শুভ জন্মদিন প্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা

আজ ২ ডিসেম্বর, দেশের প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার জন্মদিন। এক সময় টেলিভিশন, মঞ্চ ও সিনেমার পর্দা কাঁপানো এই শিল্পী প্রযোজক হিসাবেও কাজ করছেন।  একই সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের একজন সম্মানিত সদস্য হিসাবেও।

প্রাথমিক জীবন

সুবর্ণা মুস্তাফা ১৯৫৯ সালের এই দিনে ঢাকার এক সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নে। তার বাবা গোলাম মুস্তাফা ছিলেন একজন প্রখ্যাত অভিনেতা ও আবৃত্তিকার। তার মা হোসনে আরা পাকিস্তান রেডিওতে প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন। মায়ের সহায়তায় মাত্র ৫/৬ বছর বয়সে বেতার নাটকে কাজ করেন সুবর্ণা। নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি প্রথম টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে নিয়মিত টেলিভিশনে কাজ করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স সম্পন্ন করেন।

অভিনেত্রী সুবর্ণা

১৯৭০-এর দশকে ঢাকা থিয়েটারে নাট্যকার সেলিম আল দীনের নাটক জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন-এ অভিনয় করেন সুবর্ণা। টেলিভিশন নাটকের পাশাপাশি তিনি ২২ বছর মঞ্চে অভিনয় করেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে ‘বরফ গলা নদী’তে টেলিভিশনে তার নতুন যাত্রা শুরু হয়। এরপর তিনি টিভি নায়িকা হিসাবে একের পর এক জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করেন। তার অভিনীত বহু নাটক তখন দর্শকপ্রিয় হয়েছিল।

ঘুড্ডি ছবির পোস্টার

১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ঘুড্ডি ছবির মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে আসেন। যদিও ছবিটি ব্যবসাসফল হয়নি। এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুবর্ণা এটিকে‘সময়ের আগে নির্মিত একটি ছবি, অ্যাহেড অব ইটস টাইম’বলে উল্লেখ করেছিলেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে-লাল সবুজের পালা (১৯৮১), নয়নের আলো (১৯৮৪), পালাবি কোথায় (১৯৯৭), সুরুজ মিয়া (১৯৮৫) কমান্ডার (১৯৯৪), ও গহীন বালুচর (২০১৭) উল্লেখযোগ্য।

সুবর্ণা ১৯৮৩ সালে নতুন বউ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। নয়নের আলো (১৯৮৪) ছবিতে তার অভিনয় সব শ্রেণির দর্শককে নাড়া দিয়েছিল।

মঞ্চ, টিভি ও সিনেমাতে একই সময়ে কাজ করেছেন এই অভিনেত্রী। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সুবর্ণা বলেন, ‘আমার সব কিছুই প্রায় একসঙ্গে হয়েছে। টেলিভিশনে নাটক, ঢাকা থিয়েটারে সেলিম আল-দীনের নাটক ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’-এ অভিনয় আর তার বছরখানেকের মধ্যে ঘুড্ডি চলচ্চিত্রে কাজ।’

তিনি অভিনয় প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার আসলে অভিনয় করেই ভালো লাগে, মাধ্যম যেটাই হোক। তবে আনন্দ দিয়েছে সবচেয়ে বেশি টেলিভিশন। টেলিভিশনে আমার দীর্ঘ ক্যারিয়ার। তিন থেকে চার ক্যামেরার সামনে কাজ করেছি। আর কাজ শিখেছি মঞ্চে; বুঝেছি চরিত্র কীভাবে নির্মাণ করতে হয়। সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ হলো বেতারে। একজন অভিনেতার আল্টিমেট লক্ষ্য সিনেমা। আমি শটকার্টে কোনো কাজ করতে পারি না। শতভাগ দিয়ে কাজ করি।’

১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন সুবর্ণা মুস্তফা। বিশেষ করে আফজাল হোসেন এবং হুমায়ুন ফরীদির সাথে তার জুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ৮০ দশকে আফজাল-সুবর্ণা জুটি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে-দর্শকরা মনে করতো তারা বুঝি বাস্তবেও প্রেমিক-প্রেমিকা এবং ঘর বাঁধবেন। কিন্তু ৮০'র দশকের শেষের দিকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে হুমায়ুন ফরিদীর সাথে বিয়ের মঞ্চে বসেন সুবর্ণা মুস্তাফা। যদিও এই বিয়েও টিকেনি। দীর্ঘ ২২ বছর সংসার করার পর ২০০৮ সালে ফরীদির সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরবর্তীতে তিনি টিভি নাটকের পরিচালক ও প্রযোজক বদরুল আনাম সৌদকে বিয়ে করেন।

আফজাল-সুবর্ণা টেলিভিশনের জনপ্রিয় জুটি

সুবর্ণা অভিনীত টিভি নাটকের মধ্যে বরফ গলা নদী, রক্তের আঙ্গুর লতা, পারলে না রুমকি, বাবার কলম কোথায়, অরণ্যের সুখ-দুঃখ, চেহারা, জোহরা, কুসুম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সুবর্ণা অভিনীত ধারাবাহিক নাটকগুলোও পেয়েছিল সমান জনপ্রিয়তা। টেলিভিশনের অনেক কালজয়ী নাটকের সাথেই সুবর্ণার নাম জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’এর মুনা চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন এই গুণী অভিনেত্রী। জানা যায়, নাটকের চয়িতা হুমায়ূন আহমেদ নাকি সুবর্ণা মুস্তাফাকে বলেছিলেন, যদি মুনা চরিত্রটি সূবর্ণা করতে রাজি থাকেন তাহলেই কেবল তিনি নাটকটি নির্মাণ করবেন। তিনি  হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনয় করেও খ্যাতি অর্জন করেন।

তিনি আজাদ আবুল কালাম রচিত ও আফসানা মিমি এবং বদরুল আনাম সৌদ পরিচালিত ডলস হাউজ টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনয় করেন। এটি সৌদ পরিচালিত ও সুবর্ণা অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক। পরবর্তী কালে তিনি সৌদের পরিচালনায় সীমান্ত, উপসংহার, গহীনে, গ্রন্থিকগণ কহে, এলেবেলে, কোমল বিবির অতিথিশালা ও কানা সিরাজউদ্দৌলা, পিঞ্জর, ঘোড়ার চাল আড়াই ঘর, অন্তর্যাত্রা টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনয় করেন।

পরিচালক হিসেবেও সুবর্ণা মুস্তাফা কিছু কাজ করেছেন। এটিএন বাংলার জন্য ‘আকাশ কুসুম’ নামের এক পর্বের একটা নাটক পরিচালনা করেন, যা কি না সেই সময়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে ‘শূন্য নামের আরেকটি এক পর্বের নাটক নির্মাণ করেন।

বিজ্ঞাপনেও তার মুখর পদচারণা ছিল। ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময়ে লাক্স সাবানের মডেল হয়েছিলেন সুবর্ণা। এছাড়া একজন ক্রিকেট ফ্যান হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ‘রেডিও ভূমি’তে ধারাভাষ্যকারের কাজটাও করে চলেছেন। এছাড়া তিনি সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্রের নির্বাচক হিসেবেও কাজ করেছেন।

  হুমায়ুন ফরিদীর সঙ্গে সুবর্ণা

রাজনৈতিক জীবন

দীর্ঘদিন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দৃপ্ত পদচারণার পর সুবর্ণা মুস্তফা নাম লিখিয়েছেন রাজনীতির ঘরে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ বিজয়ী ও ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর সংরক্ষিত মহিলা আসন-৪ (৩০৪), ঢাকা-২২ থেকে সুবর্ণা মুস্তাফাকে মনোনয়ন ও চূড়ান্তভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তফা এখনও দর্শকদের কাছে অনেক জনপ্রিয়। অভিনয় শৈলী ছাড়াও তার 'ক্ল্যাসিকাল' সৌন্দর্য আর মোহনীয় কণ্ঠের জাদুতে একসময় বহু দর্শক ঘায়েল হয়েছে।

আজ দেশের এই কিংবদন্তি অভিনেত্রীর জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। শুভ জন্মদিন প্রেয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। আমরা আপনার সুস্থতা ও দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/