অবরুদ্ধ সমাজে মানুষের নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ কমে আসছে: লেখক ডাঙ্গারেম্বগা

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক সিৎসি ডাঙ্গারেম্বগা

দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শিল্প সাহিত্যের জগতে যে বিতর্ক বিরাজমান সেটি হচ্ছে-মানুষের জন্য শিল্প, না শিল্পের জন্য মানুষ। আধুনিক যুগে লেখালেখি ও শিল্প চর্চার সাথে সম্পর্কিত অনেকেই মনে করেন-‘মানুষের জন্য শিল্প’এই কথাটি এখন অচল। বরং শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে এর গুণগত মানের দিকেই সবার  লক্ষ্য রাখা উচিত। তাই বুঝি কেউ কেউ আজকাল সাহিত্য রচনায় গল্পের চেয়ে ফর্মের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু যতই শিল্পমানের কথা বলি না কেন-একজন সাহিত্যিক কিংবা শিল্পীর পক্ষে তার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা অগ্রাহ্য করা সবসময় সম্ভব হয় না। তাই বুঝি একজন সাহিত্যিককে বারবার মানুষের কাছেই ফিরে আসতে হয়। সমাজে চলমান নানান অসঙ্গতি, অনাচার; জনসাধারণের নানা ভোগান্তি সর্বোপরি শাসক গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও লোভ-লালসার মতো বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যেতে পারেন না একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। কোনও না কোনও সময় তাকে রুখে দাঁড়াতে হয়, কলম ধরতে হয় সকল মস্ত অপশক্তির বিরুদ্ধে।

এ সময়ের আলোচিত সাহিত্যিক সিৎসি ডাঙ্গারেম্বগার কথাই যদি বলি, যিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘নার্ভাস কন্ডিশনস’ লিখেই বিশ্বজুড়ে সুনাম অর্জন করেছেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি ‘বিশ্বকে বদলে দেয়া’ ১০০টি বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এরপর তিনি এই সিরিজের আরও দুটি বই প্রকাশ করেছেন।  চলতি বছর ট্রিলজির সর্বশেষ বই ‘দ্য মোর্নঅ্যাবল বডি’ প্রকাশ করেছেন জিম্বাবুয়ের এই উপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও মানবাধিকার কর্মী। নার্ভাস কন্ডিশনস ট্রিলজির তৃতীয় বইটি  ইতিমধ্যে মর্যাদাপূর্ণ বুকার পুরস্কারের জন্য প্রাথমিকভাবে বিবেচিত হয়েছে।

ট্রিলজির দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য বুক অফ নট’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। এই তিনটি বইয়ে জিম্বাবুয়ের রাজনৈতিক অসুস্থতার কথা তুলে ধরেছেন লেখক ডাঙ্গারেম্বগা।

১৯৫৯ সালে জন্ম নেয়া ডাঙ্গারেম্বগা হচ্ছেন জিম্বাবুয়ের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী যিনি ইংরেজিতে উপন্যাস লিখছেন। আর কেবল উপন্যাসের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেই ক্ষান্ত হননি ডাঙ্গারেম্বগার, সোচ্চার হয়েছেন শাসক গোষ্ঠীর নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে। গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে অংশ নিয়েছেন দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে। এরকমই এক বিক্ষোভে অংশ নেয়ার সময় গত ৩১ জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা তার বিরুদ্ধে সহিংসতা ছড়ানোর অভিযোগও দায়ের করেছিল। যদিও দিন কয়েক পরেই জামিনে ছাড়া পান তিনি। তবে হাজত থেকে মুক্তি পেলেও আইনি জটিলতা থেকে মুক্তি মেলেনি তার। প্রতি মাসে নিয়ম করে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। আগামী ২৪ নভেম্বর হাজিরা দিতে ফের আদালতে যাওয়ার কথা রয়েছে তার। এর আগে তিনি কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার সঙ্গে একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দেন, যেখানে তিনি নিজের লেখালেখি, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও জিম্বাবুয়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন।

আল জাজিরা: আপনার ট্রিলজি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তাম্বুজাই সিগাউক ওরফে তাম্বু। তার চোখ দিয়ে জিম্বাবুয়ের ইতিহাস তুলে ধরেছেন আপনি, আপনার অভিপ্রায় কি ছিল?

ডাঙ্গারেম্বগার: এই বইগুলিতে জিম্বাবুয়েতে বসবাসকারী একজন সাধারণ নারীর জীবনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে গোটা দেশের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি এবং এর পরিবর্তনের ফলে তার জীবনে যে প্রভাব পড়েছে, সেগুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।

আমার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের কাছে এমন একটি চরিত্র উপস্থাপন করা যার মাধ্যমে জিম্বাবুয়ের একজন নাগরিকের প্রকৃত পরিচয় ফুটে ওঠে। উপন্যাসের চরিত্র ও জিম্বাবুয়ের মধ্যে এই আন্তঃসংযোগটা অনিবার্য ছিল।

জিম্বাবুয়ের রাজনৈতিক গতিপথ অত্যন্ত নেতিবাচক। এটা এতোটাই নেতিবাচক যে কোনওভাবেই আপনাকে কোনও ছাড় দেয়া হবে না। বিষয়টা অনেকটা এরকম যে, সবগুলো মানুষকে ঠেলতে ঠেলতে একটা সরু ট্যানেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই পথটি যদি ইতিবাচক হতো তাহলে এসব নিয়ে আমি অনেক চরিত্র আর অনেক গল্প তৈরি করতে পারতাম। কিন্তু সবকিছু যেহেতু ভেঙে পড়ছে এবং প্রত্যেকেই একরকম বা অন্যভাবে বাঁচতে লড়াই করছে, তাই এভাবেই আমাকে গল্পটা বলতে হয়েছে।

আমি মনে করি প্রতিটি লেখকেরই তারা কেন লিখছেন তা বেছে নেয়ার অধিকার আছে। আমি মনে করি রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তি থেকে শুরু মানব সমাজের সবার কল্যাণ সাধন করা। কিন্তু বাস্তবে সেটি হচ্ছে না। এটি সর্বসাধারণের সমাজ ও মানুষের অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করছে না। প্রকৃতপক্ষে মানুষ ও তাদের জীবন সম্পর্কে অর্থপূর্ণ কিছু বলা আমার কাছে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলে আমি মনে করি না যে, সবাই এভাবেই তাদের পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাবে। তাই সব লেখকদেরকেও অবদান রাখতে হবে। এমনকি আপনি যদি কেবল কল্পনা কাহিনীও রচনা করেন তাহলেও আপনাকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে।  

একজন নারীর চোখ দিয়ে জিম্বাবুয়ের গল্পটি বলা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল কোনও নারীর নির্দিষ্ট পরিবেশে পা রাখার গল্পটি বলা এবং সেই নির্দিষ্ট পরিবেশটি ছিল জিম্বাবুয়ে এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সমাজের বৈশিষ্ট্যের কারণেই তার সুযোগগুলো কীভাবে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। জিম্বাবুয়ের সমাজ তো তাকে কোনও সুযোগ দিচ্ছে না। বরং তার সুযোগগুলো ক্রমশঃ সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে। এবং সে কারণেই উপন্যাসের শেষে জিম্বাবুয়ের ইতিহাস আর এতে বর্ণিত গল্পটি সমান্তরালভাবে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু জিম্বাবুয়ে যদি জার্মানির মতো হত, তাহলে আপনি অনেকগুলো ভিন্ন গল্প সাজাতে পারতেন। কিন্তু জিম্বুয়ের প্রাত্যহিক জীবন তো দমন ও দারিদ্র্যের দ্বারা নির্ধারিত, এখানে তো আলাদা কিছু ঘটে না। এটাই জিম্বাবুয়ের নাগরিকদের ট্র্যাজেডি। এই অবরুদ্ধ সমাজের মানুষগুলো বিরাট চাপের মধ্যে আছে এবং দিনে দিনে তাদের সুযোগগুলো আরও কমে আসছে।

আল জাজিরা: আপনি কি মনে করেন সামাজিক অবস্থায় মানুষ কেবল দৈহিকভাবে নয়, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও চাপের মধ্যে রয়েছে?

ডাঙ্গারেম্বগা: অবশ্যই।  কেননা এইসব বাস্তবতা তো আপনাকে মানসিকভাবেও কোনও ছাড় দিচ্ছে না। আপনি যদি সকালে উঠে দেখেন পানি নাই তাহলে তো আপনি অবশ্যই চিন্তা করবেন, আমি কি পানি পাব?  আপনি এমন এক শহরে বাস করছেন যেখানে আপনাকে পানির জন্য কাউন্সিলের বানানো রাস্তার কলে গিয়ে লাইন ধরতে হয়। এটা তো রোজকার ব্যাপার এবং এই পরিস্থিতি আপনার জীবনে অবশ্যই প্রভাব ফেলতে বাধ্য।

আমাদের রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারেন না যে তাদের ভূমিকা মানুষের জীবনকে জটিল আর অসম্ভব করে তোলা নয়।  যতটা সম্ভব জীবনকে গতিশীল আর সহজ করাটাই তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রতিটি মানুষের জীবন সহজ হলেই কিন্তু একটি দেশ এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র যখন দমন-পীড়নে লিপ্ত হয় তখন আমাদের জীবনে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ কমে যেতে থাকে। স্বাভাবিকভাবে তখন গল্পও দুমড়ে-মুচড়ে সংকুচিত হয়ে যায়।

আল জাজিরা: আপনি অতীতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে, কালো নারী ও শিশুদের বিষয় কথাসাহিত্যে যথেষ্ট জোরালোভাবে তুলে ধরা হয় না। আপনি কি এ অবস্থার কোনও পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন?

ডাঙ্গারেম্বগা: এক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। প্রকাশের জগতে কৃষ্ণাঙ্গদের গল্প বলার পথ উন্মোচিত হয়েছে। তবে এই ধরণের সাহিত্য আরো তৈরি করতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গদের সকল সম্প্রদায়ই সাহিত্য তৈরির কাজে সাধারণত উৎসাহিত হয় না। তাই এসব  চরিত্র তুলে ধরা এবং প্রকাশনার জন্য গৃহীত গল্পগুলির মধ্যে এখনও অনেক ফাঁক রয়েছে। যদিও পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, এখনও অনেক কাজ বাকি আছে।

আমি কোন লেখকের প্রশংসা করব? জিম্বাবুয়ের নভুও তুষুমা আছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার লেখকদের মধ্যে ইয়ং ব্লাড, সিফিসো মজোব ও জ্যাকস এমডা. থানডো মগকোলোজানা খুব ভালো লিখছেন। আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ অংশ থেকে অনেক ভাল লেখা আসছে, পশ্চিম আফ্রিকার লেখকরাও ব্রিলিয়ান্ট।

২০২০ সালের বুকার পুরস্কারের শর্টলিস্টটি এখন পর্যন্ত সর্বাধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ বলে প্রশংসিত হয়েছে। তবে ওই তালিকায় আপনিই একমাত্র লেখক যিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসেননি। আপনি এই বৈচিত্র্যকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

নিজের উপন্যাস ‘দ্য মোর্নঅ্যাবল বডি’ হাতে সিৎসি ডাঙ্গারেম্বগা। এই বইটি বুকার শর্টলিস্টে ঠাঁই পেয়েছে

ডাঙ্গারেম্বগার: সংক্ষিপ্ত তালিকার তিনজনই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের, একজন স্কটিশ, একজন দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এবং অন্যজন ইথিওপীয় নাগরিক। তারা বিভিন্ন সাহিত্যিক ঐতিহ্য থেকে উঠে এসেছেন। আমাদের স্পষ্টতই বৈচিত্র্যের প্রয়োজন।

এই প্রশ্ন তো অবশ্যই উঠতে পারে-আমি ছাড়া সবাই যুক্তরাষ্ট্রের কেন? যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারীরাই কেন প্রতিভাবান হয়, অন্যত্র কেন নয়? সেখানে কি তাদের চাকরি বা অনুদান রয়েছে? আমরা ‘আমেরিকান স্বপ্ন’ সম্পর্কে কথা বলতে পছন্দ করি না। তবে সেখানে কি আসলেই কিছু আছে? কেন সেইসব মানুষেরা নিজেদের দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে এলো? কেন যেখানে তাদের থাকার কথা ছিল তারা সেখানে থাকল না? এবং কেন যারা নিজেদের দেশে থাকছেন তারা একই স্তরে পারফর্ম করছেন না? তাহলে এখন যারা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন তারা কি সুযোগ এবং সম্ভাবনা পূরণের প্ল্যাটফর্মটি যথার্থভাবে পেয়েছেন?

সাধারণভাবে, আমি অন্তর্ভুক্তির ধারণার সাথে জড়িত থাকতে পছন্দ করি। সকল সম্প্রদায়ের মানুষকেই একটি ইতিবাচক সামাজিক প্রক্রিয়াগুলিতে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

আল জাজিরা: বিবিসি ‘বিশ্বের রূপ বদলে দেয়া’ ১০০ টি বইয়ের তালিকায় আপনার নার্ভাস কন্ডিশন ট্রিলজিকে রেখেছে। আপনি কি বিশ্বাস করেন যে, বইটি পাঠকদের জন্য আলাদা কোনও অর্থ বহন করে এবং যদি তাই হয় তবে কীভাবে? আপনার বইগুলি কী ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে আপনি আশা করেছিলেন?

ডাঙ্গারেম্বগা: আমি মনে করি ‘নার্ভাস কন্ডিশন’ জিম্বাবুয়ের অনেক তরুণী এবং অন্যান্য আফ্রিকান নারীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তারা যে ধরনের পরিবেশে অভ্যস্ত সেখান থেকে উত্তরণের একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে উপন্যাসটি। আমি খুবই খুশি যে, এই ট্রিলজির মাধ্যমে তারা নিজেদের অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত করতে পেরেছে, বিশেষ করে যারা অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সী তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণের শিক্ষা পাচ্ছে।

আল জাজিরা: জুলাইয়ের শেষে হারারে নগরীতে দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালীন আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং বর্তমানে আপনি জামিনে রয়েছেন। মামলার বর্তমান অবস্থা কী?

ডাঙ্গারেম্বগা: গত ৭ অক্টোবর শুনানির জন্য আমি চতুর্থ দফা আদালতে হাজির হয়েছিলাম। আমার আইনজীবীরা শুনানির জন্য তারিখ চেয়েছিল। পরে মামলাটি স্থগিত করা হয়। আগামী ২৪ নভেম্বর হাজিরা দিতে আদালতে ফিরছি।

আদালত আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলে কী শাস্তি হতে পারে তা আমি জানিনা।  আমি এ বিষয়ে কিছু জানতে চাইনি, আমার আইনজীবীরাও আমাকে কিছু বলেনি। গত ৩১ জুলাই আমি তো একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলাম।  কিন্তু জিম্বাবুয়েতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারও মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। জিম্বাবুয়ের নাগরিকরা মনে করছেন- কর্তৃপক্ষ যা কিছু সিদ্ধান্ত নেয় তা তারা নীরবে মেনে নিবে, বিরোধিতা করলেই তো গ্রেপ্তার হতে হবে।

আল জাজিরা: আপনি হচ্ছেন জিম্বাবুয়ের প্রথম নারী লেখক যিনি ইংরেজিতে উপন্যাস লিখছেন। জিম্বাবুয়েতে নারীরা লেখালেখিতে কম আসছেন কেন? সেখানকার নারী লেখকরা এখনও কি ধরনের সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হচ্ছেন?

ডাঙ্গারেম্বগা: আমি মনে করি জিম্বাবুয়ের প্রকৃতির সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে ।  সাধারণত জিম্বাবুইয়ানরা প্রথার বিরুদ্ধে যাওয়া পছন্দ করে না, সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির সঙ্গে মানিয়ে চলাকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কেননা সেখানকার সমাজে প্রথা বিরোধী কোনও কাজকে সমর্থন করা হয় না, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। যে নারীরা ইংরেজিতে লেখার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী তারাও তো এখন পর্যন্ত প্রচলিত ধারণার বাইরে আসার সাহস পান নি। আমি তো কেবল ‘ও লেভেল’ পর্যন্ত ইংরেজি পড়েছি। আমি তো বড় বড় ডিগ্রি নেইনি। কিন্তু তারপরও আমি লেখক হয়েছি। কেননা আমি বুঝতে পেরেছিলাম সমাজের প্রচলিত পেশাগুলো আমার জন্য নয়, তাই তো আমি লেখালেখিকে সিরিয়াসলি নিয়েছি।

জিম্বাবুয়েতে, আমরা নারী একাধিক নিপীড়নের মুখোমুখি হই। তাই আমরা আবার ঐতিহ্যবাহী সমাজ এবং রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ফিরে যাই যেখানে নারীদের সোচ্চার হওয়ার কোনও সুযোগ নেই, তাই তারা নীরবে নারীদের জন্য নির্ধারিত কাজ করে যাচ্ছে।  আপনি পোস্ট কলোনিয়ান সময়ের কথা যদি বলেন তাহলে সেখানে দেখবেন বৈবাহিক পরিস্থিতিতে নারীদের প্রচুর কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে এবং পরিস্থিতির কারণে তারা বাধ্য হয়ে সেগুলো করছে। একটি ছোট উদাহরণ: স্কুলে যাওয়ার সময় আপনার বাচ্চাকে টিফিন দিতে হবে। আপনি তখন কি করবেন? দোকান থেকে কিছু কিনে টিফিন বক্সে ভরে দিয়ে দিবেন। এরপর কাজে চলে গেলেন, খুবই সোজা বিষয়। কিন্তু একজন নারীর কাজ তো এত সোজা না? তাকে একই সঙ্গে খাবার তৈরি করতে হবে, বাচ্চাদের গোসল করাতে হবে, জামা কাপড় ধুয়ে আয়রন করতে হবে, বাড়ির বয়স্ক লোকজনের দেখভাল করতে হবে। এসব কাজের কোনও বিকল্প নেই, যত কষ্ট হউক তাদের এগুলো করতেই হবে।

আল জাজিরা: আপনার নিজের মা আপনার জীবনে কী প্রভাব ফেলেছেন? নার্ভাস কন্ডিশনে আপনি মাতৃত্বের ‘তিক্ত পরিস্থিতি’ সম্পর্কে লিখেছেন। এর অর্থ কী?

ডাঙ্গারেম্বগার: আমার মা আমাকে দেখিয়েছিলেন, যে কোনও নারীর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সক্ষম হওয়া খুব স্বাভাবিক। আমার মা সেই ব্যক্তি যিনি আমাকে এটি উপলব্ধি করাতে পেরেছিলেন যে, একজন নারীর পক্ষেও জীবনে কিছু করা সম্ভব।

আল জাজিরা: আপনি কখন বুঝতে পারলেন যে, আপনাকে লেখক হতে হবে?

ডাঙ্গারেম্বগা: আমি নই, লেখালেখিই আমাকে চেয়েছিল। আমার সবসময় গল্প বলার তাগিদ ছিল, তবে আমি ভাবিনি যে, আমি জীবিকার জন্য লিখব। সৃজনশীল ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমি আসলে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চেয়েছিলাম। তাই মাত্র আট বছর বয়স থেকেই কল্পকাহিনী লেখার চেষ্টা করেছি। তারপরেও কিন্তু ‘লেখক’ হওয়ার কথা ভাবিনি। লেখক হওয়ার জন্য নয়, আমি আসলে চিত্রনাট্য তৈরির জন্য লেখালেখি করতে চেয়েছিলাম। আমি তখন ভাবতাম, লেখালেখিটাও মনে হয় সেইসব কাজের একটি যা আমরা করে থাকি। তারপরে কোনও এক সময় আমি দেখতে পেলাম যে, লেখাগুলি আমাকে গ্রাস করেছে এবং আমি এটির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে গেছি। যদিও আমি এখনও আমার চলচ্চিত্রগুলি তৈরি করতে চাই, যেগুলোর কথা ভেবে আমার লেখালেখিতে আসা।

আল জাজিরা: আপনার লেখায় বিশ্বাসঘাতকতার থিম এবং বিশেষত, বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টিকে অন্বেষণ করা হয়েছে। আপনি কি জিম্বাবুয়ের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইমারসন মাননাগওয়া দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতা বোধ করছেন যিনি ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং রবার্ট মুগাবের দমনমূলক শাসন থেকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন আনবেন বলে আশা করা হয়েছিল?

ডাঙ্গারেম্বগা: আমার মতে স্বাধীনতা লাভের বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছিল বিশ্বাসঘাতকতা। ক্ষমতায় যাওয়া লক্ষ্য অর্জনের জন্য জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্ষমতাসীন দলের (জ্যানু-পিএফ) কৌশল ছিল জনতাকে হিংস্রভাবে ভয় দেখানো। সশস্ত্র সংগ্রামে স্বাধীনতার আগে অনেকগুলি সংঘাত ঘটেছিল। ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বিরোধী পথ, যেখানে আমরা কোথায় রয়েছি তার প্রেক্ষাপটে আমরা বিষয়গুলি ভাবি না। আমরা খুব কৌতূহলী ছিলাম। আমরা আফ্রিকান এবং যা আমাদের ঐতিহ্য আমরা কেবল সেগুলোই অনুসরণ করছি। এটি খুবই  হাস্যকর। কারণ আপনি তো এখন ১৬তম শতাব্দীতে দেশ পরিচালনা করছেন না?

আমাদের বিশ্বাস ছিল যে, নেতারা জাতির জন্য সর্বোত্তম পথ তৈরি করবেন। কিন্তু তারা তো কেবল এমন একটি রাষ্ট্র তৈরি করছিল, যেখানে তারা যা খুশি তাই করার জন্য দখল করে রাখতে পারে। সুতরাং এটি বিশ্বাসঘাতকতা, পাঁচ বছর বা ১০ বছরে এটি ঘটে নি। এটি এমন একটি নিপীড়ক রাষ্ট্র যা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেছে। আপনি যদি সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে ফিরে তাকান তাহলে আপনি দেখবেন, এমন কিছু লোক ছিল যারা রহস্যজনক উপায়ে মারা গিয়েছিল। এসব ব্যাপারে ছিল গোপনীয়তা এবং মিথ্যাচার।  এমনকি যদি আমরা বলি যে, সশস্ত্র সংগ্রামের সময় এ সম্পর্কে কথা বলা যায় না, তবে কেন সেই একই গোপনীয়তা পরেও থাকবে?

আমরা কখনও শুনিনি যে, এই সরকার অতীতের ধারাবাহিকতা থেকে ফিরে আসবে। বরং আমরা শুনেছি এই সরকার সবকিছু ‘ব্যবসায়ের জন্য উন্মুক্ত’ করে দিয়েছে। তবে আমরা এ কথাও শুনিনি যে, এই ‘ব্যবসায়’ জনগণ লাভবান হবে।

আল জাজিরা অবলম্বনে মাহমুদা আকতার

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/