীয় বাধাবিপত্তির মোকাবেলা করতে আর এসবের ভিতর থেকে লেখাটিকে বের করে আনতে। লেখালেখির পুরো ব্যাপারটিই পাজলের মতো। একেবারে ডুবে গিয়ে সমস্যাটির সমাধান করতে হয়।
লেখালেখির ক্ষেত্রে তুমি কি কোনও উত্তরাধিকার বহন করে চলেছ? কখনও কি ভেবেছ এই উত্তরাধিকারটিই তোমাকে লেখক হতে পথ দেখিয়েছে? 
ঝুম্পা : সে উত্তরাধিকার তো আমার বাবা মা’র কাছ থেকেই আমার মধ্যে বাহিত হচ্ছে যারা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এসেছেন, এখানে কীভাবে বসবাস করতে হয় তা শিখেছেন। আমার জীবনে সব সময়ই দুটো প্রভাব কাজ করেছে, অত্যন্ত প্রবল সে প্রভাব। প্রতিদিনই আমি দুটো ভাষায় কথা বলি, দুই মহাদেশের খাবার খাই, আমি পৃথিবীর দুটি অঞ্চলকে জানি। সবই এক সঙ্গে। আমি মনে করি লেখালেখির দিকে যাওয়াটা ছিল আমার নিজের জন্য একটি জগৎ তৈরির সুযোগ। দেখুন, আমি কিন্তু আমার ভারতীয় এবং আমেরিকান- উভয় দিক থেকে অপর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে উঠেছি। আমি সব সময়ই অনুভব করি যে, দিনে দিনে আমি ছোট গণ্ডির মধ্যে আটকে যাচ্ছি, কারণ আমি কোনওকিছুই ভালো করে জানতে পারছি না। লেখালেখিতে আমার নিজের চেয়ে অন্য কারোর প্রত্যাশা পূরণ করতে হয় না আমার।
সাহিত্যে ছোট্ট একটি ঘটনা যেভাবে পুরো একটি চরিত্র কিংবা সম্পূর্ণ একটি গল্পে পরিণত হয়, সে ব্যাপারটি লেখালেখির এক আকর্ষণীয় দিক। তুমি কি হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলবে?
ঝুম্পা : হ্যাঁ, হয়ে ওঠার এ প্রক্রিয়াটি একেক লেখায় একেক পরিপ্রেক্ষিত থেকে ঘটে। জীবনের নানামুখি ঘাত, প্রতিঘাত, গড়ণ ও ভাঙচুরের ওপরও এই রূপান্তর নির্ভর করে। কখনও গল্পের চরিত্র হয় সম্পূর্ণ নির্মিত, লেখকের উদ্ভাবিত। চরিত্রটি লেখকের হাতে তৈরি হয়। কখনও চরিত্রটি একেবারে নিখাদ বাস্তব থেকে ওঠে আসে। আমার ‘তৃতীয় এবং অন্তিম মহাদেশ’ গল্পের ক্ষেত্রেও কথাগুলো প্রাসঙ্গিক। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে চরিত্রকে কিংবা একটি গল্পকে কতটুকু গড়া হবে আর কতটুকু আসবে সৃজনকল্পনা থেকে, সে সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা করা সম্ভব নয়।
ঝুম্পা, ভারতীয় অভিবাসীর সন্তান হিসেবে তোমার গল্পগুলো আমার ভিতর অনুরণিত হয়, যেন একটা গুঞ্জন শুনতে পাই। পড়তে গিয়ে কখনও মনে হয় আমি আমেরিকায় আছি, পরক্ষণেই মনে হয় যে, না, আমি এখানে নেই, ভারতবর্ষে। একসঙ্গে এই অদ্ভুত অনুভূতিটি আমার হয়। তোমার সন্তানরা যেভাবে তোমার সঙ্গে বেড়ে উঠছে, তোমার বাবা মা’র সঙ্গে তোমার বেড়ে ওঠা থেকে কি তা কিছুটা ভিন্ন? আমাদের পেছনে যে আরও একটি প্রান্তের সংযোগ, ভারতবর্ষের সঙ্গে, তা কি তারা বুঝতে পারছে? আর একটি কথা, তোমার সমনামী পড়বার অপেক্ষায় আছি। 
ঝুম্পা : হ্যাঁ, আমার ছেলে আমার চেয়েও ভিন্নভাবে বেড়ে উঠছে। আমার মা বাবা তো আর এতটা আমেরিকান ছিলেন না, আর আমাকে তারা এরকম করে বড়ও করেননি যেভাবে আমার ছেলে বেড়ে উঠছে। আমি তো এদেশেই বেড়ে উঠেছি, এদেশের জলহাওয়ায়। আমি ঢের বেশি আমেরিকান। আবার, আমি কিন্তু নিজেকে পুরোটা আমেরিকানও মনে করি না, তা ব্যাপারটিকে যে যেভাবে নিক না কেন; আর এ অনুভূতিটি বাবা মা’র সঙ্গেও মিলে যায়। তারাও নিজেদের এরকম মনে করেন। দেশ সম্পর্কিত অনুভবের সঙ্গ-নিঃসঙ্গতায় আমি আমার ছেলেটিকে ভিন্নভাবেই গড়ে তুলছি। বাবা মা এদেশে একেবারে একা ছিলেন, পরিবার বলতে যা বুঝি তা তো আর ছিল না। তো, সেভাবেই তারা আমাকে বড় করেছেন। এখন তারা আমার থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টা দূরত্বে থাকেন, আমার ছেলে তার ঠাকুরদা দিদিমাকে দেখতে যেতে পারে। কিন্তু আমি আমার দিদিমাদের দেখতে পেতাম কয়েক বছরের ব্যবধানে। তারা তো আর কাছে ছিলেন না। আমার চেয়ে আমার ছেলের যোগাযোগটা কিন্তু ভিন্ন, অন্তত আমাদের বেড়ে ওঠবার সময়ের চেয়ে তাদের বেড়ে ওঠাটা অনেকটা শিকড়ের কাছে যাওয়ার মতো। সে তো যুক্তরাষ্ট্রে থেকেও তার দিদিমার ফেলে আসা দেশকে অনুভব করতে পারছে।
একজন অসাধারণ লেখক হওয়ার পরও, ঝুম্পা, তুমি কিন্তু তোমার ভারতীয়-আমেরিকান চরিত্রগুলোর জন্যই আলোচিত হও, উল্লেখিত হও! এ নিয়ে কি নিজের মধ্যে কখনও হতাশা খুঁজে পেয়েছ? 
ঝুম্পা : না, আমি হতাশ হই না, কারণ- এসব তো আমার লেখালেখির সঙ্গে সম্পর্কিত, আমার লেখা সম্পর্কে এসবই সত্য। আমি এমন সব চরিত্র নিয়ে কাজ করি যাদের নির্দিষ্ট একটি পরিচিতি আছে। তারা কেউ কেউ ভারতীয় এবং কোনও না কোনওভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত। তা হোক কিন্তু আমি কখনও চরিত্রদের ভারতীয় বা আমেরিকান এমন পরিচয়ে দেখি না। কারণ তাদের মধ্যে আমি কোনও দূরত্ব খুঁজে পাই না, সেভাবে লিখিও না। অনেকে জানতে চান আমি ভারতীয় খাবার খেয়ে বড় হয়েছি কি না। কিন্তু আমি কোনও খাবারকেই ভারতীয় খাদ্য হিসেবে দেখি না, দেখি শুধু খাদ্য। আমার চরিত্রদের সম্পর্কেও ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটে থাকে। চরিত্রকে আমি চরিত্রই মনে করি, যেভাবে অন্যদের দেখি, স্রেফ সেভাবে। আমার মনে হয়, আমার ক্ষেত্রে এমন হওয়াটা অনিবার্য, অন্তত আমার লেখার ক্ষেত্রে তো অনিবার্যই, কেননা আমি এমন এক দেশে বাস করছি যেখানে ভারতীয়রা মেজরিটি নয়।