প্রবীণরাই আলোর দিশারী

হোমায়রা হুমা

হোমায়রা হুমা

একটি পরিবারের প্রবীণদের ভূমিকা প্রশ্নাতীতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তারা অভিজ্ঞ, বিশ্বাসী, স্নেহময়ী অভিভাবক এবং অনুজদের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অথচ অধিকাংশ পরিবারে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মা-বাবাকে পারিবারের সদস্যরা পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করে। যেন বা তারা অচল, নির্জীব, প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া কোনো জড়বস্তু।

সত্যি কি তাই? প্রবীণদের থেকে নতুন প্রজন্ম দূরে চলে গেছে বলেই সামাজিক পরিস্থিতি আজ এত নিম্নগামী। আগে ছিল যৌথ পরিবার যেখানে বড়কে মান্য করা এবং তাদের আদেশ নির্দেশকে মেনে চলাই ছিল ভদ্রতার মূলসূত্র। পিতা-পিতামহ, মাতা-মাতামহ সকলের স্নেহলালিত্যে ছোটরা ধর্মীয় আখলাক ও নৈতিকতার সামাজিকীকরণের  মধ্যে লেহাজ ভদ্রতা দেশপ্রেম, ছোটবড়র মান্যতা, কন্যা ও নারীর প্রতি সহমর্মীতা ও সম্মান প্রদর্শন সর্বোপরি পরিবারের ঐতিহ্যকে সর্বগ্রে মূল্যায়ণ করতে শিখতো। দাদি নানির স্নেহের মিস্টতায় নাতিনাতিরা নীতিমান প্রজন্ম হিসেবে বয়োবৃদ্ধদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হতে বাধ্য ছিল।

সময়ের বিবর্তনে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, মুক্ত বাজার অর্থনীতির হিসেব নিকেশে মানুষ তার ঐতিহ্যের বসনবাসন বদলে নিয়ে হয়ে উঠেছে আধুনিক। এ সময়ের পরিবারগুলো যেন পরজীবি লতার মত নেতিয়ে পড়েছে। ফলে বিচ্ছেদ হলো প্রজন্ম, সৃষ্টি হলো নতুন সংস্কৃতি। একান্নবর্তী পরিবারে এলো নতুন ফার্নিচারের সাথে নতুন মতবাদ, ‘তোমাদের দিন গেছে/ তোমরা বুঝবা না/ তোমাদের উপদেশ এখন অচল’—নানান অবজ্ঞায় বয়স্ক ও প্রবীণদের আশ্রয় হলো আধুনিক ধারণায় গড়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রমে।

প্রবীণরা নিজ হাতে গড়া পরিবার ও সন্তানদের থেকে বিছিন্ন হয়ে ঘরের এককোণে অসহায় প্রাণিতে পরিণত হলেন। অথচ তাদের জন্য প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার, পরিচ্ছন্ন বিছানা, বিনোদন, নিশ্চিত চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পরিবারের সাথে কোয়ালিটি সময় যাপন করার সুযোগ। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কি সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছে? অবশ্য সরকার প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু করেছে। ঢাকা মহানগরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি প্রবীণ নিবাস ও হাসপাতাল আছে যা গোটা জনসংখ্যার এক তৃতিয়াংশ প্রবীণদের জন্য খুবই অপ্রতুল।

বর্তমানে কোভিক-১৯ সময় অতিবাহিত করছে। কি কঠিন অসুস্হতার সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ববাসী, যার অধিকাংশই প্রবীণদের জন্য ভয়াবহ। কোভিক-১৯’কে সামনে নিয়ে এবার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার  শিরোনাম এসেছে–‘বৈশ্বিক মহামারির নতুন বার্তা, প্রবীণদের সেবায় নতুন যাত্রা’। এ শ্লোগানের পথে এগিয়ে গেলে প্রবীণদের স্বাস্থ্যগত জরুরি সেবার জন্য প্রয়োজন-পালস অক্সিমিটার, ডিজিটাল প্রেসার মাপার যন্ত্র, অক্সিজেনের সহজ লভ্যতা, ফ্লু ও নিওমোনিয়ার টিকা, গিজার, শীতের পোশাক ও  শাল লেপ, নিরাপদ আবাসস্থল, আরো কত কি! যদিও জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, কোভিক-১৯ পৃথিবী জুড়ে বয়স্ক লোকদের মধ্যে ছড়াচ্ছে ভয়, ভীতি আর দূর্ভোগ। স্বাস্থ্য ঝুঁকির বাইরেও আছে দারিদ্র, বৈষম্য, নিঃসঙ্গতা, জীবন সঙ্গীর অভাব ইত্যাদি সংকট। তাই উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তার উদ্বেগ আরো বেশি।

এদিকে ২০২০ থেকে ২০৩০ এই এক দশক ধরে চলবে সুস্থ সজীব বার্ধক্য নিয়ে আন্দোলন।

আমাদের প্রবীনদের অবস্থাও অবাস্থানের কথা জাতিসংঘের মহাসচিব নিজেই ব্যক্ত করেছেন। এই কোভিক-১৯’য়ে প্রবীনদের মৃত্যু সংখ্যাই পরিসংখ্যানে বেশি দেখা গেছে। এভাবেই কি প্রবীণরা সব সামাজিক ও পারিবারিক দুর্যোগে বলিদান দিয়ে যাবেন তাদের স্বপ্ন,আকাংখা আর জীবন? এমনটি না চাইলে আমাদের নবীনদেরকেই নিতে হবে পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুগঠিত নীতিমালায় বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য উন্নত সম্মাণিত জীবনমান গঠনের বলিষ্ঠ ভূমিকা। কেননা প্রবীণরাই যে আমাদের আলোর দিশারী।

হোমায়রা হুমা: কবি ও মানবাধিকার কর্মী

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/