দেনমোহর কি শুধুই আর্থিক সংখ্যা? (শেষ পর্ব)

পাপিয়া সুলতানা পান্না

পাপিয়া সুলতানা পান্না

এবার দেনমোহর নিয়ে মূল প্রসঙ্গে আসি। তবে বলে রাখি, ইসলামি আইনের বিশদ বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। তাই সংক্ষিপ্তভাবেই উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বেঈলী বলেছেন, ‘দেনমোহর হল কিছু টাকা বা অন্য কোন সম্পত্তি, যা স্ত্রী স্বামীর নিকট হতে বিবাহ চুক্তির একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে পাওয়ার অধিকারী হয়।’

সাধারণত স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেনমোহর পরিশোধ করা হয় দু'টি কারণে। ১. ধর্মীয় অধিকার লাভ, ২. স্ত্রীর প্রতি একটি দায় বা কর্তব্য সম্পাদনের জন্য। তাই সাধারণ ভাষায় একে ' হক-ই-মহর ' বলা হয়।

পবিত্র কোরআনে স্ত্রীকে তার দেনমোহর পরিশোধের জন্য বার বার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং এও বলা হয়েছে স্ত্রী ক্রীতদাসী হলেও তাকে এই দেনমোহর প্রদান করতে হবে। যদি কেউ মনে করে দেনমোহর নিতান্ত একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক অর্থের পরিমাণ বা কতিপয় নির্দিষ্ট সম্পদ বা এটি স্ত্রীর মূল্যস্বরূপ তবে এটি হবে ভুল এবং স্ত্রীর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের নামান্তর। বিবাহ চুক্তি দ্বারা স্ত্রীকে খরিদ করা হয়ে না স্ত্রীর অধিকারকে পাকাপোক্ত করা হয়।

মুসলিম বিধান মতে দেনমোহর দু'রকমের হতে পারে। ১. নির্ধারিত ২. উপযুক্ত। বিয়ের আগে বা পরে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা হলে সেটি হয় নির্ধারিত আর নির্ধারণ করা না হলে স্ত্রীকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে দেনমোহর পরিশোধ করার জন্য যখন আইন মতে তা নির্ধারণ করা হয় তখনই সেটি হয় উপযুক্ত দেনমোহর। দেনমোহর বা মোহরানা পরিশোধ করা একটি বাধ্যতামূলক দায়। এজন্য লোক দেখানো বা আত্নম্ভরিতার জন্য এটি ধার্য করা উচিত নয়। দেনমোহরের পরিমাণ অবশ্যই অনুকূলে থাকা বাঞ্ছণীয়। কেননা এটি স্বামী কর্তৃক পরিশোধ করতেই হয় এবং ইসলামি বিধান মতে এমনও আছে যে, যদি দেনমোহর পরিশোধ না করে কোনো নর- নারী সঙ্গম বা সহবাস করে তবে তা বৈধ হবে না এবং এর ফলে তাদের যে সন্তানাদির জন্মে হবে তাও বৈধ হবে না। তবে বাস্তবিক আইনে এর শিথিলতা রয়েছে। স্ত্রী কর্তৃক মোহরানা বা তার অংশ স্বামী বা স্বামীর উত্তরাধিকারীদের অনুকূলে ছাড়া যায় এবং এক্ষেত্রে তা লিখিত দলিল দ্বারা ছাড়লে বৈধ হবে।

তবে তার জন্য স্ত্রীকে কোনোরূপ চাপ প্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। এটি সম্পূর্ণ স্ত্রীর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা। যদি কোন স্ত্রী তার মোহরানার দাবি উত্থাপন করেন এবং তা যদি পরিশোধ না করা হয় তবে স্ত্রী তার মোহরানা পরিশোধ না করা পর্যন্ত স্বামীর নিকট হতে দূরে থাকার অধিকারী হবেন এবং এ অবস্থায় স্বামী তাকে খেরপোষ পরিশোধে বাধ্য থাকবেন।  – ৯, ডি, এল, আর, ৮ একজন মুসলিম নারী বিধবা হয়েও তার অপরিশোধিত মোহরানার পরিবর্তে কোনোরূপ বল প্রয়োগ বা প্রতারণা ব্যতীত মৃত স্বামীর সম্পত্তির দখল লাভ করতে পারে। মোহরানার পরিবর্তে স্বামীর সম্পত্তির দখলে রাখার অধিকার সর্ব প্রথম শুরু হয় স্বামীর মৃত্যুতে বা তালাক দ্বারা বিবাহ ভঙ্গ হলে ( এ. আই. আর ১৯৪০, কলকাতা) ।

একজন বিধবা স্ত্রী তার দেনমোহরের পরিবর্তে স্বামীর সম্পত্তি থেকে কি পরিমাণ অংশ পাবেন তারও নির্দিষ্ট হিসাব আছে এবং দখলকৃত সম্পদ বিক্রয়, বন্ধক বা হস্তান্তরেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ৫ ধারায় পারিবারিক আদালতকে মোহরানার জন্য মোকদ্দমার বিচারের নিরঙ্কুশ এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে ( ১৯৭০ ডি, এল, ডি, ৫৬০)। একইভাবে মোহরানা আদায়ের মোকদ্দমা যে স্থানে স্ত্রী বাস করেন সেই স্থানে দায়ের করিলে চলবে ( ২২, ডি – এল- আর, ৬৭৭) বলেও আইনে বিধান রয়েছে। মোহরানা বা দেনমোহর আদায়ের জন্য তামাদির মেয়াদ হল তিন বছর। যেদিন দেনমোহর দাবি করা এবং তা অস্বীকৃত হয় সেদিন হতে তামাদির সময় শুরু হয়। তবে এর প্রেক্ষাপটে ভিন্নতা থাকতে পারে। মোটকথা দেনমোহর মুসলিম 'শরিয়াহ আইনমতে স্বামীর থেকে স্ত্রীর একটি ন্যায়সঙ্গত পাওনা যা পরিশোধে স্বামী বাধ্য থাকেন।

স্ত্রী সহবাসের পূর্বেই এটি পরিশোধ করা উত্তম এবং সেটি সম্ভব না হলে স্বামী জীবদ্দশায় তা পরিশোধ করবে। কেননা বাস্তবতা ভিন্ন। বর্তমান সময়ে দাম্পত্য কলহ, তালাক, পারিবারিক বিভিন্ন সহিংসতার মূলেও এই মোহরানার অনাদায় অনেকাংশে দায়ী। আর প্রয়োগক্ষেত্রে অতি তিক্ত হলেও সত্য যে, সুশীল মুসলিম সমাজের অনেকেই দেনমোহরের কথা বলেন কিন্তু পরিশোধ করেন না। নারী বা পুরুষ উভয়েরই উচিত পরিশোধ করা সহজ হবে এমন পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ দেনমোহরের জন্য নির্ধারণ করা। যদি ইসলাম ধর্ম মানতেই হয় তবে লোক দেখানোর জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা বা বিশাল সম্পদ দেনমোহর হিসেবে নির্ধারণ না করে সুষ্ঠু বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য অনুকূল্য পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ দেনমোহর হিসেবে নির্ধারণ করা যৌক্তিক।

অনেকে মনে করেন দেনমোহরের পরিমাণ বেশি নির্ধারিত হলে সমাজে মর্যাদা বাড়বে বা স্বামী তালাক দিতে ভয় পাবে – এটি ভাবা ঠিক না। কেননা সম্পদ নয়, পারিবারিক সুষ্ঠুতায় দরকার স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সমঝোতা, বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে উভয়ের স্পষ্ট ধারণা। মুখে ইসলামের কথা বলে ফেনা তুলে লাভ নেই যদি তা বাস্তবে প্রয়োগ না করা যায়। তাই দেনমোহরকে কেবল একটি অর্থের পরিমাণ না ভেবে ধর্মীয় ‘শরীয়াহ’ মোতাবেক তা নির্ধারণ ও পরিশোধ করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

পাপিয়া সুলতানা পান্না: কবি ও লেখক।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/