আজ দেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জন্মদিন। একুশে পদক প্রাপ্ত এই শিল্পী ছবি আঁকার পাশাপাশি সুর সাধনা করতেন এবং দারুণ বাঁশি বাজাতেন। চিত্রশিল্পী হিসাব স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ম্যান অব এশিয়া পুরস্কার লাভ করেন।
প্রাথমিক জীবন
চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জন্ম ১৯২৩ সালের বাংলাদেশের নড়াইল জেলার মাসিমদিয়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। তার প্রকৃত নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। তার বাবা শেখ মোহাম্মদ মেসের আলী ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী। তবে কৃষিকাজই ছিল তার মূল পেশা। পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য ঘরামির কাজ করতেন। সুলতান ছিলেন পরিবারের একমাত্র সন্তান। শৈশবে পরিবারের সবাই তাকে লাল মিয়া বলে ডাকতো।
১৯২৮ সালে লালমিয়াকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে তাকে ভর্তি করিয়ে দেন তার বাবা। হয়তো পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায় ছেলেকে শিক্ষাদানের এই বিলাসিতাটুকু করতে পেরেছিলেন তার বাবা মেসের আলী। কিন্তু সেখানে ছেলেকে নিয়মিত পড়ানোর সামর্থ্য তার ছিল না। ফলে পাঁচ বছর পড়ার পর ১৯৩৮ সালে ক্লাস এইটে উঠেই তিনি স্কুল ছেড়ে দেন। বাড়ি ফিরে বাবার সহযোগী হিসেবে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। এ সময় বাবার ইমারত তৈরির কাজ সুলতানকে প্রভাবিত করে এবং তিনি রাজমিস্ত্রীর কাজের ফাঁকে আঁকাআঁকি শুরু করেন। আর এভাবে শৈশবেই সুলতানের রং তুলির সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে।
১০ বছর বয়সে তিনি যখন নড়াইলে ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পড়েতেন তখন সেটি পরিদর্শনে এলেন আশুতোষ মুখার্জির ছেলে ড. শাম্যপ্রসাদ মুখার্জি। এই উপলক্ষে সুলতান তার একটি পেন্সিল স্কেচ আঁকেন। শাম্যপ্রসাদ তার আঁকা স্কেচ দেখে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন এবং এই পেন্সিল স্কেচের মাধ্যমেই শিল্পী হিসেবে সুলতানের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে।
ছবি আঁকার প্রতিভার কারণে শৈশব থেকেই এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় সুলতানকে পছন্দ করতেন। ধীরেন্দ্রনাথের ভাইয়ের ছেলে অরুণ রায় তখন কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র। সেই অরুণ রায়ের কাছে সুলতান ছবি আঁকা শিখতে শুরু করেন। ছবি আঁকা শেখার জন্য কলকাতায় পাড়ি জমান। কিন্তু বয়স কম হবার কারণে তখন কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। এসময় তিনি কলকাতায় কখনও ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ি, কখনো তার ভাই সত্যেন রায়ের বাড়ি, কখনো তাদের অন্যান্য ভাইদের বাড়িতে থেকে সুলতান তিন বছর ছবি আঁকার চর্চা করেন।
১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেন। পরীক্ষায় অংশ নেয়া চারশো ছেলেমেয়েকে পনেরো মিনিটে ভেনাস মিলোর ছবি আঁকতে দেয়া হয়। ওই ভর্তি পরীক্ষায় সুলতান প্রথম হন। কিন্তু এন্ট্রান্স পাশ না থাকার কারণে তার ভর্তি নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তখন ধীরেন্দ্রনাথ রায় বিষয়টা প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরার্দীর বড় ভাই শাহেদ সোহরাওয়ার্দীকে জানান। সোহরাওয়ার্দী তখন প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এবং কলকাতা আর্ট স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সদস্য। তার সহায়তায় সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তিনিই সুলতানকে পরামর্শ দেন ভর্তি হবার সময় কাগজপত্রে লাল মিয়া না লিখে শেখ মোহাম্মদ সুলতান লিখতে। সুলতানকে সোহরাওয়ার্দী সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন। তার অসাধারণ সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার সুলতানের জন্য সব সময় উন্মুক্ত ছিলো। কিছুকাল তার বাসায় ও তার ভাই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাসায় থেকে সুলতান পড়াশোনা করেছেন।
কলকাতা আর্ট স্কুলের অন্যান্য ক্লাসে তখন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, রাজেন তরফদার, আনওয়ারুল হকের মত ব্যক্তিত্ব পড়াশোনা করতেন। ফলে তাদের সাথে সুলতানের যোগাযোগ ঘটে। ছাত্র হিসেবে সুলতান ভালো ছিলেন, এর পাশাপাশি মঞ্চনাটকে অভিনয় করেও প্রশংসা অর্জন করেন। কিন্তু এই পড়াটাও তিনি সম্পর্ণ করতে পারেননি। ১৯৪৩ সালে তৃতীয় বর্ষে উঠে সুলতান আর্ট স্কুল ছেড়ে ভারত ভ্রমণে বের হয়ে পড়েন।
কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাঁধাধরা জীবন এবং প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার কঠোর রীতিনীতি সুলতানের জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো না। তিনি ছিলেন বোহেমীয় জীবনাচারের অনুসারী। চেতনায় তিনি ছিলেন স্বাধীন এবং প্রকৃতিগতভাবে ছিলেন ভবঘুরে এবং ছন্নছাড়া। প্রকৃতিকে তিনি সবসময় রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছেন। আবার যান্ত্রিক নগরজীবনকে সেরকমই ঘৃণা করেছেন।
জানা যায়, ১৯৪৩ সালে তিনি খাকসার আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। এর কিছু সময় পরেই বেরিয়ে পড়েন এবং উপমহাদেশের পথে পথে ঘুরে তার অনেকটা সময় কেটে যায়। তখন ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্য ছিলো ভারতে। তিনি ছোট-বড় বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে ছবি এঁকে তা সৈন্যদের কাছে বিক্রি করতেন। এভাবেই তিনি সেসময় জীবনধারণ করেছেন। মাঝে মাঝে তার ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি শিল্পী হিসেবে কিছুটা পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু সুলতানের চরিত্রে পার্থিব বিষয়ের প্রতি যে অনীহা এবং যে খামখেয়ালীপনা ছিলো তার কারণে সেই ছবিগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সেগুলোর কোনো আলোকচিত্রও এখন আর পাওয়া যায় না। এছাড়া তিনি কখনও এক স্থানে বেশি দিন থাকতেন না। তবে এটুকু জানা গেছে যে, সেসময় তিনি প্রাকৃতিক নৈসর্গ্য এবং প্রতিকৃতি আঁকতেন। তার আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিলো ১৯৪৬ সালে সিমলায়।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) ফিরে আসেন এস এম সুলতান। এখানে কিছুদিন থেকেই করাচি চলে যান। সেখানে পারসি স্কুলের শিল্প শিক্ষক হিসেবে দুই বছর চাকুরি করেন। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় চুঘতাই এবং শাকের আলীর মত বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে। এর কিছু আগে ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো এবং বোস্টনে তার ছবির প্রদর্শনী হয়। এরপর লন্ডনেও তিনি প্রদর্শনী করেছিলেন।
সুলতান ও নড়াইলে শিশুস্বর্গ
বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ালেও সুলতানের আসল সুরটি যেন বাঁধা ছিল তার জন্মভূমি নড়াইলে। তাই তো তিনি বারবার এখানেই ফিরে এসছেন। ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে তিনি আবার নড়াইলে ফিরে আসেন। তার কিছুদিন পর তিনি চলে আসেন চাচুঁড়ি পুরুলিয়াতে। এখানকার পরিত্যক্ত কৈলাসটিলা জমিদারবাড়িটি পরিষ্কার করে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন নন্দনকানন প্রাইমারি স্কুল এবং নন্দনকানন ফাইন আর্টস স্কুল যা পরে পরিণত হয় চাচুঁড়ি পুরুলিয়া হাইস্কুল-এ। প্রশাসনের সহায়তায় স্কুল চলতে থাকে কিন্তু বন্ধ হয়ে যায় ছবি আঁকার ক্লাস। সুলতান দুঃখ পেয়ে আবার নড়াইলে চলে আসেন। এবার এসে তিনি শিশুশিক্ষার প্রসারে কাজ শুরু করেন যা নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিলো। শেষ বয়সে তিনি নড়াইলে শিশুস্বর্গ এবং যশোরে চারুপীঠ নামে দুটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।
সত্তরের দশকের মধ্যভাগে তার কিছু শুভানুধ্যায়ী তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এখানে এসে তিনি কিছু ছবি আঁকেন। তার আঁকা এইসব ছবি নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে এবং এই প্রদর্শনীর মাধ্যমেই তিনি নতুন করে শিল্পসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
অবশ্য আশির দশক থেকে তিনি আবার নড়াইলেই থাকতে বাধ্য হন। তার কাছে যেসব মানুষ এবং শিশু আশ্রয় নিয়েছিলো তাদের জন্য তিনি নিজের ঘর ছেড়ে দেন। জীবজন্তুর প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি একটি চিড়িয়াখানা তৈরি করেন এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে শিশুদের জন্য সুন্দরী কাঠ দিয়ে একটি বড় আকারের নৌকাও তৈরি করেছিলেন। তার ইচ্ছা ছিলো শিশুরা সেই নৌকায় চড়ে সমুদ্র পরিভ্রমণে বের হবে আর শিল্পচর্চার উপকরণ খুঁজে পাবে।
নিজের এই যাপিত জীবন, আঁকাআকি আর নড়াইলের শিশুস্বর্গ নিয়ে সুখী ছিলেন শিল্পী এস এম সুলতান। এ সম্পর্কে শেষ জীবনে বলেছেন- ‘আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।’
সুলতানের শিল্পকর্ম
মধ্য পঞ্চাশে ঢাকায় যখন আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে অনেক কাজ হচ্ছে এবং প্রচুর উৎসাহ এবং আগ্রহ নিয়ে শিল্পিরা শৈলী নিয়ে, ফর্ম নিয়ে, মিডিয়া নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন তখন সকলের দৃষ্টির আড়ালে নড়াইলেই রয়ে যান শিল্পী সুলতান। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন, কিন্তু তার জীবনের মূল সুরটি বাঁধা ছিল গ্রামীণ জীবন, কৃষক ও কৃষিকাজের ছন্দের সঙ্গে। সেখানেই তিনি আবিষ্কার করেছেন বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং বাঙালি জীবনের প্রধান উৎসকেন্দ্রটি, বাঙালির দ্রোহ ও প্রতিবাদ, বিপ্লব ও সংগ্রাম এবং নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার ইতিহাস এবং অনুপ্রেরণা। তাই তো তিনি কৃষক পুরুষের শরীরকে করেছেন পেশীবহুল এবং বলশালী, কৃষক রমণীর শরীরকে এঁকেছেন সুডৌল ও সুঠাম গড়নে, তাকে দিয়েছেন যুগপত লাবণ্য এবং শক্তি।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন,‘আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো -সেটাও রোগা…। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি যে আমাদের দেশের কৃষক সম্প্রদায়ইতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিলো। অর্থবিত্ত ওরাই তো যোগান দেয়। …আর এই যত জমিদার রাজা মজারাজা আমাদের দেশের কম কেউ না। সবাই তো কৃষিনির্ভর একই জাতির ছেলে। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রু্গ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়। ফসল ফলায়।’
একই সাথে তার এ ছবিগুলোতে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু করুণ বাস্তবতা উঠে এসেছে। তার এরকম দুটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) এবং চরদখল (১৯৮৮)।
১৯৭৬ সালে তার আঁকা শিল্পকর্ম নিয়ে শিল্পকলা একাডেমীর প্রদর্শনীতে তার ছবির মহিমা নতুন করে প্রস্ফুটিত হয়। এই ছবিগুলোর মধ্যে দেখা যায় বিশ্বের কেন্দ্র হচ্ছে গ্রাম আর সেই কেন্দ্রের রূপকার কৃষককে আপন মহিমায় সেখানে অধিষ্ঠিত দেখা যায়। গ্রাম ও গ্রামের মানুষ ছিলো তার শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা আর উপকরণ ছিলো কৃষক এবং কৃষকের জীবন চেতনা। এস এম সুলতান তেলরঙ এবং জলরঙে ছবি আঁকতেন। পাশাপাশি রেখাচিত্র আঁকতেন। আঁকার জন্য তিনি একেবারে সাধারণ কাগজ, রঙ এবং জুটের ক্যানভাস ব্যবহার করেছেন। এজন্য তার অনেক ছবিরই রঙ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো, যদিও এসবের প্রতি তিনি তেমন ভ্রূক্ষেপ করতেন না। নড়াইলে থাকাকালীন সময়ে তিনি অনেক ছবি কয়লা দিয়ে এঁকেছিলেন তবে সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়৷
এস এম সুলতান আধুনিকতার একটি নিজস্ব সংজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন। তার তেমন কোনো অনুসারী ছিলো না যারা একই সংজ্ঞা মেনে শিল্পচর্চা করতেন। একারণেই তার প্রতিষ্ঠিত আধুনিকতার স্বরূপ নিয়ে নতুন কোনো ধারার সৃষ্টি হয়নি। কেউ তার মতো করে আধুনিকতার ব্যাখ্যাও দেননি। এছাড়া তার মতো মাটির জীবন তখনকার কোনও শিল্পী যাপন করেননি।
তার কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা কেমন ছিলো তা বলতে গিয়ে তার জীবনীর লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন- ‘তার কাছে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি; তার আধুনিকতা ছিলো জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তার কাছে ছিলো 'আধুনিকতা', অর্থাৎ তিনি ইউরো-কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।’
১৯৯৪ সালে ঢাকার গ্যালারি টোনে তার সর্বশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সে বছরেরই আগস্ট মাসে নড়াইলে ঘটা করে তার জন্মদিন পালন করা হয়।
পুরস্কার এবং সম্মাননা
চিত্রশিল্পী হিসাব স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ম্যান অব এশিয়া পুরস্কার লাভ করেন।তিনি ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার গ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৫১ সালে নিউ ইয়র্কে, ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে আন্তর্জাতিক জুরী কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হন।
এছাড়া তিনি একুশে পদক (১৯৮২), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৩) ও চারুশিল্পী সংসদ সম্মান (১৯৮৫) পেয়েছিলেন।
আদম সুরত
তবে বাংলাদেশের এই প্রতিভাবান শিল্পীর চিত্রকলা নিয়ে আমাদের দেশে খুব বেশি কাজ হয়নি। তার ওপর প্রখ্যাত পরিচালক তারেক মাসুদ ‘আদম সুরত’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। তিনি দীর্ঘ ৭ বছর ধরে (১৯৮২-৮৭) সুলতানের জীবনীভিত্তিক এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এতে সুলতানের দৈনন্দিন কর্মজীবন তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলার সংস্কৃতি এবং কৃষিচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া সুলতানের জীবন এবং কর্মের ওপর ২০১০ সালে ফাহিম মিউজিকের ব্যানারে লাল মিয়া নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন আমিরুল ইসলাম। এতে সুলতানের স্মৃতিবিজড়িত নড়াইলের বিভিন্ন স্থান, চিত্রা নদী, শিশুস্বর্গ, বিভিন্ন সময়ে তার আঁকা চিত্র ও দুর্লভ আলোকচিত্র রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে সুলতানের পাঁচ মিনিটের একটি সাক্ষাৎকার।
আশির দশকের শেষদিকে তার স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল ৪টা ৩৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এস এম সুলতান।
আজ প্রথাবিরোধী এই চিত্রশিল্পীর ৯৭তম জন্মদিনে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অগাধ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন শিল্পী এস এম সুলতান।
উইকিপিডিয়া অবলম্বনে
ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/
