ধারাবাহিক উপন্যাস স্বপ্নজাল-আট

গ্রেগোয়ার দোলাকু

অনুবাদ: মাহমুদা আকতার

পর্ব আট

সকাল থেকে লো’বজারভেতর দ্য লা’রাজোয়া পত্রিকার এক সাংবাদিক এসে বসে আছে দোকানে। আমার সাক্ষাৎকার নিতে চায়। আমার ব্লক সাইট সম্পর্কে জানতে চায়। আমি প্রতিদিন সকালে কিছু না কিছু লিখি। সেলাই, ফোঁড়ন, নকশা, নতুন পোশাকের ডিজাইন, এমব্রোডয়ারি এসবই আমার লেখার বিষয়। অনেকে আমার ব্লগ থেকে কোন কাপড়ে কোন সুতো বা লেস মানাবে এইসব ধারণা নিতে পারেন। কখনও বা নিজের কাপড়ের দোকান নিয়েও লিখি। আরও লিখি পুরনো দিনের কাপড়ে যে ধরনের লেস বা এমব্রোডয়ারি করা হত তা নিয়ে। আমার মতে কোনো ডিজাইনই পুরনো বা সেকেলে নয়। যা সুন্দর তা সবসময়ই সুন্দর। দরকার কেবল সঠিক উপস্থাপন। আমার লেখার কিছু নির্দিষ্ট পাঠক আছে। তাই লেখাগুলো ভালোই হিট হয়। সাংবাদিক বলেন, ‘আপনার লেখায় তো অনেক লাইক পড়ে। কয়েক শ’এমনকি কোনো কোনো লেখার জন্য তো হাজার ছাড়িয়ে যায়।’ মেয়েটি বেশ সুন্দরী। বয়সও কম। আমি ওর গোলাপি মাড়ি আর সাদা  দাঁতগুলো দেখছিলাম।
-আপনার ব্লগটা কিন্তু অসাধারণ। আমি এ নিয়েই প্রশ্ন করতে চাই। আপনার সাইটে প্রতিদিন এক হাজার দুশ’নারী কেন ভিজিট করে? তারা কি কেবল পোশাক নিয়েই কথা বলে? হঠাৎ করে তাদের সেলাই ফোঁড়ন আর পোশাক ডিজাইনের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার কারণ কি? আপনি কি মনে করেন এই সময়ে মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ কমে যাওয়ার ফলেই তারা নেটে বেশি আসছে? ভার্চুয়াল জগৎ কি মানুষের সামাজিক চরিত্রকে নষ্ট করে দিচ্ছে না?
আমি মেয়েটিকে থামিয়ে দেই।
-দেখুন, আপনার এই সব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। একসময় লোকজন ডায়েরি লিখত। তার বদলে তারা এখন ব্লগ লেখে।
-আপনিও কি একসময় ডায়েরি লিখতেন?
-না না। আমি কখনও ডায়েরি লিখিনি। আমি আপনার এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারব না। আমি সত্যিই দুঃখিত।
মেয়েটি তার নোটবুক আর কলম বন্ধ করে। গভীরভাবে আমার চোখের দিকে তাকায়। আমার হাত ধরে বলে চলে, আমার মা গত দশ বছর ধরে একা থাকছেন। ভোর ছয়টায় ঘুম ভাঙে তার। এরপর নিজের জন্য কফি বানায়। গাছগুলোতে পানি দেয়। রেডিওতে খবর শুনতে শুনতে কফি পান করেন। এরপর গোসল করেন। এর এক ঘণ্টা পর মানে সকাল সাতটা বাজতেই তার দিন শেষ। এরপর গোটা দিন থেমে থাকত। কিছুতেই কাটতে চাইত না তার সময়। কর্মহীন আর স্বজনহীন একজন মানুষের জীবন যে কত ভয়াবহ! গত দুই মাস আগে এক প্রতিবেশীর কাছে আপনার ব্লগ সাইটটি সম্পর্কে জানতে পারে সে। এরপর আমার কাছে একটি কম্পিউটার কিনে দেওয়ার বায়না ধরে। আর এরপর তো তার জীবনটাই পাল্টে গেছে। এজন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আপনার বর্ণিল নকশাগুলো আমার মায়ের জীবনে নতুন আনন্দ নিয়ে এসেছে। তাই আপনি কিছু জানেন না দয়া করে এমনটি বলবেন না।
সাাংবাদিক তার ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে ওঠে দাঁড়ায়।
-আজ চলে যাচ্ছি। আমি কিন্তু আবার আসব। তখন আমার এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
এই বলে মেয়েটি চলে যায়। ঘড়িতে তখন এগারটা বিশ। আমি আর বসে থাকতে পারছি না। আমার হাত পা কাঁপছে। মেয়েটা আমাকে এইসব কি বলে গেল! আমার মাথাটা যে আর কাজ করছে না। দোকান বন্ধ করে আমি বাড়ি ফিরে আসি।

কিশোরী বয়সের হাতের লেখাগুলো দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। এক পৃষ্ঠায় লেখা ফিলিপ দ্য গুভের্ন। ওর কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমার। ও ছিল আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। যদিও অন্যরা ওকে নিয়ে খুব মজা করত। আমরা তাকে ‘পোশ দ্য’ মানে গুভের্নের পকেট বলে খেপাতাম। আমরা ওর নাম দিয়েছিলাম গুভনর। কিন্তু আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। পাগলের মত ভালবাসতাম ওকে। যদিও সবই ছিল একতরফা। কী যে আকর্ষণীয় আর সেক্সি লাগত ছেলেটাকে! ওর গলায় জড়ানো রুমালের দুই প্রান্ত বুকের ওপর দিয়ে গিয়ে কোমড়ের কাছে ঝুলে থাকত। ও গল্প করার সময় নিকটতম অতীত কাল ব্যবহার করত। লেখক কিংবা কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখত সে। এমন কি গানও লিখতে চাইত সে। আর এইসবই তো মেয়েদের হৃদয়ে ঢেউ তোলার জন্য যথেষ্ট। যদিও ক্লাসের সবাই ওর এইসব কথা শুনে হাসত। কেবল আমি ছাড়া। এত যে ভালোবাসতাম তারপরও সাহস করে কোনোদিন ওকে বলা হয়নি সে কথা।
আমি ডাইরির পাতা উল্টালাম। এই পৃষ্ঠায় কিছু সিনেমার টিকেট সাঁটানো আছে। আমার সতের বছরের জন্মদিনের একটি ছবি। ওইদিন প্রথমবারের মত বিমানে উঠেছিলাম বাবার সঙ্গে। বাবা-মেয়ের এই ছবিটি তোলা হয়েছিল আমিয়েন গ্লিসি বিমানবন্দর থেকে। এখন আর সেই দিনের কথা মনে করতে পারবে না আমার বাবা। স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর তার মাথা থেকে সব অতীত মুছে গেছে। তিনি বাস করেন বর্তমানে। কোনো অতীত বা ভবিষ্যৎ নেই তার। তার বর্তমানের স্থায়িত্ব মাত্র ছয় মিনিট। প্রতি ছয় মিনিট অন্তর তার স্মৃতি লোপাট হয়ে যায়। তার মাথা তখন শূন্য। তাই ছয় মিনিট পর পর তিনি কেবল তিনটি জিনিসই জানতে চান। আমার নাম কি, আজ কি বার এবং মা তাকে দেখতে এসেছিল কিনা। ছয় মিনিট পরপর তিনি এই সব প্রশ্ন  করেন।
ডায়রির শেষ পাতায় নীল কালিতে লেখা একটি লাইনে আমার দৃষ্টি আটকে যায়। আমার মা রাস্তায় পড়ে যাওয়ার আগে আমি এটি লিখেছিলাম। ‘আমি জীবনে কি করতে চাই তার সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগটা আমি চাই এবং আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের জীবনে এটি সর্বোৎকৃষ্ট উপহার।’ ওই সুযোগটাই নির্ধারণ করবে আপনি নিজের জীবনটাকে কীভাবে সাজাতে চান তার ওপর।

আমি ডায়েরিটা বন্ধ করি। এখন তো আমি বড় হয়ে গেছি। তাই আমার কান্না শোভা পায় না। আমি সাতচল্লিশ বছরের একজন মধ্যবয়সী নারী যার রয়েছে একজন বিশ্বস্ত, দয়ালু আর সংযমী স্বামী। দুটি বড় বড় সন্তান আর একটি মৃত শিশু। যদিও ওই মৃত মেয়ের কথা আমি প্রায়ই ভাবি। ওর জন্য কষ্ট হয় খুব। আমার দোকান আর জোয়ের মাসকাবারি বেতন দিয়ে আমরা তো স্বচ্ছলভাবেই জীবন কাটাচ্ছি। ইচ্ছে করলে বছরে একবার ভালো কোনো জায়গায় ঘুরতে যেতে পারি। যদিও জোয়ের গাড়ি কেনার মত শখ পূরনের মত সামর্থ আমাদের হয়নি। তবে আমি ওর জন্য একটি সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি দেখেছি। ওটা কিনতে লাগবে ছত্রিশ হাজার ইউরো। আমি ব্লগ লিখি যা একজন সাংবাদিকের মাকে নতুন জীবন দিয়েছে। সম্ভবত আরো শত শত নারী এ থেকে উপকৃত হচ্ছে। ব্লগে এত দর্শনার্থীদের আনাগোনা দেখেই সম্প্রতি একজন আমাকে বিজ্ঞাপণ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। জো আমাকে সুখেই রেখেছে। ওকে ছাড়া আর কোনো পুরুষকে আমি চাইনা। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও তো সত্যি, আমি আমার জীবনকে সাজানোর কোনো সুযোগ পাইনি। তাই জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে তা তো আমার হাতে নয়।

আগের পর্ব-ধারাবাহিক উপন্যাস স্বপ্নজাল-সাত

বাসা থেকে দোকানে ফিরছিলাম। প্লাস দে এরোস অতিক্রম করার সময় শুনি কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। তাকিয়ে দেখি দুই যমজ। তারা কফি খেতে খেতে লটারির টিকেট কিনছে। ফ্রাঁসোয়া বলে, তোমার একবার নিজের ভাগ্যটা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। তুমি কি আজীবন ওই দোকান মালকিন হয়েই থাকবে, আর কোনো স্বপ্ন নেই?
-আমি তো আমার দোকানটাকে ভালোবাসি।
তখন দানিয়েল বলে, তুমি কি আর কিছু চাও না। একবার চেষ্টা করেই দেখ না। এখানে আস। টিকেট কিনো।
অগত্যা আমি টিকেট বিক্রেতার কাছে যাই। তিনি জানতে চান, আমি কোনটা নেব, লোট্টো না ইউরো মিলিয়নস? এর আমি কি জানি। আমার কাছে তো সবই সমান। তখন লোকটা বলে, তাহলে আপনি ইউরো মিলিয়নস নিন। এই শুক্রবার এটি ড্র হবে। তাকে দুই ইউরো দিয়ে আমি লটারির টিকেট কিনি। সে আমার হাতে টিকিটটা দেয়ার পর দুই বোন আনন্দে হাততালি দেয়। ‘আজ রাত থেকে আমাদের জো সোনার দারুণ সব স্বপ্ন দেখা শুরু করবে।’

চলবে

মাহমুদা আকতার: সাংবাদিক ও লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচটি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/