ভিয়েতনামে ছিলাম বলেই বেঁচে আছি: এক করোনা যোদ্ধার স্বীকারোক্তি

ভিয়েতনামে করোনায় একজনও মারা যায়নি

গুরুতর অসুস্থ কোনও মানুষ সেরে উঠলে আমরা প্রায়ই বলে থাকি, ‘সে হায়াত গুণে বেঁচে গেছে।’কিন্তু স্টিভেন ক্যামেরন মনে করেন, তিনি ভিয়েতনামে ছিলেন বলেই করোনায় এতটা এত ভয়াবহভাবে অসুস্থ হওয়ার পরও বেঁচে ফিরেছেন। বিশ্বের অন্য কোনও দেশ, এমনকি নিজের দেশ স্কটল্যান্ডে থাকলেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। তাই তিনি বারবার এশিয়ার এই দেশটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

প্রসঙ্গত, এখনও পর্যন্ত ভিয়েতনামে করোনা আক্রান্ত কোনও রোগী মারা যায়নি। এমনকি সেখানে করোনা আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও খুব কম। বিশ্বের যে গুটিকয়েক দেশ  করোনা নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখিয়েছে তাদের অন্যতম ভিয়েতনাম।

করোনা থেকে বেঁচে ফেরা  স্টিভেন ক্যামেরন সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি’র কাছে নিজের করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। এ সময় তিনি নিজেকে ‘এশিয়ার সবচেয়ে অসুস্থ কোভিড রোগী’বলে দাবি করেছেন।

আগেই বলেছি তার করোনা শনাক্ত হয়েছিল জন্মভূমি স্কটল্যান্ড থেকে ১০হাজার মাইল দুরের দেশ ভিয়েতনামে।  অসুস্থ হওয়ার পর তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু তার অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। ক্যামেরনের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে ঢোকানো হয়। দু মাসেরও বেশি সময় তিনি সেখানে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। ডাক্তাররা এক পর্যায়ে বলে দেন তার বাঁচার আশা বড়জোর ১০ শতাংশ।

বিবিসিকে স্টিভেন ক্যামেরন বলেন, ‘আমার দেহের নানা জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। শরীরের দুটো প্রত্যঙ্গ কাজ করছিলো না। ফুসফুসের ক্ষমতা এক পর্যায়ে ১০ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। তখন আমাকে বলা হয়েছিল এশিয়ার সবচেয়ে অসুস্থ করোনা রোগী।’

তার শরীরের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে ভিয়েতনামের সরকার, চিকিৎসক সমাজ থেকে শুরু করে সেদেশের মিডিয়া পুরো সময় ধরে তার ওপর নজর রেখেছিল। করোনাভাইরাস মহামারিতে চলাকালে স্টিভেন ক্যামেরনের মতো এত জটিল কোভিড রোগী ভিয়েতনামের ডাক্তারদের সামলাতে হয়নি।

৪২ বছর বয়সী এই স্কটিশ নাগরিক ভিয়েতনামে রোগী-৯১ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তার ডাক্তাররা বলছেন, বেঁচে গেলেও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে তাকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

এখন ক্যামেরন এই রোগ সম্পর্কে মানুষকে সাবধান করে চলেছেন। পুরোপুরি নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত কেউ যেন ভুলেও এই ভাইরাসকে হেলাফেলা না করেন। কেননা ‘এই ভাইরাস যে কতটা ভয়ঙ্কর আমি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।’ স্কটল্যান্ডের একটি হাসপাতালের বেড থেকে বিবিসিকে জানান ক্যামেরন।

হো চি মিনের হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে দুই মাসেরও বেশি সময় অচেতন ছিলেন স্টিভেন ক্যামেরন যেদেশ থেকে তিনি বেঁচে ফিরেছেন, সেই ভিয়েতনাম এতটাই সতর্ক ছিল যে এখনও একজনও সেখানে কোভিডে মারা যায়নি।

হাসপাতালে ক্যামেরন যতদিন অচেতন ছিলেন, অধিকাংশ সময় তাকে ‘একমো‘ নামে বিশেষ একটি যন্ত্রের সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা হয়। রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হলেই এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়। এই যন্ত্রের সাহায্যে রোগীর শরীর থেকে রক্ত বের করে তাতে অক্সিজেন মিশিয়ে আবার তা শরীরে ঢোকানো হয়।

‘এক পর্যায়ে আমার বন্ধু ক্রেইগ (ব্রিটিশ) পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানায় আমার বাঁচার সম্ভাবনা ১০ শতাংশ। সে আমার অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়ার চুক্তি বাতিল করে দেয় এবং আমার মরদেহ নিয়ে কী করবে তার পরিকল্পনা করতে শুরু করে দেয়।’জুন মাসে হো চি মিন-এর হাসপাতাল থেকে বিবিসিকে বলেছিলেন স্টিভেন ক্যামেরন।

খুব অল্পের জন্য দ্বিতীয়বারের মত ফুসফুস বদলানোর হাত থেকে রক্ষা পান ক্যামেরন। এক পর্যায়ে তার শরীরের একাধিক যন্ত্র কাজ করছিলো না।

ভিয়েতনামের কাছে কৃতজ্ঞ  ক্যামেরন

ক্যামেরন মনে করেন তার সৌভাগ্য যে তিনি ভিয়েতনামে অসুস্থ হয়েছিলেন। কারণ সাড়ে নয় কোটি মানুষের দেশে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪২০ জন কোভিড রোগী সেখানে শনাক্ত হয়েছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নিতে হয়েছে এবং দেশটিতে এখনও করোনায় একজনও মারা যায়নি।

তাই ক্যামেরন মনে করেন, ‘পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় এমন অসুস্থ হলে আমি মারা যেতাম। কেননা অসুস্থ হওয়ার ৩০ দিন পরেই চিকিৎসকেরা আমার ভেন্টিলেটরের সুইচ অফ করে দিতেন। কিন্তু ভিয়েতনামের চিকিৎসকেরা সেটা করেননি।’

‘ভিয়েতনামের মানুষ আমাকে যেভাবে তাদের হৃদয়ে জায়গা দিয়েছে, আমি তার জন্য ভীষণ কৃতজ্ঞ। তাদের ডাক্তাররা কোনোভাবেই চাননি যে আমি তাদের চোখের সামনে মারা যাই। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।“

স্কটল্যান্ডে ফেরার পর তার ফলো-আপ চিকিৎসার দায়িত্বে রয়েছেন শ্বাসযন্ত্র রোগের বিশেষজ্ঞ ড. মনিশ প্যাটেল। তিনি বলেন, ক্যামেরন যে এত দীর্ঘ সময় ধরে অচেতন থাকার পরও প্রাণে বেঁচেছেন  সেটা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা।

হো চি মিনের হাসপাতালে ভেন্টিলেটরে থাকার সময় দু মাসেই তার শরীরের ওজন ৩০ কেজি কমে যায়। স্কটল্যান্ডে তার শরীরের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে। যদিও এখনও তিনি হাঁটতে পারছেন না।

‘আমি যখন প্রথম চেতনা ফিরে পেলাম আমার ভেতর আতঙ্ক এসে ভর করে। -আমি কি আর কখনও হাঁটতে পারবো! আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার প্যারালাইসিস হয়েছে কিনা। কারণ আমি পায়ে কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল আমি বোধ আর কখনই বিমান চালাতে পারবো না।’ বলেছিলেন স্টিভেন ক্যামেরন।

স্টিভেন ক্যামেরন

এখন তার লক্ষ্য আগামী বছরের শুরুতে আবার বিমান চালানো। যদিও তার শরীরিক অবস্থা তার পাইলট পেশাকে বেশ ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু তারপরও তিনি আশাবাদী। একই সঙ্গে জীবন ফিরে পাওয়ায় ভিয়েতনামের প্রতি কৃতজ্ঞ।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/