যতই ঘৃণা করুন, রমানন্দরাই কিন্তু সমাজের আলোকবর্তিকা

জীবিকার প্রয়োজনে একদিন মরদেহ দাহ করতে হবে এমনটা স্বপ্নেও ভাবেননি ৪৩ বছরের রামানন্দ সরকার। কিন্দু দেনার দায় আর অর্থের প্রয়োজনে শেষে তাকে এ পেশাতেই আসতে হয়েছে। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের এক প্রত্যন্ত এলাকায় তার গ্রাম। একসময় কিছু জমিজিরাত ছিল, সেখানে চাষবাসও হতো। এই চাষের জন্য ঋণ নিতে হলো  রামানন্দকে। কিন্তু ঋণ শোধ দিতে না পেরে গ্রাম ছাড়লেন।

রাজ্যের রাজধানী গৌহাটিতে গিয়ে শুরু করলেন আখের রস বিক্রি। কিন্তু এতে তেমন অর্থকড়ি নেই। শেষে গৌহাটির শ্মশানে মিললো কাছ, ধর্মীয় বিধানাদি মেনে শব দাহ করতে হবে। তো শুরু হলো মরা পোড়ানোর কাজ।গত দু বছর ধরে তিনি কতজনের যে মুখাগ্নি করেছেন তার হিসাব নাই। ভালোই চলছিল মরা পোড়ানোর কাজ। দু চারটে পয়সার মুখও দেখছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাস তাকে বিপদে ফেলেছে। এখন গ্রামে নিজের পরিবারের আপনজনদের সাথেও দেখা করতে যেতে পারেন না। লোকজন দেখলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়, গ্রামে ঢোকা তো দূরের কথা।

শুধু কি তাই, গৌহাটিতে যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়িওয়ালা একদিন বাড়ি থেকে বের করে দিলেন তাকে। কেননা তিনি মহামারিতে মৃতদের মরদেহ পোড়ান। ভারতে করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত এক লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে, আক্রান্ত হয়েছে ৬৪ লাখের বেশি।

রামানন্দ দীর্ঘদিন তার স্ত্রীর কাছে গোপন রেখেছিলেন নিজের পেশা। অবশেষে বাধ্য হয়ে এই সেদিন স্ত্রীকে জানিয়েছেন আসল ঘটনা। গত মে মাসের গোড়ার দিকে প্রতিদিনের মতো মরদেহ দাহ করছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, যে নারীর সৎকার করেছেন সে করোনায় মারা গেছে। যখন বিষয়টি জানাজানি হলো তখন ভয়াবহ সামাজিক অবমাননার মুখোমুখি হলেন রামানন্দ। কোথাও যেতে পারেন না, কারো সাথে কথা বলা যায় না। সবাই দূর দূর করে। যদিও ওই মরা পোড়ানোর পর নিয়ম মেনে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন বেশ কিছুদিন। কিন্তু তারপরও লোকজনের সন্দেহ যায় না। যেন তার গায়ে এখনও করোনার জীবণু লেগে আছে এবং তার সংস্পর্শে আসা মাত্রই তারা করোনায় আক্রান্ত হবে।

‘আমি জানি না কেন লোকজন আমাকে ঘৃণা করে। আমি মরা পোড়াই এজন্য? আমি যদি এ কাজটা না করি, তাহলে করবে কে?’ প্রশ্ন রামানন্দের।

আগে রামানন্দ ছিলেন একজন স্বোচ্ছাসেবী ডোম। এখন তাকে শশ্মানের বিশেষ ডোমের মর্যাদা দিয়েছে আসামের রাজ্য সরকার। কেননা তিনি যে এখন কেবল করোনায় মৃতদের মরদেহে আগুন দেন। এটা কি কোনও সাধারণ কাজ!তাই তো বিশেষ ডোম হিসাবে পদোন্নতি ঘটেছে রামানন্দের।

যথাযথ স্বাস্থ্য বিধি ও  রাজ্য সরকারের জাতীয় সুরক্ষা গাইডলাইন মেনেই এ কাজ করেন রামানন্দ। এসময় তার মুখে থাকে মাস্ক এবং আর ঠোঁটে থাকে মন্ত্র। তিনি সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিধান মতেই দেহ দাহ করেন, তা সেটা স্বাভাবিক  বা করোনায় আক্রান্ত মৃত্যু যেটাই হউক না কেন। দেহ পোড়ানোর সময় মৃতের স্রমেঙ্গে গুটিকয়েক স্বজনও থাকে। তবে তাদের গোটা শরীরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ। দায়সারা ধর্মীয় আচার পালনের মাধ্যমে কোনওরকমে দাহ শেষ হলেই তারা দ্রুত ছুটে পালায়।

আসামে করোনায় এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮১ হাজার ৬শ জন নিশ্চিত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর এ মারা গেছেন ৭১১ জন। এদের মধ্যে একাই সাড়ে ৪শ’র বেশি লাশ দাহ করেছেন  রামানন্দ। আগেই বলেছি এ কাজের জন্য তিনি ভয়াবহভাবে সমাজিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। একদিন মধ্যরাতে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে লুকিয়ে স্ত্রী আর সন্তানদের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে মাত্র ১৫ মিনিট তিনি তাদের সাথে কথা বলেন। এরপর স্ত্রীর  হাতে সংসার টাকা দিয়ে তিনি ফিরে আসেন।

ওই রাতে বাড়ি ফেরার পথে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে রাস্তায় এক মন্দিরে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু মন্দিরের পুরোহিত তাকে বের করে দেন। সামাজিক নিগৃহের কারণেই রামানন্দ সরকার চান না তার ছেলে ডোমের পেশায় আসুক। তারা স্কুলে যাবে লেখাপড়া শিখবে। ভালো মানুষ হবে এবং সমাজ সম্মান পাওয়া যায় এমন পেশা বেছে নিবে। এমনটাই ইচ্ছা তার। তার ভাষায় ‘তারা আমার মতো এমন পেশায় আসবে না যাকে অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে পরিবারের সাথে দেখা করতে হয়।’

তবে সমাজের এসব আচরণে একটুও ভেঙে পড়েননি রামানন্দ। তিনি ফের শ্মশানে ফিরে এসেছেন এবং করোনায় মৃতদের দাহ করার ব্যাপারে অটল রয়েছেন। যদিও এই কাজে তার নিজেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু তাতে তার কোনও ভ্রক্ষেপ নেই। তিনি যথেষ্ট সম্মানের সাথেই এসব মরদেহ সৎকারের কাজটা করেন। এ নিয়ে তার জোড়ালো উক্তি-‘ হতে পারে আমি একদিন কোভিড-১৯য়ে আক্রান্ত হয়ে মারা যাব। কিন্তু এতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি শেষ পর্যন্ত সততার সাথে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করে যাব।’

এরকম একজন দায়িত্ববান, সৎ মানুষকে সমাজে যারা মর্যাদা দেয় না, ডোম বলে ঘৃণা করে, তারা তো অন্ধ। তারা তো অনুভবই করতে পারছে না এই মহামারির সময় সদানন্দের মতো লোকেরা না থাকতো  কি পরিণতি হতো তাদের তথাকথিত এই সভ্য সমাজের? যে যাই বলুক এই রামানন্দ ডোম কিন্তু সমাজের আলোকবর্তিকা, মানবতার বাতিঘর। যুগ যুগ ধরে মানব সভ্যতা। টিকিয়ে রাখতে তাদের অবদানও কিন্তু কম নয়।

রামানন্দের পরিবার

সূত্র-গালফ নিউজ

অনুবাদ-মাহমুদা আকতার

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/