বার বার ডাকে আলো আধারির সাদা ঢেউ

সালমা আফরোজ
 
মানুষের মনের ভেতর একটা উরু উরু ভাব, সুযোগ পেলেই একটু কোথাও হারিয়ে যেতে মন চাওয়া, ইট পাথরের শহর ছেড়ে প্রকৃতির কাছে গিয়ে বিশুদ্ধ বাতাসের ঘ্রান নিতে চায়। অনেকের পা চলাতেই আনন্দ। দেশ দেশান্তরে ভ্রমণ করেই মানুষ সৌন্দর্য পিপাসু মনের খোরাক যোগায়। বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রতিটা জেলায় পর্যটন এলাকা রয়েছে। এ দেশে কি নেই পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী-বন-বনাঞ্চল সব আছে সব। মন চায় অজানাকে জানতে, অচেনাকে চিনতে, মানুষের মন তো কত কিছু যে চায়। এই মনে হয় যদি পাখির মতো ুইটা ডানা থাকত মুক্ত বিহঙ্গের মত ছুটে যেতাম সীমানা ছাড়িয়ে দূর দূরান্তে। মন ও মন তোর কত চাওয়া! সমুদ্র বার বার হাতছানি দেয়। খালি ছুটে যেতে চায় মন।

২০১৮ সালের মে মাসে লেডি ট্রাভেল বাংলাদেশ গ্রুপের সাথে গিয়েছিলাম কক্সবাজার। একদম অচেনা গ্রুপের অচেনা মানুষ। এই ভীতু আমি হঠাৎ কোথা থেকে এতো সাহস পেলাম জানি না। কাউকে কিছু না বলেই মিরপুর ডিওএইচএস তাদের অফিসে গিয়ে টাকা এডভান্স করে আসি। তারপর বড় ভাইয়াকে জানালাম, ভাইয়ার কত প্রশ্ন, আমি তাদের চিনি কিনা, না চিনলে কেন যাচ্ছি, অচেনা গ্রুপ বিপদ আপদ হতে পারে। অবাক কাণ্ড যাওয়ার দিন গায়ে জ্বর। ভাইয়ার থেকে ওষুধ নিয়ে রওয়ানা দিলাম।  মেঘলা আকাশ টিপটিপ বৃস্টি আহ, এইটাই তো শ্রেষ্ট সময় কক্সবাজার ঘুরতে যাবার।

অফিস থেকে চলে গেলাম আরামবাগ নটরডেম কলেজের ওপাশে বাস কাউন্টারে। গিয়ে দেখি এডমিন আসেনি। অপেক্ষা করতে হল রাত ১১ টা পযন্ত। বাস আসল এডমিনসহ আমরা ৬ জন রওনা দিলাম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, প্রকৃতির টানে।

ভ্রমন পিপাসুদের স্বভাবই হলো এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ছুটে যাওয়া, একদেশ থেকে অন্যদেশে। প্রকৃতির দান আমারে বাংলাদেশ। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতপ্রকৃতির অপরূপ শোভায় সুশোভিত। সাগর মেঘলা-গিরি কুন্তলাা, রুপালি সৈকতের অনন্য বিশ্ব নন্দিত সমুদ্র সৈকত। পীর আউলিয়ার পূণ্যভূমি বীরচট্টলার লীলা নিকেতন কক্সবাজার সারা বিশ্বের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। কক্সবাজার আমাদের গর্বের ধন, আগামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যত, অর্থনৈতিক মুক্তির দিশারী। কক্সবাজার হাতছাানি দিয়ে বিশ্ববাসীকে কাছে ডাকছে। হাতছানি দেয়  হিমছড়ির প্রাকৃতিক ঝর্ণা, ইনানি বিচ ও টেকনাফ সমুদ্র সৈকত। নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘেরা, দিগন্তজোড়া বনময় সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ। সবুজ শ্যামল প্রান্তর, মাথার উপর নীলাকাশ। আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথ। মাঝেমাঝে জনবসতি সাজানো গোছানো সব। বিচিত্র শোভায় সুশোভিত কক্সবাজার। তাইতো কক্সবাজারের রূপ সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসেন সারা বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকরা।

সকালে পৌছে গেলাম আমরা কক্সবাজার। হোটেলে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ছুটলাম সমুদ্র সৈকতে। দেরি একদমই সহ্য হচ্ছে না। বৃস্টি হচ্ছিল খুব, এটাই তো আমি চাচ্ছিলাম। মেঘলা আকাশ, ঝুম বৃস্টি। সে এক অন্য রকম অনুভূতি, ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। সারি সারি ঝাউবন, বালুর নরম বিছানা, সামনে বিশাল সমুদ্র। নীল জলরাশি আর শো শো গর্জনের মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকত হলো কক্সবাজার।

দুপুর হয়ে গেছে এডমিন খাবারের জন্য আমারে ডাক দিচ্ছেন কিন্ত মন চাইছে না। ফেরার সময় পথ চলতে চলতে চোখ পড়ে বাম পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ ঘেরা পাহাড় আর ডানদিকে সমুদ্রের নীল জলরাশি থেকে ধেয়ে আসা অনবরত ঢেউ। প্রথম দিন অনেক রাত পযর্ন্ত ছিলাম সমুদ্রে। আলো আধারিতে সমুদ্রের সাদা ঢেউয়ের খেলা মন চু্ম্বকের মতো টানছে। ঢেউ আসছে আর যাচ্ছে, চোখ ফেরাতে পারছি না। রাতে হোটেলে ফিরে সবার সাথে চললো আরো কিছুক্ষণ আড্ডা। পরদিন লাবনী, সুগন্ধা ও কলাতলী সি বিচ পয়েন্ট সব ঘুরলাম এই ফাঁকে কিছু কেনাকাটা করে ফেরলাম। ১২০ কিলোমিটার লম্বা দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতের বালুকাময়ের উপর খালি পায়ে হেঁটে হেঁ঳টে উপভোগ করি সাগরের ঢেউ। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ যেন জীবনের না পাওয়ার আর্তনাদ, হাহাকার! রোমাঞ্চকর জীবনের গল্প বা ব্যর্থতা কিংবা হতাশার গল্প হারিয়ে যায় উত্তাল জলরাশির শব্দে। এক পাশে পাহাড়, সারি সারি ঝাউবন, সামনে বিশাল নীল জলরাশির কখনো উত্তাল, কখনো স্থির সমুদ্র।

কলাতলী ও লাবনী পয়েন্ট সৈকতের সামনে চেয়ারে বসে কফির মগ হাতে চুমক দিতে দিতে দেখি সমুদ্রের বুকে হারিয়ে যাচ্ছে সূর্য। সন্ধ্যা হতেই বাড়তে থাকে সৈকত মার্কেটগুলোর বর্ণিল আলোর ছটা। ঝিনুক মার্কেটে ভেসে উঠে লাল নীল হলুদসহ রঙিন আলোকরশ্মি। রাতে খেলাম নানা জাতের সামুদ্রিক মাছ ভাজা। সমুদ্রের কাছে গেলে একদম কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তাই চুপচাপ চেয়ারে বসে ঢেউ উপভোগ করি। রাত জেগে জেগে অবলোকন করি আল্লাহর অপরূপ সৃস্টি। মনের মধ্যে কি যে প্রশান্তি!

তৃতীয় দিন আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেবার ঢাকায় পৌছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। তাতে কি শরীর মনে ছিল সমুদ্রের একরাশ ভাল লাগা। বার বারই হাতছানি দেয় আমায় সমুদ্রের অনবরত ঢেউ, সমুদ্রস্নান, রাতে আলোআধারিতে সাদা ফেনার ঢেউ। এবার এই করোনা মহামারিতে যদি বেঁচে যাই তাহলে প্রথমেই ছুটব কক্সবাজার। আহ কক্সবাজার!

সালমা আফরোজ- সাংবাদিক ও লেখক