শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব সলিল চৌধুরী

আজ ১৯ নভেম্বর, উপমহাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব সলিল চৌধুরীর জন্মদিন। তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন সঙ্গীতের নানা শাখায়। পাশাপাশি কবি ও গল্পকার হিসেবেও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছেও ছিলেন সমানভাবে সমাদৃত। ভারতের তার গুণগ্রাহীদের কাছে তিনি সলিলদা বলেই পরিচিত।

প্রাথমিক জীবন

১৯২৫ সালের  ১৯ নভেম্বর ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের গাজিপুরে এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সলিল চৌধুরী। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী আসামের লতাবাড়ি চা বাগানে ডাক্তারি করতেন। ফলে শৈশবের বেশির ভাগ সময় কেটেছে আসামের চা বাগানে। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

শৈশবে বাবার কাছেই সলিল চৌধুরীর সঙ্গীতের হাতেখড়ি। ছোটবেলা থেকেই তিনি তার বাবার সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনে বিশ্ব সঙ্গীতের ধারণা পোক্ত হয়। পাশাপাশি চা বাগানের কুলি এবং স্বল্প বেতনের কর্মচারীদের সাথে মঞ্চ নাটকের জন্য ছিলেন সুপরিচিত। বাবা ছাড়াও চাচাতো ভাই নিখিল চৌধুরীর কাছেও সংগীতের তালিম গ্রহণ করেন তিনি। মূলত নিখিল চৌধুরীর ঐক্যবাদন দল 'মিলন পরিষদ'-এর মাধ্যমেই গানের জগতে প্রবেশ তার।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুভাষগ্রামে মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন তিনি। হারিনাভি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং উচ্চ মাধ্যমিক (আইএসসি) পাশ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। বঙ্গবাসী কলেজে স্নাতক পড়ার সময়েই সঙ্গীত জ্ঞানে পরিপক্কতা লাভের পাশাপাশি দ্রুত তার রাজনৈতিক ধারণা জন্মায় সলিলের মধ্যে।

গণসঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী

সলিল চৌধুরীল সঙ্গীত জগতে আগমন গণসঙ্গীতের মাধ্যমে। ১৯৪৪ সালে যখন তরুণ সলিল যখন স্নাতক পড়ার জন্য কলকাতায় আসেন তখনই যোগ দেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ-এ (Indian Peoples Theater Association)। এ সময় তিনি প্রচুর গণসঙ্গীত রচনা এবং সুর করেন। আইপিটিএ’র সাংস্কৃতিক দলটি বিভিন্ন শহর এবং গ্রামগঞ্জে ভ্রমণ করতে থাকে, যা তার রচিত গানগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে। তার সুরারোপিত বিচারপতি, রানার এবং অবাক পৃথিবীর মত গানগুলো তখন সাধারণ জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

বলা হয়ে থাকে বাংলা গানে নতুন দিগন্ত নিয়ে এসেছিল তার গণসঙ্গীত! তিনি ছিলেন সুরের জাদুকর। পঞ্চাশের মন্বন্তরে সলিল সৃষ্টি করলেন ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে’, ‘পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ও আলোর পথযাত্রী এ যে রাত্রী এখানে থেমো না, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’র মতো সঙ্গীত। তবে তার সবচেয়ে আলোচিত গণসঙ্গীত গাঁয়ের বধু যা তখন বাংলা সঙ্গীতে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছিল। মাত্র ২০ বছর বয়সে এই গানে সুর করেছিলেন সলিল। এই গান রচনা নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে।

চল্লিশের দশকের কথা। একদিন নতুন কয়েকটি গণসংগীত নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি গেলেন। গানগুলো শুনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জানালেন, এসব রাজনৈতিক গান তো আর রেকর্ড করা যাবে না বরং অন্য গান শোনাও। কিছুটা মন খারাপ করে ফিরে আসছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়লো একটা কবিতার কথা। আবার ফিরে এলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। গিয়ে কবিতার খাতা খুলে অর্ধেক লেখা কবিতাটা সুর করে শোনালেন।

শুনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘আমি সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম এ এক আশ্চর্য কীর্তি।’ এভাবেই নজরুল- রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলার সেরা সঙ্গীত ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’র  জন্ম ।  বাসায় ফিরে শেষ করলেন ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’গানের বাকি অংশ। এই গান বের হলো পুজোতে এবং তৈরি করলো বাংলা সঙ্গীতের নতুন ইতিহাস।

চলচ্চিত্রে সলিল চৌধুরী

তার প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘পরিবর্তন’ মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে। তার ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল ‘মহাভারতী’যা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। ১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত দো ভিঘা জামিন চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বলিউডের চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে  সলিল চৌধুরীর। এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল সলিল চৌধুরীর ছোট গল্প ‘রিকসাওয়ালা’অবলম্বনে। এই চলচ্চিত্রটি তার কর্মজীবনকে নতুন মাত্রা যোগ করে যখন এটি প্রথমে ফিল্মফেয়ার সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়।

বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে ২০ বছর কাজ করার পরে সলিল ১৯৬৪ সালে চিম্মিন দিয়ে মালয়ালাম চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। তবে মালায়াম চলচ্চিত্রে তিনি সফল হননি,  তবে তার মালয়ালাম গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

তিনি প্রায় ৭৫টির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৪০টির বেশি বাংলা চলচ্চিত্র, প্রায় ২৬টি মালয়ালাম চলচ্চিত্র এবং বেশ কিছু মারাঠী, তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসামীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

সুরকার ও গীতিকার সলিল চৌধুরী

বহু গান নিজে লিখেছেন ও সুর করেছেন সলিল চৌধুরী। তিনি বহু বিখ্যাত গান তৎক্ষণাৎ বসে লিখেছেন। শোনা যায় একবার কোনও বন্ধুর সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছেন। তখন বন্ধু তাকে পরীক্ষা করার জন্য বললেন একটা গান লিখে দিতে। তখন ওই হোটেলের মেনুকার্ডের বিভিন্ন শব্দের অধ্যাক্ষর নিয়ে তৈরি করেন বিখ্যাত ‘পা মা গা রে সা তার চোখের জটিল ভাষা’। বলা বাহুল্য এই গানটিতেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন তার প্রিয় শিল্পী লতা মঙ্গেশকর।

অনেকে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের পর যদি ভার্সেটাইল কোন গুণী মানুষ এসে থাকেন, তবে তার নাম সলিল চৌধুরী। সলিলে মুগ্ধ মান্না দে তার সম্পর্কে একবার বলছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পরে এমন সংগীত স্রষ্টা আর আসেননি। অত্যন্ত শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র এবং সংগীতমনস্ক মানুষ এই সলিল চৌধুরী। সহজাত সুরের সূক্ষ্ম জ্ঞান ছাড়াও অত্যন্ত শক্তিশালী ওর লেখার হাত। সুরকার এবং সংগীত পরিচালক হিসেবে সলিল বাবুর স্থান ছিলো একেবারে আলাদা। অসাধারণ সব সুরের সঙ্গে ওর অনন্য সুরের অর্কেস্ট্রেশন এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতো ওর সকল সৃষ্টিকে। সলিল চৌধুরীর স্থান কেউ কোনোদিন পূরণ করতে পারবে না।’

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও পাশ্চাত্যের আধুনিক সঙ্গীতের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করে সৃষ্টি করেছেন দারুণ সব সুর ও কম্পোজিশন যা এ যুগেও সমান জনপ্রিয়। তিনি যেমন দক্ষ ছিলেন ভারতীয় রাগ সঙ্গীতে তেমনিভাবে আত্মস্থ করেছিলেন মোজার্ট ও বেটেফিনের সিম্ফনি। সেইসঙ্গে বিশ্বের নানা দেশের লোকসঙ্গীত ইম্প্রোভাইচড করে কম্পোজিশন করাকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া বাঁশি, পিয়ানো, এসরাজসহ নানা বিভিন্ন বাদ্যন্ত্রের ওপর ছিল তার সমান দখল।  

শুধু বঙ্গদেশ নয়- কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত মজেছে তার গানে ও সুরে। তিনি দক্ষিণ ভারতেও ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। একবার সলিল চৌধুরী সপরিবারে দক্ষিণ ভারতে গেলেন বেড়াতে। হঠাৎ এক নারী এসে সলিল চৌধুরীর স্ত্রী সবিতা চৌধুরীর হাত ধরে বললেন, ‘খুব সাবধানে আর যত্নে রাখবেন সলিল বাবুকে। কারণ উনার হাতে আমাদের গোটা সভ্যতার সুর রয়েছে। উনার সুরে আমরা বাঁচি, আমরা হাসি, আমরা কাঁদি।’

যেমন সুর করেছেন রোমান্টিক আর বিরহের গানে তেমনি বলিউডের মশলা গানও করেছেন বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। সব গানেই রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। তার সুরারোপিত আখে সিধি লাগে দিল পে য্যয়সে কাটারিয়া ও সাবারিয়া, চিল চিল কাওয়া কো গাজরি শুনায়, আখো মে তুম দিল মে তুম কিংবা ধাইয়ারে ধাইয়ারে চড়গায়ে পাপি পিছুয়ার মতো চটুল গানগুলো এখনও সমান জনপ্রিয়।

তার সুরে গায়নি ওই সময়ে এমন একজন বিখ্যাত শিল্পী পাওয়া দুষ্কর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার, মুকেশ, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সহধর্মিণী সবিতা চৌধুরী, কন্যা অন্তরা চৌধুরী, হৈমন্তী শুক্লা, অনুপ ঘোষাল, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য, সুবীর সেন, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, সুলক্ষণা পণ্ডিত, অমিত কুমার, রানু মুখোপাধ্যায়, অরুন্ধতী হোম চৌধুরী, উৎপলা সেন, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, ঊষা মঙ্গেশকর, নির্মলেন্দু চৌধুরী, নায়ক বিশ্বজিৎ (যায় যায় দিন গান গেয়ে পরিচিতি পান), দীলিপ কুমার (বলিউডের বিখ্যাত এই অভিনেতাও এক সিনেমায় তার সুরে গেয়েছিলেন)  ঊষা উত্থুপ; এমনকি সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন এবং কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত।

তার বিখ্যাত কিছু হিন্দি গান-সুহানা সফর অর ভি মওসুম হাসিন, কাহি দুর যাব দিন ঢাল যায়ে, জাগো মোহন পেয়ারে জাগো, দিল তাড়াপ তাড়াপ কে কেহরাহা হে, জিন্দেগি ক্যায়ছি হ্যায় পেহেলি হ্যায়/ কাভি তু হাসায়ে কাভি এ রুলায়ে, না জিয়া লাগে না, তাসভির তেরি দিল মে চিজ দিলছে উতারি, আজা রে পরদেশি, ঘারি ঘারি দিল মে, অ্যায় মেরে পেয়ারি ওয়াতন-অ্যায় মেরে বিছরে চমন, রজনীগন্ধা ফুল তুমহারি, ধাইয়া রে ধাইয়ারে চড়গায়ি পাপি বিছুয়া, দো আখিয়া ঝুকি ঝুকি থি, আহা রিমঝিম কে ইয়ে পেয়ারে পেয়ারে গীত।

বিখ্যাত বাংলা গান-আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুব তারা, আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা, ওগো আর কিছু তো নাই, না মনও লাগে না, যদি কিছু আমারে শুধাও, ও ঝরঝর ঝর্ণা ও রূপালি বর্ণা, ও মোর ময়না গো, না যেও না রজনী এখনও বাকি, সাত ভাই চম্পা জাগো রে, কেন কিছু কথা বলো না, ধিতাং ধিতাং বোলে এই মাদলে তান তোলে, বাজে গো বীণা, বুঝবে না কেউ বুঝবে না কি যে মনের ব্যাথা, ইচ্ছা করে ও পরানডারে গামছা দিয়া বান্ধি, হঠাৎ ভীষণ ভালো লাগছে, যদি নাম ধরে তারে ডাকি।

সলিল চৌধুরী ও লতা মঙ্গেশকর

ভারতের বিখ্যাত সব কণ্ঠশিল্পীরা সলিল চৌধুরীর কম্পোজিশনে গাইলেও লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল এক অসাধারণ মেলবন্ধন। যে কারণে এই বিখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের বেশিরভাগ জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পী লতা। সারা ভারতের সুরকাররা যখন অপেক্ষায় থাকতেন জনপ্রিয় শিল্পী লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে তাদের গান গাওয়ানোর জন্য, তখন লতাজি উৎসুক থাকতেন এই মানুষটির সাথে কাজ করার জন্য। লতাকে ভেবেই তিনি অনেক গান লিখেছেন ও সুর করেছেন। লতা প্রথমবারের মতো বাংলা গান গাইলেন সেটিও সলিলের কম্পোজিশনে-না যেও না রজনী এখনও বাকি। সেসময় এই গান এতটাই জনপ্রিয় হয় যে পরবর্তীতে এই সুরে লতাকে দিয়ে আরেকটি হিন্দি গান হওয়ান সলিল চৌধুরী-না মন লাগে না। সেটিও সমান জনপ্রিয় হয়েছিল।

সলিল চৌধুরীর স্ত্রী সবিতা চৌধুরীও ভালো গান গাইতেন। একবার তিনি একটি সুর করলেন যা তার স্ত্রীর খুব পছন্দ হলো। তখন তিনি সলিল চৌধুরীর কাছে বয়না ধরলেন গানটি তিনি গাইবেন। কিন্তু সলিল এতে রাজি হননি। পরে লতাকে দিয়েই গাওয়ালেন সেই গানটি যা এখনও তুমুল জনপ্রিয়। সেই গান হচ্ছে -ও মোর ময়না গো/ কার কারণে তুমি একেলা। জানা যায় রুশ লোকসঙ্গীতের সুরে করা হয়েছিল এই গানটি।

সলিল চৌধুরী সম্পর্কে লতা বলেন- ‘সলিল চৌধুরীর ছিল নিজস্ব স্টাইল। তার কম্পোজিশন শুনলে মনে হতো খুব সোজা কিন্তু গাইতে গেলে বোঝা যেত কত কঠিন! রাগসঙ্গীত বা লোক সঙ্গীত যে সুরই হউক না কেন সবকিছুতে থাকতো তার নিজস্ব স্টাইল। যে কেউ শুনেই বুঝতে পারতো এটা সলিলের সুরারোপিত গান।’

লতার গাওয়া বেশিরভাগ বাংলা গানেরই সুর করেছেন সলিল চৌধুরী। এগুলোর মধ্যে না যেও না, অন্তবিহীন কাটে না বিরহের দিন, বুঝবে না তুমি বুঝবে না, না মনও লাগে না, কেন কিছু কথা বলো না, যারে যারে উড়ে যারে পাখি, সাত ভাই চম্পা জাগো রে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সাহিত্যিক সলিল চৌধুরী

কেবল গান লেখা বা সুর করা নয়, কবিতা ও গল্প লেখারও নেশা ছিল সলিল চৌধুরীর। এসব গল্প ও কবিতা বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা যায়। এছাড়া কিছু প্রবন্ধও লিখেছেন তিনি। তবে সাহিত্যে থিতু না হয়ে তিনি সঙ্গীত সাধনাতেই বেশি মগ্ন থেকেছেন। তার প্রান্তরের গান এবং সলিল চৌধুরীর গান নামে দুৃটি গ্রন্থের কথা জানা যায়। তবে কবিতা বা অন্যান্য লেখা নিয়ে তার জীবদ্দশায় কোনও বই বেরিয়েছে কিনা জানা যায়নি।

তিনি কি শুধু সাহিত্য করবেন, নাকি গান নিয়ে থাকবেন- প্রথমদিকে এ নিয়ে দ্বিধাহীন ছিলেন সলিল। এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি জানি না, কোনটা নিয়ে চলবো- কবিতা, গল্প লেখা, অর্কেস্ট্রেশন, না ফিল্মের গান কম্পোজ করা। ক্রিয়েটিভিটি নিয়েই আমার কাজ। যখন যেটা সেই মুহূর্তটায় বা আমার মানসিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খায়, সেটা নিয়ে কাজ করি।’

এই প্রতিভার হয়নি যথাযথ মূল্যায়ন

ভারতের বিখ্যাত এই সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব তার প্রতিভার যোগ্য স্বীকৃতি পাননি। রাজ্য কিংবা রাষ্ট্রীয় এই দুই পর্যায়েই অবহেলার শিকার হয়েছেন সলিল চৌধুরী। যে কারণে কোনও জাতীয় পুরস্কার পাননি। মধুমতি ছবির জন্য ১৯৫৮ সালে পেয়েছিলেন সেরা সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। এটাই তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এছাড়া ১৯৮৮ সালে পান সঙ্গীত নাটক একাডেমী।

যদিও এইসব স্বীকৃতি নিয়ে তার কোনও আক্ষেপ ছিল না। পুরস্কার বা স্বীকৃতি না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমার কোনো খেদ নেই জানো। গান আমাকে বিশ্বজুড়ে ভালোবাসা পাইয়ে দিয়েছে। কতো কিছুই তো পাইনি জীবনে। শেষে সব ভুলে যাই যখন কেউ আমার গান শুনে বলে আপনি চোখে জল এনেছেন। আমি কোথাকার কে ভাই, ঈশ্বরের যিনি বরপুত্র, সেই মোজার্ট সারা জীবনে কী পেয়েছিলেন- বঞ্চনা, বঞ্চনা আর বঞ্চনা।’

ব্যক্তিগত জীবন

সলিল চৌধুরী প্রথম স্ত্রীর নাম জ্যোতি চৌধুরী এবং এই সংসারে তুলিকা, অলোকা ও লিপ্তিকা নামে তিন মেয়ে। পরে তিনি গায়িকা সবিতা চৌধুরীকে বিয়ে করেছিলেন। সবিতা চৌধুরী এতটাই ভালো গাইতেন যে, সেসময় তার গান ছাড়া কোনও সঙ্গীতানুষ্ঠান সম্পূর্ণ হতো না। যদিও ধরতে গেলে তাকে নিজ হাতে গড়ে পিঠে নিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। শুধু গান নয়- তিনি বাংলা ভাষা এমনকি রান্নাও শিখেছিলেন স্বামীর কাছে। হ্যা, শুধু সুর বা গান রচনা নয়- দারুণ ছিল রান্নার হাত ছিল সলিল চৌধুরীর।

এ সম্পর্কে সবিতা চৌধুরী আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ‘হাতে ধরে আমাকে যেমন গান শিখিয়েছেন, তেমন যত্ন নিয়েই শিখিয়েছিলেন রান্নাও। আমি তার কাছে কী না শিখেছি! রাঁধতে রাঁধতেই সুর ভাজতেন। সুর মাথায় এলে ঢ়ুকে পড়তেন বাথরুমে। সে অনেক ক্ষণ! আর তখনই জানতাম, বেরিয়েই  পিয়ানোর সামনে বসে পড়বেন। সুরটা এসে গিয়েছে মনে। জিনিয়াস নয়, আমার স্বামী ছিলেন তারও বেশি কিছু।’

সলিল-সবিতা দম্পতির চার ছেলেমেয়ের নাম সঞ্চারী, সঞ্জয়, অন্তরা ও ববি। এদের মধ্যে অন্তরা সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে খ্যাতি পেয়েছেন। বাবা সলিল চৌধুরী বেঁচে থাকতেই তিনি শিশুশিল্পী হিসাবে একাধিক চলচ্চিত্রে গান গেয়েছিলেন। তার সঙ্গীতে হাতেখড়ি বাবা সলিল চৌধুরীর কাছেই।

সলিল চৌধুরীর সঙ্গীতের দীর্ঘ যাত্রাপথ থেমে যায় ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, ৭০ বছর বয়সে। তার সঙ্গীতের ভূবনটিকে বর্ণনা করা করা যায় তারই গাওয়া গানের অন্তরা দিয়ে- ‘এই রোখো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও আমি নেমে যাব/ আমার টিকেট কাটা অনেক দূরের..আমি অন্য গাড়ি নেব।’

দ্বিতীয় স্ত্রী সবিতার সঙ্গে সলিল চৌধুরী

আজ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষটির ৯৬তম জন্মদিনে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে রইলো অনেক শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব সলিল চৌধুরী।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/