মহিলা পরিষদের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বছরব্যাপী কর্মসূচির অনলাইন আলোচনা

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয়  সংগঠন উপপরিষদের উদ্যোগে আজ মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে সংগঠনের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী গৃহীত কর্মসূচির আওতায় ‘বাংলাদেশের নারী আন্দোলন ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিষয়ক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।

অনুষ্ঠানে সম্মানিত আলোচক  হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. শাইখ ইমতিয়াজ এবং ব্র্যাকের জেন্ডার এ্যডভাইজার হাসনে আরা ডালিয়া।

সভায় স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু  সংগঠনের প্রয়াত নেত্রীবৃন্দ এবং সুহৃদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন ১৯৭০-২০২০ এই পঞ্চাশ বছরে ন্যায় ভিত্তিক ও সমতাপূর্ণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে নিরলসভাবে পথ হেঁটে চলেছে সংগঠন। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন বৈশ্বিক নারী আন্দোলন থেকে বিছিন্ন নয়। নারী আন্দোলনের মাধ্যমে নারীদের জীবনে যেমন নানা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে তেমনি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কর্মকৌশলে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। একটি জবাবদিহিতামূলক, মানবিক, সমতাপূর্ণ, নারীর প্রতি সংবেদনশীল সমাজ গড়ে তুলতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার কথা বলেন তিনি। পাশাপাশি নারী আন্দোলন কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি ক্রমাগত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে দক্ষতা, শক্তি অর্জন ও দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।

সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ একটি গণনারী সংগঠন। ৬৩ টি জেলা কমিটি, ২৩৫০ টি শাখা কমিটি এবং দেড় লক্ষাধিক সদস্য নিয়ে ৫০ বছরের পথচলা সংগঠনের। এই ৫০ বছরে  মহিলা পরিষদের কর্মপরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতিতে পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে নারীরা বিভিন্নমুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। নারী নির্যাতনের মাত্রা পরিবর্তন হয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর যে পদচারনা সেখানে নারীরা যে বাধার স¤মুখীন হচ্ছেন তা নারী আন্দোলনের মূল ধারায় আনতে হবে। তিনি সংগঠনের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কাজের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে  এবং  সমন্বয় করে কাজ করার আহ্বান জানান কর্মীদের প্রতি।

সম্মানিত আলোচক  হিসেবে উপস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার বলেন, নারী আন্দোলন যে কেবল নারীর অধিকার ও ন্যায্যতার কথা বলে তা নয় বরং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যেকোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বাধীনতার আন্দোলনে নারী সংগঠনগুলো সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভূমিকা অতুলনীয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের নারীদের প্রতি যেকোনো নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তুলেছে সংগঠন, যা তৃণমূলেও অত্যন্ত সক্রিয়।  তবে সমতা প্রতিষ্ঠায় এখনো সমাজের যে প্রান্তিক দিকগুলো আছে তা কাটিয়ে উঠতে হলে নারী আন্দোলন কর্মীদের উজ্জীবিত হতে হবে। একই সঙ্গে তিনি তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব তৈরি করা, অন্যান্য সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেটওয়ার্ক তৈরির আহ্বান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক  ড. সৈয়দ মো. শাইখ ইমতিয়াজ বলেন  বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নারীর অধিকার ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এনজিওগুলোকে ডোনারদের ইচ্ছা মেনে কাজ করতে হয়, কিন্তু স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে আত্ম উপলব্ধি নিয়ে  কাজ করার ক্ষেত্রে  বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মতো সংগঠন কমই আছে। এক্ষেত্রে সংগঠন একটি অনন্য উদাহরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। কেবল তাই নয়, একইসাথে নারীর অধিকার ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে তৃণমূলে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে,যা অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে বিরল। তিনি সংগঠনকে তার বহুমুখী অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় পদক দেয়ার দাবি জানান। কেননা তার ভাষায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ অনেক আগেই জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তিনি নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও সংগঠনের কাজের সাথে যুক্ত করার দিকটি ভেবে দেখার আহ্বান জানান।

ব্র্যাকের জেন্ডার এ্যডভাইজার হাসনে আরা ডালিয়া বলেন  বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ৫০ বছরে যেমন তৃণমূলে হাজার হাজার সংগঠক তৈরি করেছে তেমনি নারী নেতৃত্ব তৈরিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। এটি সংগঠনের জন্য একটি বড় অর্জন। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন একটি সামগ্রিক এজেন্ডা, এটি বৈশ্বিক নারী আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে নারী আন্দোলন আদর্শগত কিছু চ্যালেঞ্জের ( ধর্মীয় কুসংস্কার, মৌলবাদ, রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নারীর  প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ) মুখে দাঁড়িয়ে আছে,  এগুলি মোকাবেলায় কাজ করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে  সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে নারী আন্দোলনের ধারা বহন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পথচলার শুরু। সংগঠন নেতৃত্ব দানে একটি ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথম ১০ বছরে  চেষ্টা করে নারীদের ঘরের বাইরে আনার জন্য, পরের দশকে নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে, এরপরের দশকে আইন সংস্কারের আন্দোলন করে। এই সব কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন  সংগঠকরা। পাশাপাশি তিনি আরো বলেন নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। এভাবে  ৫০ দশক ধরে সংগঠন এগিয়েছে।  সকল ক্ষেত্রে নারীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। তার আত্মশক্তির বিকাশ ঘটেছে। আমাদের সমাজ ও  রাষ্ট্র নারীর এই  উন্নয়নকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। সকল জায়গায়  নারীকে একটা মর্যাদাপূর্ণ আসনে আসীন করতে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

সভায় ঘোষণা পত্র পাঠ করেন গাইবান্ধা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রিক্তু প্রসাদ । তিনি বলেন, সমাজে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার  লক্ষ্য  নিয়ে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে গণনারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই  সংগঠনটি নারীর প্রতি চলমান বহুমাত্রিক সহিংসতা এবং সমাজের বৈষম্যদূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে  নানামুখী আন্দোলন পরিচালনা, নির্যাতনের শিকার নারীদের আইনি সহায়তা প্রদান কার্যক্রম, অসহায় আশ্রয়হীন নিরাপত্তাহীন নারীর জন্য আশ্রয় কেন্দ্র ‘রোকেয়া সদন’পরিচালনাসহ এ পর্যন্ত প্রনীত নারীর প্রতি সংবেদনশীল সকল আইনের খসড়া প্রনয়ণে, দাবি উত্থাপনে, সুপারিশ পেশ করার কাজে, সরকারের আইন প্রণয়ন কমিটির সক্রিয় সদস্য হিসেবে  উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বৈশ্বিক নারী আন্দোলনেরও সক্রিয় অংশীদার। নারী উন্নয়নের সাম্প্রতিক বৈশ্বিক চিন্তা চেতনা ও কর্মপ্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সংগঠন। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সংগঠন গ্রহণ করেছে নতুন কর্মকৌশল। সাম্প্রতিককালে কোভিড-১৯ মহামারিতে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের নারী ও কন্যারা ও দুর্ভোগের শিকার।বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে সংগঠন কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য গ্রহণ করেছে বহুমাত্রিক কর্মসূচি। সর্বোপরি কাউকে  পিছনে ফেলে নয়, একটি গণতান্ত্রিক সমতাপূর্ণ শান্তিপূর্ণ মানবিক বিশ্ব গড়ার জন্য সকলকে তিনি  সংগঠক কর্মী ও সাধারণ সদস্য, সরকার, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমসহ সকল স্তরের নারী সমাজের প্রতি একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।

এই অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেত্রীবৃন্দ, ঢাকা মহানগর কমিটির নেতৃবৃন্দ, জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ ,সাংবাদিক  এবং কর্মকর্তাসহ  ৬৫ জন উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠন সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/