শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি নুরুল হুদা

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা

আজ ৩০ সেপ্টেম্বর আমাদের জাতিসত্তার কবি নূরুল হুদার জন্মদিন। কবি হিসাবে দেশজুড়ে সমাদৃত হলেও একই সঙ্গে তিনি একজন ঔপন্যাসিক ও সাহিত্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধ শতাধিক। ১৯৮৮ সালে বাংলা কবিতায় উল্লেখযোগ্য অবাদনের জন্য তাকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ২০১৫ সালে একুশে পদক প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি আরও বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

কবি নূরুল হুদা জন্ম ১৯৪৯ সালের এই দিনে কক্সবাজার জেলার পূর্ব পোকখালি গ্রামে। তার প্রকৃত নাম মুহম্মদ নুরুল হুদা। বাড়ি থেকে প্রায় একমাইল দূরের পূর্ব পোকখালী প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হন ১৯৫৪ সালে। আগাগোড়া একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন আমাদের এই কবি। স্কুলে ক্লাসের প্রথম স্থান বরাবরই দখলে ছিল তার। ১৯৫৯ সালে পূর্ব পোকখালী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে মেধা-বৃত্তি লাভ করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে কক্সবাজারের ঈদগাহ হাইস্কুল থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক (বর্তমানে এসএসসি) পাস করেন। ওই পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে মেধার পরিচয় রেখেছিলেন তিনি। পরে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ করেন।

লেখাপড়া শেষ করার পর তিনি ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়া জেলার তালশহর কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর রাজধানী ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন নূরুল হুদা। তবে খুব বেশিদিন এখানে অধ্যাপনা করার সুযোগ হয়নি তার।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীতে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন মুহম্মদ নূরুল হুদা । ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত তিনি একাডেমীতে একটানা বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের আগষ্ট মাসে নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক পদে যোগদান করেন। কিন্তু এখানেও খুব বেশিদিন তিনি থাকেননি। ২০০২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আবারও বাংলা একাডেমীতে ফিরে আসেন। পরে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসাবে কবি নূরুল হুদা জার্মান, জাপান, আমেরিকা, হাওয়াই, লন্ডন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, বেইজিং, শ্রীলংকা, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন দেশ থেকে সম্মাননাও গ্রহণ করেন।

তিনি আর যে সব স্বীকৃতি ও সম্মাননা লাভ করেন তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮৮), যশোর সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), আলাওল পুরস্কার (১৯৮৩), কবি আহসান হাবীব কবিতা পুরস্কার (১৯৯৫), তুরস্কের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা লাভ (১৯৯৭), কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, সুকান্ত পুরস্কার (২০০৪), কক্সবাজার মেয়র কর্তৃক নগর চাবি প্রদান (২০০৯) ইত্যাদি।

ছাত্রজীবন থেকেই কবিতার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল কবি নূরুল হুদার। একেবারে প্রাইমারি স্কুলে পড়তেই কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। এক্ষেত্রে তার গ্রামের অতুলনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ আর প্রাইমারি স্কুলের এক শিক্ষক ছিলেন তার প্রেরণা। পরে ঢাকায় পড়তে আসার পর কবিতা পুরোপুরি গ্রাস করে নেয় তাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে সাহিত্য সম্পাদনার সাথেও জড়িয়ে পড়েন। সাহিত্য পত্রিকা ‘অধোরেখ’সংকলন সম্পাদনা করে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কবি নূরুল হুদা।

সোহরাওয়ার্দী কলেজে অধ্যাপনার সময়ে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ (১৯৭২)। শোণিতে সমুদ্রপাত-এর মাধ্যমে তিনি বোদ্ধাপাঠক ও সাহিত্যমোদিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর তিনি আর পেছনে তাকান নি। এগিয়েছেন সামনের দিকে, সমুদ্র, পাহাড় পর্বত ডিঙ্গিয়ে গেছেন। তার চলার গতি এখনো অব্যাহত। দু হাতে বিরতিহীনভাবে লিখে গেছেন-উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ এমনকি ছোটদের জন্যও লিখেছেন। পাশাপাশি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও সংগঠন হিসাবেও কাজ করেছেন।

তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে- জন্মজাতি,  মৈনপাহাড়, দেখা হলে একা হয়ে যাই, তুমি যদি জালদাস আমি জালদাসি, শুক্লা শাকুন্তালা, আমি একটি খাস প্রজাপাত্র চাই, শোভাযাত্রা দ্রাবিড়াভ প্রতি, মাটির নিচে কাট কয়লা হাজার বছর কাতর, আমরা তামাটে জাতি, বার বছরের গল্প, হুদা-কথা, আমিও রোহিঙ্গা শিশু, হাজার নদীর দেশ, কবিতার ভবিষ্যৎ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, কবিতার কৌশল, দুটি লাল পাখি ও সব্যসাচী উল্লেখযোগ্য।

তিনি মনে করেন- ‘কবিতায় যদি মানবিক সৌন্দর্য না থাকে তা হলে সেটা কবিতা হতে পারে না। শিল্প-সাহিত্যের যে কোন মাধ্যমই হোক না কেন তাকে মানবিক হতে হবে। যেটা আমাকে আমার মত বাঁচতে শিখায়। সেটা প্রেমও হতে পারে। আবার প্রেম শুধু ত্যাগ নয়, প্রেমকে ছিনিয়ে আনার মাঝেও সৌন্দর্য আছে।’

মূলত কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করলেও নিজেকে একজন লেখক হিসাবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন নূরুল হুদা। গত কয়েক বছর আগে এক সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন-‘ আমি কবিতা দিয়ে শুরু করেছি এটা যেমন সত্য কিন্তু শুধু কবিতাতে আছি এটা সত্য নয়। আমি কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখছি। আমার উপন্যাস আছে তিনটি এগুলোকে আত্মজৈবনিক বলা যেতে পারে। এছাড়া আরো একটি উপন্যাস আছে যেটি বিদেশি সাহিত্যের ছায়া অবলম্বনে লিখেছি। আরো উপন্যাস লেখার চিন্তা আছে।’

যদিও আমাদের কাছে তিনি কবি নূরুল হুদা হিসাবেই বেশি পরিচিত। আর নামের আগে ‘কবি’ শব্দটি ব্যবহার না করলে তার নামটি যেন অসম্পূর্ণ মনে হয়। এই বাস্তবতা জানেন বলেই হয়তো তিনি ওই সাক্ষাৎকারে আরও বলেছিলেন- ‘লেখক হিসাবে আমি কবি শুনতে বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি।’

সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সংগঠক হিসাবেও খ্যাতি রয়েছে তার। বাংলাদেশের লেখকদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি নূরুল হুদা। কাজ করছেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংগঠন পেন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবেও। এছাড়া বাংলাদেশের শীর্ষ কপিরাইট বিশেষজ্ঞ নূরুল হুদা জেনেভাস্থ আন্তর্জাতিক ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ওয়াইপো) কনসালট্যান্ট ও বাংলাদেশ কপিরাইট বোর্ডের সদস্য।

১৯৯৫ সালে তারই উদ্যোগে তরুণ লেখক প্রকল্প চালু করেছিল বাংলা একাডেমী। যেখানে সাহিত্যানুরাগী অনুর্ধ ৩০ বছর বয়সীদের ৬ মাস প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা ছিল এবং প্রশিক্ষণ শেষে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে এসব তরুণ কবি লেখকদের বই প্রকাশেরও ব্যবস্থা ছিল। যদিও খুব বেশিদিন এই প্রকল্প স্থায়ী হয়নি। তবে এখান থেকে এমন কিছু কবি ও সাহিত্যিক বের হয়েছেন যারা লেখালেখিতে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন।

আজ এই প্রথিতযশা কবির ৭২তম জন্মদিনে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি নূরুল হুদা।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/