আনার উৎসব: যে আয়োজন ভুলিয়ে দিয়েছে যুদ্ধের ভয়াবহতা

ফলটি দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও দারুণ সুস্বাদু। এর নাম আনার। আমাদের দেশে এটি ডালিম নামেই বেশি পরিচিত। তবে অনেকে একে বেদানা বলেও ডেকে থাকেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের দারকৌশ শহরে চলছে আনার মেলা। এবার নিয়ে তৃতীয় বারের মতো আয়োজিত এ উৎসবে যোগ দিয়েছেন  প্রদেশের বিভিন্ন এলাকার আনার চাষী ও ব্যবসায়ীরা।

এই উৎসব চলমান গৃহযুদ্ধের মধ্যেও সাময়িক আনন্দ এনে দিয়েছে ইদলিববাসীর মনে। তারা ক্ষনিকের জন্য ভুলে গেছেন গত ৯ বছর ধরে চলমান গৃহযুদ্ধে ভয়াবহতা। এ কারণে ওই অঞ্চলের লোকজনের কাছে এই ডালিম বা আনার উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম।

উৎসবের আয়োজকদের একজন সমীর আলওয়ানি। তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পর্যটন এবং মানবিক উদ্দেশ্য থেকে উৎসবের আয়োজন করেছি।  আমরা এখান থেকে গোটা বিশ্বে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে চাই। আমরা এমন একটি জাতি যারা আসাদের বাহিনীর অধীনে প্রচুর ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমরা এখন দেখাতে চাই যে, আমরা বিপ্লবের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সবার সাথে হাত মিলিয়ে দেশটি পুনর্গঠন করতে চাই। আমরা বিশ্বের কাছে আমাদের সভ্য দেশের চিত্রটি ছড়িয়ে দিতে চাই।’

দারকৌশ শহরে অর্নেটেস নদীর তীরজুড়ে বসেছে আনার মেলা

দারকৌশ শহরে অর্নেটেস নদীর তীরজুড়ে বসেছে আনার মেলা। অংশগ্রহণকারীরা ঝুড়ি আর টেবিলগুলোতে থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন নানা জাতের আনার। এখানে কেবল আনারের প্রদর্শনই হচ্ছে না, রয়েছে প্রতিযোগিতারও ব্যবস্থা। মেলায় অংশ নেয়া অগুণিত আনারের মধ্য থেকেই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ফলগুলোকে বেছে নেবেন বিচারকদের প্যানেল। এরপর পুরস্কৃত করা হবে এর বাগান মালিককে। উৎসবে অংশ নেয়া চাষীরা ইতিমধ্যে প্রতিযোগিতার জন্য ফল পাঠিয়ে দিয়েছেন বিচারকদের টেবিলে।

উৎকৃষ্ট মানের আনারের জন্য দারকৌশ অঞ্চলের সুনাম রয়েছে। এখানে নানা জাতের আনারের চাষ হয়ে থাকে। আল-লাফান জাতের আনার আকারে খুব বড় এবং এর বিচিগুলো পুরো গোলপি। আর আল-ফারানসি আকারে খুব ছোট এবং বিচিগুলো লাল রঙের। অন্যদিকে তুলনামূলক ছোট ও বিচিহীন আল-আশফরি জাতের ডালিমটি। সিরিয়ার এই অঞ্চলের সর্বোত্তম আনার হিসাবে আল-লাফানের সুনাম আছে।  আর বৃহৎ আকারের কারণেই এর নাম আল-লাফান।

তবে গত বছর কিন্তু সেরা হয়েছিল আল-আশফরি জাতের আনার। কেবল সুস্বাদু আনার নয়-এ থেকে তৈরি জুস ও গুড়ের জন্যও  এই অঞ্চলটির প্রচুর সুনাম রয়েছে।

বিচারকদের প্যানেলে রয়েছেন কৃষিবিদ, অভিজ্ঞ কৃষক ও স্থানীয় ডালিম ব্যবসায়ীরা। তারা আনারের রঙ, আকার ও এর বিচির ওপর ভিত্তি করে পুরস্কারের জন্য বেছে নেবেন সেরা ডালিম চাষীকে। তার হাতে তুলে দেয়া হবে সেরার ট্রফি আর মেডেল। এই প্রতিযোগিতার আর্থিক গুরুত্ব খুব বেশি না হলেও স্থানীয়দের কাছে এটি সম্মানজনক পুরস্কার হিসাবে বিবেচিত। তাছাড়া যুদ্ধের সময় আনারকে বাজারজাত করার ক্ষেত্রেও এই উৎসবের গুরুত্ব রয়েছে।

এরকমই এক আনার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন আহমেদ সালেম খাদড়ো। তিনি সেরার পুরস্কার পাওয়ার অভিজ্ঞতাকে একটি "অপ্রত্যাশিত চমক" হিসাবেই দেখছেন।  পারিবারিকভাবেই আনার চাষের সাথে জড়িত রয়েছেন ২৯ বছর বয়সী  খাদরো। তাদের রয়েছে বিশাল আনার খামার। আর তারা সেখানে উন্নত জাতের আনার তৈরির কৌশল রপ্ত করার অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন-কঠোর পরিশ্রম করার কারণেই তিনি আনার প্রতিযোগিতায় সেরার পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। এই ধরনের উৎসবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন এবং আনার চাষে উৎসাহ পাওয়া যায়। পাশাপাশি বাজারে আনারের চাহিদা তৈরিতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখে এসব উৎসব।

উৎসবে যোগ দিয়েছেন নারীরাও

এই আনার উৎসবে অংশ নিয়েছেন কিছু নারীও। এদেরই একজন হলেন ২৪ বছরের তরুণী সালাম হামিদো। তিনি এবারই প্রথম এসেছেন উৎসবে। তিনি ডালিম উৎপাদনের জন্য সিরিয়ার দারকৌশ অঞ্চলের সুনাম শুনেই এই মেলায় অংশ নিতে আগ্রহী হয়েছেন বলে জানান। হামিদো এসেছেন ইদলিবের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কাফর নাবল থেকে। তাই বলে ভাববেন না তিনি কেবল মেলায় আনার প্রদর্শনেই অংশ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকছেন। উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ নৌকা বাইচ থেকে শুরু করে খাবারের স্টলে প্রতিযোগিতায় পর্যন্ত অংশ নিচ্ছেন এই তরুণী। পাশাপাশ কৃষি বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠকেও উপস্থিত থাকছেন তিনি। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে এখানকার শান্ত মনোরম পরিবেশ তাকে অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও যুদ্ধের ভয়ঙ্কর স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে। হামিদোর ভাষায়, ‘এই উৎসব আমাকে আমাকে যুদ্ধের পরিবেশ থেকে সরে থাকার সুযোগ দিয়েছে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।’

অর্নেটেস নদীতে চলছে নৌকাবাইচ

তবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও বর্ণিল আনার উৎসবটি হয়ে থাকে মধ্য এশিয়ার দেশ আজারবাইজানে। প্রতি বছর অক্টোবরে দেশটির গোয়চান শহরে আয়োজিত এই উৎসবে ভিড় জমিয়ে থাকেন প্রচুর বিদেশি পর্যটক।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/