প্রতিপদার্থ ও তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক

পুরুষোত্তম চক্রবর্তী

গৌরচন্দ্রিকা: সাধারণভাবে কোন একটি পদার্থের বিপরীত-ধর্মী আরেকটি পদার্থ যে বিশ্বপ্রকৃতিতে অবস্হান করতে পারে একটা সময় পর্যন্ত এই ব্যাপারটি কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু কল্পনা করতে হয়েছে একটি বিশেষ পর্যায়ে। ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানী আদ্রিয়েন মরিস পল ডিরাক ইলেকট্রন নিয়ে একটি সমীকরণ প্রকাশ করেন। সেই গাণিতিক সূত্র থেকে একটি সমস্যা উদ্ভূত হয়। সমস্যা বলছে, ইলেকট্রন দুই ধরনের হতে পারে।

একপ্রকার ইলেকট্রনের বৈদ্যুতিক আধান (charge) ঋণাত্মক (negative) যার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। পরিবাহী ধাতুর ভিতর দিয়ে এই ঋণাত্মক ইলেকট্রনের প্রবাহই বৈদ্যুতিক প্রবাহের জন্য দায়ী। আরেক প্রকার ইলেকট্রন অর্থাৎ এই ইলেকট্রনের বিপরীত-ধর্মী ইলেকট্রনের আধান (charge) ধনাত্মক (positive), যার বাস্তবতার ব্যাখ্যা চিরাচরিত পদার্থবিজ্ঞান দ্বারা মেলেনা। কিন্তু গণিত তো মিথ্যা বলে না! তাছাড়া গাণিতিক অকাট্যতা কে অস্বীকার করারও কোন উপায় নেই!

ডিরাক বললেন প্রতিটি মৌলিক কণার একটি করে বিপরীতধর্মী কণা থাকতেই হবে এবং এই বিপরীতধর্মী কণার আধান ও ঘুর্ণন (spin) মূল কণাটির আধান ও ঘুর্ণনের ঠিক বিপরীতমুখী। বিপরীতধর্মী ইলেকট্রন টিকে বলা হল প্রতি-ইলেকট্রন (anti-electron); যার নাম দেওয়া হল পজিট্রন। প্রতিকণাদের নিয়ে গঠিত বস্তুকে বলা হয় প্রতিপদার্থ (anti-matter) ।

তত্ত্ব বলছে, মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময় সমপরিমাণ পদার্থ ও প্রতিপদার্থ তৈরি হয়েছিল। সমান পরিমাণ না হলে মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্বের সমীকরণ টিতে গড়মিল হয়ে যাবে বা মহাবিশ্বে সাম্যাবস্থা (equilibrium) বজায় থাকতে পারবে না। পদার্থ ও‌ প্রতিপদার্থ বিপরীত ধর্মী হওয়ায় একে অপরের সংস্পর্শে এলেই পরষ্পরের মধ্যে সংঘাত ঘটবে এবং একে অপরকে ধ্বংস করে দুইয়েরই বিনাশ ঘটবে। একদিকে অনবরত পদার্থ ও‌ প্রতিপদার্থ তৈরি হচ্ছে আর অন্য দিকে একে অপরের সংস্পর্শে এসে তারাই তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলছে। এই যদি পরিস্হিতি হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনকিছুরই থাকার কথা নয় এবং মানবজীবনের অস্তিত্বে সঙ্কটের প্রশ্ন আসে।

হয়তো মহাজাগতিক ধ্বংসের সময় যৎসামান্য পরিমাণ সাধারণ পরমাণু রয়ে গিয়েছিল পরিমাণটা প্রতি এক বিলিয়ন পদার্থ ও‌ প্রতিপদার্থ জোড়ার মাঝে হয়তো একটি! আজকে যে আমরা এই বিশাল জগত দেখতে পাই, গ্যালাক্সিতে কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের সমাবেশ দেখতে পাই, মিলিয়ন মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে যাদের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াই তারা সকলেই তৈরী হয়েছে ঐ প্রতি বিলিয়ন জোড়ার মাঝে একটি – একটি করে বেঁচে যাওয়া পদার্থের সমন্বয়ে।

মূল প্রসঙ্গ: কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুসারে পদার্থ ও‌ প্রতিপদার্থ প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে ও পরষ্পরের সংস্পর্শে এসে এরা উভয়েই বিলুপ্ত হচ্ছে। আদ্রিয়েন‌ মরিস পল ডিরাক বা সংক্ষেপে পল ডিরাকের উদ্ভাবিত relativistic wave-equation বা সংক্ষেপে ডিরাক সমীকরণ পদার্থবিজ্ঞানের আপেক্ষিকতা-তত্ত্বীয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যাজাত একটি তরঙ্গ-সমীকরণ। এই ডিরাক সমীকরণ শুধুমাত্র ফার্মিয়ন দের (ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, বিজোড় ভর-সংখ্যা বিশিষ্ট নিউক্লিয়াস…ইত্যাদি) গতিপ্রকৃতি বা আচরণই ব্যাখ্যা করেনা এর হাত ধরেই সর্বপ্রথম "প্রতিপদার্থ" বা Anti-matter এর পূর্বাভাস পাওয়া যায় এবং এর আধুনিক তত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ডিরাক অনুমান করতে পেরেছিলেন যে তার প্রণীত তরঙ্গ-সমীকরণ ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে তা প্রতি-ইলেকট্রন (anti-electron) এর অস্তিত্বের সম্ভাব্যতাকে জোরদার করে। এই কাজের জন্য তিনি মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৩৩ সালে এরউইন শ্রোয়েডিঙ্গারের সঙ্গে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

ডিরাকের প্রতি-ইলেকট্রন কণার অনুমান বাস্তবায়ন হল ১৯৩২ সালে যখন কার্ল ডি অ্যান্ডারসন তার ক্লাউড-চেম্বার এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে সনাক্ত করলেন এক নতুন কণা। এই নতুন কণার বৈদ্যুতিক আধান ধনাত্মক (positive) এবং তার পরিমাণ হুবহু ইলেকট্রনের (ঋণাত্মক) আধানের সমান। এই কণার ঘুর্ণন (spin) 1/2 এবং ভর ইলেকট্রনের ভরের সমান। অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে এই নতুন কণা টি একমাত্র বিপরীত বৈদ্যুতিক আধান ছাড়া সবকিছুতেই ইলেকট্রনের ধর্ম বা আচরণের মত। এই মৌলিক কণাটি পজিট্রন নামে নামাঙ্কিত হল যা প্রকৃতপক্ষে প্রতি-ইলেকট্রন বা anti-electron ছাড়া আর কিছুই নয়।

একটি কম শক্তিসম্পন্ন পজিট্রনের সাথে একটি কম শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রনের সংঘর্ষের ফলে কণা-দুটির সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটবে এবং এদের সম্মিলিত ভরের সমতূল্য (equivalent) শক্তি গামা-রশ্মির ফোটন কণার মাধ্যমে প্রকাশ পাবে।

অতি সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা অনেক প্রচেষ্টার পর অ্যান্টি-হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন এবং এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জটিল প্রতিকণা (antimatter)। যেহেতু কিছু নির্দিষ্ট ধর্ম (যেমন, আধান (charge), ঘুর্ণন (spin) বা অন্যান্য কোয়ান্টাম প্যারামিটার, ইত্যাদি) ছাড়া কণা এবং তার প্রতিকণার সকল ধর্ম একই সুতরাং কণা এবং তার প্রতিকণার ভর (mass) এবং আয়ুস্কাল বা স্হায়িত্বকেও (stability) এক হতে হবে।

প্রতিকণাগুলো পরস্পর যুক্ত হয়ে প্রতিপদার্থ গঠন করে। পজিট্রন ইলেকট্রনের বিপরীত কণা, তেমনই অ্যান্টি-প্রোটন হচ্ছে প্রোটনের বিপরীত। এই দুই প্রতিকণা মিলে গঠন করে অ্যান্টি-হাইড্রোজেন পরমাণু। পদার্থ ও প্রতিপদার্থের মিলনে পূর্ণবিলয়ের সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হচ্ছে। এই ধরনের পূর্ণবিলয়ের ফলে‌ উচ্চ শক্তির গামা রশ্মি (ফোটন) এবং বহু কণা – প্রতিকণার সৃষ্ট  হয়। এই পূর্ণবিলয়ে বিমুক্ত কণাগুলির মধ্যে বিপুল পরিমাণে শক্তি সঞ্চিত থাকে। এই শক্তির পরিমাণ স্বভাবতই পূর্ণ বিলয়ের ফলে সৃষ্ট বস্তুসমূহের নিশ্চল ভর (rest mass) এবং মূল পদার্থ-প্রতিপদার্থ জোয়ার নিশ্চল ভরের পার্থক্যের সমান। এই মহাবিশ্বে যতটুকু পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে তার থেকে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে সাধারণ পদার্থই তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই বেশি। মহাবিশ্বে সাধারণ পদার্থ (matter) ও‌ তাদের প্রতিপদার্থের (anti-matter) মিশ্রনে কেন অসামঞ্জস্য সে ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়েছে।

প্রদত্ত ছবিতে ডিরাকের ক্লাউড-চেম্বার এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে একটি পজিট্রনের পথরেখা দেখা যাচ্ছে, যে পথরেখার বক্রতা স্বভাবতই ইলেকট্রনের পথরেখার বক্রতার ঠিক বিপরীত। স্কটল্যান্ডের পদার্থবিজ্ঞানী চার্লস থম্পসন উইলসন উদ্ভাবিত ক্লাউড-চেম্বার হচ্ছে একটি কাঁচের আবদ্ধ কক্ষ বা প্রকোষ্ঠ (sealed chamber) যা অতি-সঙ্পৃক্ত (super-saturated) জলীয়বাষ্প দ্বারা পরিপূর্ণ। শক্তিশালী আলফা-কণাদের অন্ত:প্রবিষ্ট করানোর দ্বারা এই কক্ষের ভিতরের বাস্পকণার অণু-পরমাণু দের আয়নীভূত (ionized) করা হয়। সেই গতিশীল আয়নদের নিজেদের মধ্যে প্রবল সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন হতে পারে নতুন কোন বিচ্ছুরিত মৌল-কণা (fundamental particle), যার গতিপথের রেখা (track) দৃশ্যমান হবে কাঁচের প্রকোষ্ঠের বাইরে থেকে।

ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাকের জন্ম ১৯০২ সালের ৮ আগষ্ট। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও কোয়ান্টাম ইলেকট্রো-ডাইনেমিক্সের সূচনা ও উন্নয়নে তার মৌলিক অবদানের জন্য তিনি বিশ্ববরেণ্য। পদার্থবিজ্ঞানে ডিরাকের গাণিতিক সমীকরণ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা আসলে সাধারণ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মেলবন্ধন। এই সমীকরণ থেকেই অ্যান্টি-ম্যাটারের অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়েছে এবং এই কাজের জন্য ডিরাক কে ‘ফাদার অফ ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স’ বলা হয়ে থাকে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‌'লুকাসিয়ান চেয়ার-প্রফেসর অফ ম্যাথেমেটিক্স' হিসেবে নিযুক্ত হন। এই দুর্লভ সম্মান ডিরাকের আগে পেয়েছিলেন একমাত্র স্যার আইজাক নিউটন। পল ডিরাক ১৯২৩ সালে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে অনার্স সহ প্রথম শ্রেণীর কলাবিদ্যায় স্নাতক উপাধি অর্জন করেন। জীবনের

শেষ ১৪ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে যুক্তরাজ্যের 'ইনষ্টিটিউট অফ ফিজিক্স' তার স্মরণে ‌ডিরাক পদক' প্রবর্তন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্যার রালফ্ হাওয়ার্ড ফাওলারের অধীনে পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। তার উল্লেখযোগ্য পিএইচডি ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম প্রখ্যাত ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা, যার নামে নামাঙ্কিত ভারতবর্ষের মুম্বাইতে অবস্হিত 'ভাবা পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র'। 'অ্যাটমিক রিয়াক্টর' নির্মাণ ও পারমানবিক-শক্তি গবেষণায় এই ইনষ্টিটিউটের স্হান বিশ্বে অগ্রগণ্য।

ডিরাকের সায়েন্টিফিক কেরিয়ারের সর্বোচ্চ সীমা আসে নভেম্বর ১৯৩৩-এ  যখন তিনি জানতে পারলেন সে বছর ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন তিনি। নোবেল প্রাপ্তির খবরে যে কোনো প্রাপকই যে যারপরনাই উচ্ছসিত ও আনন্দিত হবে তা বলা বাহুল্য। কিন্তু ডিরাকের ক্ষেত্রে এরকমটি হল না। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বেশ চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন। ডিরাক ঠিক করে ফেললেন, এই পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন। এর কারণ নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রচারের বিপুল আলো তার গায়ে আছড়ে পড়বে তা আগের থেকেই অনুমান করে তিনি আতঙ্কিত হলেন। তিনি বুঝেছিলেন সেই ঝক্কি তিনি সামলাতে পারবেন না। যাই হোক ব্রিটিশ ফিজিসিস্ট আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ডিরাককে বোঝালেন ‘এটা তোমার করা ঠিক হবে না কারণ নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলে আরও বহুগুণ বেশি পাবলিসিটি বা প্রচারের ধাক্কা সামলাতে হবে তোমাকে’। এটা শুনে ডিরাক অনিচ্ছাভরে এবং একরকম বাধ্য হয়েই নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই সময় লন্ডন নিউজ পেপার ‘সানডে ডিসপ্যাচ’ এ ডিরাক সম্পর্কে লেখা হল, একত্রিশ বছর বয়সী এই কেমব্রিজ প্রফেসর গজলা হরিণের মতন লাজুক এবং ভিক্টোরিয়ান পরিচারিকার মতন বিনয়ী ও নম্র’। এর সঙ্গে আরও লেখা হল ‘তিনি মহিলাদের সামনে আসতে কুন্ঠিত হন’।

একদিকে যেমন অসম্ভব কম কথা বলতেন অন্যদিকে প্রচন্ড ইন্ট্রোভার্ট, লাজুক এবং খানিকটা ভীতু প্রকৃতির ছিলেন ডিরাক। রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটতেন একদম রাস্তার ধার ঘেঁষে বিল্ডিঙের পাশে চোরের মতন লুকিয়ে লুকিয়ে হাঁটতেন। যাতে কারোর সঙ্গে কথা বলতে না হয়। এতটাই কম কথা বলতেন যে তার কেমব্রিজের সহযোগী বন্ধুরা পরিহাস করে ‘এক ডিরাক’ নামের একটি এককের (ইউনিট) কথা চালু করেছিলেন। ‘এক ডিরাক’ মানে হল – এক ঘন্টায় একটি শব্দ বলা।  

ডিরাকের জীবনীকাররা ডিরাকের বেড়ে ওঠা এবং তার ব্যক্তিত্ব গঠনে পারিবারিক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। শোনা যায়, ডিরাকের বেশ কয়েকজন আত্মীয়পরিজন গভীর ডিপ্রেশনের শিকার হয়েছিলেন। একুশ বছরে তাদের পরিবারে ছয়জন আত্মহনন করেন যাদের মধ্যে ছিলেন ডিরাকের অগ্রজ ভ্রাতাও। ডিরাকের মা ছিলেন ব্রিটিশ এবং বাবা ফ্রেঞ্চ-স্পিকিং সুইশ। বন্ধুরা ডিরাককে মানসিক ভাবে অস্বাভাবিক মনে করতেন। তার চরিত্রে পান্ডিত্যের গভীরতা ও মানসিক উন্মাদনার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন পরিলক্ষিত হয়েছে। অগ্রজ ভ্রাতা ছাড়াও ডিরাকের অনুজ এক ভগিনী ছিল। পরিবারের বাকি সদস্যদের মত ডিরাকের ছেলেবেলাও সুখের ছিল না। যার একমাত্র কারণ ডিরাকের বাবা, যিনি ছিলেন অসম্ভব একগুঁয়ে, জেদী ও বদরাগী। বাড়িতে সবার কাছে তিনি ছিলেন এক আতঙ্কের প্রতিমূর্তি। তিনি যা মনে করতেন সেটিই ছিল পরিবারের শেষ কথা। তিনি স্হানীয় একটি স্কুলে ফ্রেঞ্চ পড়াতেন। সেখানেও ছাত্রদের মেনে চলতে হত কঠোর অনুশাসন, যা একরকম অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছে যেত।

পরবর্তী সময়ে ডিরাক ছোটবেলায় তার বাবার প্রভুত্ব ও নিদারুণ যন্ত্রণা দেওয়ার কথার উল্লেখ করেছেন একাধিক সময়ে। ডিরাকের মা, দাদা এবং বোনকে রান্নাঘরে ডিনার করতে হত। টেবিলে খেতে বসতেন শুধু ডিরাক ও তার বাবা। ডিরাককে খেতে বাধ্য করতেন বাবা এবং সেই সময় ডিরাককে নির্ভুলভাবে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলতে হত। উচ্চারণ বা ব্যাকরণের সামান্য ভুল হলেই পীড়নের মাত্রা বাড়ত। অসুস্থতা বোধ করছে বলে ডিরাক ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে যেতে চাইলেও যেতে দিতেন না বাবা। এসব নানা কারণে ডিরাকের হজমশক্তির দারুণ সমস্যা তৈরি হল। এ ছাড়াও ভাষার ব্যাপারে স্বাভাবিক প্রবণতা চলে গেল ডিরাকের। ফ্রেঞ্চ তো বলতেনই না। এই মানসিক যন্ত্রণা আজীবন ডিরাকের সঙ্গী হয়ে থাকল।

ছোটোবেলা থেকেই ডিরাক অসম্ভব অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। প্রচারের আলো এড়িয়ে চলতেন সবসময়। যখন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করত তখন সেই উত্তরটুকু ছাড়া খুব একটা কথা বলতেন না ডিরাক। নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন তিনি। এইভাবেই সামাজিক মেলামেশা করার ক্ষমতা বা কোনো বিষয়ে কিছু বলার পারদর্শিতা তৈরি হয়নি ডিরাকের। ছোটবেলা থেকেই গাণিতিক সমাধানের অসাধারণ পারঙ্গমতা ছিল। তবে সাহিত্য বা শিল্প নিয়ে ডিরাকের কোনো আগ্রহ ছিল না। যদিও পরবর্তীকালে তার বিভিন্ন গবেষণাপত্রে একদিকে যেমন শব্দব্যবহার ও বাক্যগঠনের নৈপুণ্য দেখা গিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে সাহিত্যগুণ ও গাণিতিক উপস্থাপনার মেলবন্ধন ঘটিয়েছে যা তার রচনাগুলোর এক একটিকে চূড়ান্ত মাস্টারপিস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

অনেকেই মনে করেন বিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিজ্ঞানকে উচ্চতার তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পল ডিরাকের অবদান আইনস্টাইনের থেকে কোনও অংশে কম নয়। অথচ আইনস্টাইন, নীলস বোর, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, শ্রোয়েডিঙ্গার ও রিচার্ড ফাইনম্যানের নাম যত মানুষ জানেন, সেই তুলনায় ডিরাকের নাম অনেক কম জানেন মানুষ। পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত জগতের এই অসাধারণ প্রতিভাধর পল ডিরাকের নাম আজও  অনেকের কাছে অজানাই থেকে গিয়েছে। ড্যানিশ পদার্থবিদ নীলস্ বোর তাকে ‘দ্য স্ট্রেঞ্জেস্ট ম্যান ’ বলতেন।

পুরুষোত্তম চক্রবর্তী: প্রফেসর, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ আফ্রিকা। অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র প্রফেসর, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, আনবিক শক্তি দপ্তর, ভারত সরকার, কলকাতা।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/