আমাদের ‘কালো মানিক’ আঁখি আক্তার

ফুটবলার আাঁখি আকতার

ফুটবলের বরপুত্র পেলেকে অনেকে আদর করে ডাকতেন কালো মানিক। আমাদেরও আছে ফুটবলের একজন ‘কালো মানিক’, তিনি আঁখি আক্তার। ডিফেন্ডারে খেলেন বলে অনেকে তাকে দেশের আরেক কৃতী ফুটবলার কায়সার হামিদের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। যদিও ব্যক্তিগতভাবে দেশের এই নারী ফুটবলার কায়সার হামিদকে চেনন না। তবে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে তার ছবি দেখেছেন বলে জানান জাতীয় নারী দলের এ ডিফেন্ডার।

কায়সার হামিদ আর আঁখির তুলনা হয় না। কিন্তু কায়সার হামিদের খেলার ধরনের সঙ্গে সত্যিই অনেক মিল আছে আঁখির। কেমন সেটা?

‘আঁখির উচ্চতা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। ফিজিক্যাল এই অ্যাডভান্টেজটা পুরোপুরি কাজে লাগান আঁখি। প্রতিপক্ষ আক্রমণে এলে তাদের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে লম্বা পাস দিয়ে পাল্টা আক্রমণের সুযোগ করে দেন। কর্ণার, ফ্রিকিকের সময় হেডে গোল করার জন্য আঁখি খুবই দক্ষ’- বলছিলেন গোলাম রব্বানী ছোটন।

অসাধারণ ডিফেন্স করা, লম্বা পাস দিয়ে প্রতি আক্রমণ করা আর হেডে গোল দেয়ার চেষ্টা- সবকিছুর মধ্যেই অনেকে কায়সার হামিদের ছায়া দেখতে পান আঁখির মধ্যে।

১৭ বছরে পা দিয়েছেন। এই বয়সেই ফুটবল খেলে পরিবারের দিন বদলে দিয়েছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পারকোলা গ্রামের আক্তার হোসেন ও নাছিমা বেগম দম্পতির দুই সন্তানের ছোট আঁখি। আক্তার হোসেন এক সময় তাঁতের কাজ করতেন অন্যের বাড়িতে। ছেলে নাজমুল ইসলাম ও মেয়ে আঁখিকে নিয়ে কস্টেই সংসার চালাতেন। তাঁতের কাজ আগের মতো নেই। তারপর তিনি ছেলেকে নিয়ে তরকারির ব্যবসা করতেন। ফুটবল খেলে আঁখি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে টাকা পুরস্কার পেয়েছেন সে টাকা স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখে এখন ভালোভাবে সংসার চালাচ্ছেন তারা।

আঁখির বাবা অসুস্থ। তাই এখন আর তাকে কোন কাজ করতে দেন না আঁখি। মাও অসুস্থ। আঁখির ৭ বছরের বড় ভাই নাজমুল ইসলাম উল্লাহপাড়া আকবর আলী কলেজে অনার্সের শেষ বর্ষের ছাত্র। সংসারের খরচ, বাবা-মায়ের চিকিৎসা এবং বড় ভাইয়ের পড়াশোনা- সবকিছুই এখন আঁখির অর্জন করা টাকায়।

অথচ একসময় বেশ কস্টেই দিন কাটত আক্তার হোসেনের পরিবারের। ‘আমি অনেক তৃপ্ত। কারণ, এখন আমাদের কোন কস্ট নেই। আগে আমাদের টাকা-পয়সার অভাব ছিল। মাঝেমধ্যে নানাবাড়ি থেকে আমাদের চাল-ডাল পাঠাত। এখন কারও সাহায্য লাগে না। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তিনবার টাকা পেয়েছি। একবার ১০ লাখ, আরেকবার ৩ লাখ ও আরেকবার ২ লাখ। এই ১৫ লাখ টাকা বাবা কিছু রেখেছেন ব্যাংকে, কিছু পোস্ট অফিসে। প্রয়োজন হলে সেখান থেকে টাকা উঠিয়ে তিনি কাজে লাগান। এখন সবকিছু ভালোভাবে চলছে। ভাইয়ের লেখাপড়াও চলছে নির্বিঘ্নে’- বলছিলেন আঁখি খাতুন।

২০১৭ সালে ঢাকায় সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন আঁখি। এরপর আঁখিকে শাহজাদপুর সরকারি কলেজের পাশে ৫ শতাংশ জায়গা (মৌজা : দ্বারিয়াপুর, আরএস দাগ : ১০৬২৯) বাসস্থানের জন্য উপহার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। জায়গার ওপর থাকা সরকারি একটা গুদামঘর ভেঙে সেখানে আঁখির ছবিসহ ব্যানার টানিয়ে জায়গা বরাদ্দের ঘোষণাও দিয়েছিল উপজেলা প্রশাসন।

তবে সেই জায়গার কাগজপত্র এখনও পাননি আঁখি। বললেন, ‘ঐ জায়গাটা পেলে সেখানে ঘর তুলে থাকতে পারতাম। এখন আমাদের বাড়িতে আমরা ও আরও দুই চাচা থাকি। আমাদের দুই কক্ষের একটি টিনের ঘর। এক কক্ষে বাবা আর ভাই থাকেন। অন্য কক্ষে আমি আর মা। আমাকে জায়গা দেবে বলে যে ব্যানার টানানো হয়েছিল সেটা ছিঁড়ে প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে।’

আঁখি এবার বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। বাফুফে ক্যাম্পে থেকেই ২০১৪ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ঐ বছরই বিকেএসপি প্রথম মেয়েদের ফুটবলে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু করেছিল। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার আগে আঁখি পড়াশোনা করেছেন নিজ এলাকা শাহজাদপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।

তার ফুটবলে আসা পারকোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে। স্কুলের সব খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন আঁখি। ১০০ ও ২০০ মিটার দৌঁড়, উচ্চলম্ফ, দীর্ঘলম্ফসহ স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সব ইভেন্টেই পুরস্কার থাকত আঁখির।

সেখানেরই মজার এক অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের এ ডিফেন্ডার, ‘একবার আমি ১২টি পুরস্কার পেয়েছিলাম। তখন পুরস্কার হিসেবে সিরামিকের প্লেট, গ্লাস সেটসহ নানান জিনিসপত্র দেয়া হতো। বারবার পুরস্কার নিতে স্টেজে উঠছিলাম। ইউএনও স্যার বলছিলেন, ‘এরপর তুমি খেলতে আসলে পুরস্কার নেয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে আসবা। আমাদের ঘরে অনেক জিনিসপত্র আছে যা আমি খেলে পেয়েছি।

সব খেলা বাদ দিয়ে ফুটবলে আসা প্রসঙ্গে আঁখি বলেন, ‘আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। ঐ বছরই বঙ্গমাতা ফুটবল শুরু হয়। আমাদের পারকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সবাই যখন খেলত আমি তখন পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম। বল বাইরে আসলে কুড়িয়ে ভেতরে দিতাম।’

‘সবাই খেলা শেষ করে চলে আমি কয়েকজনকে নিয়ে খেলতে নামতাম। আমাদের স্কুলের মনসুর স্যার আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি তো ভালো খেলো। ফুটবল খেলবে?’ আমি বললাম বাবার কাছে শুনে জানাব। বাড়িতে এসে বাবা ও ভাইকে বললাম। তারা বললেন, খেলো। তারপর খেলা শুরু করলাম। উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় মেয়েদের প্রতিযোগিতা হলে আমাকে নিত। তখন সবার মুখেমুখে আমার নাম। আমাকে অনেকে দেখতেও আসত। আমিও বেশি উৎসাহিৎ হয়ে খেলতে শুরু করলাম।’

বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় টুর্নামেন্টে ঢাকায় এসেছিল রাজশাহী বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন দল। আঁখিদের পারকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়ে বাদ পড়ে যায়। কিন্তু তারপরও নিজের যোগ্যতায় চান্স পান জাতীয় দলে। দমে যাননি এই মেয়ে। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আঁখি বলেন,

‘রাজশাহী চ্যাম্পিয়ন স্কুল দলের কোচ জহির স্যার আমাকে ঐ স্কুল দলে ঢাকা নিয়ে যান। আমরা প্রথম ম্যাচেই হেরে যাই রাঙামাটির একটি স্কুলের কাছে। এরপর রাজশাহীতে একটি ক্যাম্প হয়। সেখানে দায়িত্বে ছিলেন ছোটন স্যার। আমরা জেএফএ কাপ খেলি। সেখান থেকে বাছাই করা খেলোয়াড় নিয়ে বাফুফের ক্যাম্পে ডাকা হয় অনূর্ধ্ব-১৪ দল করতে। আমি তাজিকিস্তান সফরের দলে সুযোগ পাই। সেবার আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। ওই টুর্নামেন্টের ফাইনালে আমি পুরো সময় খেলেছিলাম। কারণ, আনুচিং চোট পেয়েছিল। ফাইনালের আগের ম্যাচে বদলি হিসেবে এক ম্যাচ খেলে কর্ণার থেকে হেডে গোল করেছিলাম। বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দল মিলিয়ে আমার ১৩-১৪ টি গোল আছে’- বলেন আঁখি খাতুন।

বাংলাদেশের নারী সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে আঁখির রয়েছে বিরাট ভূমিকা। দুটি টুর্নামেন্টেই সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের কন্যা আঁখি।

ফুটবলার হওয়ার পেছনে বাবার অবদানের কথা উল্লেখ করে আঁখি বলছিলেন, ‘বাবা খুব করে চেয়েছিলেন আমি যেন ভালো ফুটবলার হই। তখন বুট ও জার্সি কেনার টাকা বাবার কাছে ছিল না। বাবা অন্যদের কাছ থেকে এগুলো এনে আমাকে দিতেন।’

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মনসুর স্যারের অবদানের কথা বলতেও ভোলেননি ‘নারী ফুটবলের কায়সার হামিদখ্যাত’ ফুটবলার আঁখি খাতুন, ‘বাবা আর স্যারের উৎসাহেই আজ আমি ফুটবলে।’

ডিফেন্ডার পজিশনে থিতু হওয়ার আগে আঁখি খাতুন সব পজিশনেই খেলেছেন, ‘আমি খেলা শুরু করি রাইট আউট পজিশনে। জেএফএ কাপে খেলি স্ট্রাইকার হিসেবে। ছোটন স্যার নিয়ে আসেন মিডফিল্ডে। এরপর পল স্যার (সাবেক টেকনিক্যাল ডাইরেক্টও পল স্মলি) আমার লং শট দেখে নিয়ে আসেন ডিফেন্সে। সাবেক গোলরক্ষক কোচ রায়ান স্যার গোলরক্ষক পজিশনেও আমাকে প্রাকটিস করাতেন। এমনও হয়েছে পল স্যার ডিফেন্সের অনুশীলনে রাখছেন, আবার রায়ান স্যার গোলরক্ষকের অনুশীলনেও রাখছেন। পরে স্যাররা মিলে নির্ধারণ করেন আমি ডিফেন্সেই খেলব।’

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/