শুভ জন্মদিন প্রিয় লেখক সমরেশ বসু

আজ ১১ ডিসেম্বর, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর জন্মদিন। যাদের লেখনিতে  বাংলা গদ্য সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে সমরেশ বসু সেই শীর্ষ সারির প্রতিভাবান লেখকদের একজন। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং সামাজিক নানা অসঙ্গতির সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে উঠেছে। তবে তিনি বাংলা সাহিত্যে এমন সব বিষয় তুলে এনেছিলেন যা নিয়ে এর আগে কেউ লেখার সাহস দেখাতে পারেননি। এ কারণে তাকে মূল্য দিতে হয়েছে অনেক। লেখালেখিকে অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করার সাহস দেখিয়েছেন তাদের অন্যতম সমরেশ বসু।

১৯২৪ সালের এই দিনে ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জ জেলার রাজনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সমরেশ বসু। বাবার নাম মোহিনী মোহন বসু, মায়ের নাম শৈবলিণী বসু। বাবার দেওয়া নাম ‘সুরথনাথ’। সমরেশ বসুর শৈশব কাটে বিক্রমপুরে আর পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকার রোকনপুরে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পরেছেন গেন্ডারিয়ার এক স্কুলে। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় বাবা তাকে পশ্চিমবঙ্গে নৈহাটিতে দাদা মন্মথর কাছে পাঠিয়ে দেন। তারপরও লেখাপড়ায় কখনও মন বসেনি তার। তার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি তার নেয়া হয়নি। জীবনের তাগিদে কাজ করেছেন বিচিত্র সব পেশায়। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। ১৯৪৩-৪৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন ইছাপুরের কামান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন।  এক সময় ট্রেড ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে জেলও খাটতে হয়েছে। মিশেছেন নানা পেশার মানুষের সঙ্গে। জীবনের এইসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার কারণেই সমরেশ বসু এতসব বিচিত্র গল্প যোগ করতে পেরেছেন বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডরে।

বাংলা কথাসাহিত্যে সমরেশ বসু একজনই এবং তার তুলনা তিনি নিজেই। প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যেও লেখালেখিই ছিল তার একমাত্র পেশা। কমিউনিস্ট পার্টি করার কারণে তাকে  ১৯৪৯-৫০ সাল জেলে কাটাতে হয়েছিল। কারাবাস তার জীবনটাকে আমূল বদলে দিয়েছিল। অবস্থানকালে তিনি আলোচিত ‘উত্তরঙ্গ’ উপন্যাসটি লিখেন। কারামুক্ত হয়ে সমরেশ বসু লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেন। পরে এ সম্পর্কে লেখক বলেন-‘১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যাপারে প্রেসিডেন্সি জেলে দীর্ঘ কারাবাস উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এখানেই আমি সমাজের রূপটা চিনতে শিখলাম, বুঝতে পারলাম। জেলে আমি আমার লেখার যথেষ্ট অনুপ্রেরণা পেয়েছি। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনাই আমার লেখার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।’

এর আগে মাত্র ২১ বছর বয়সেই লিখেছিলেন প্রথম উপন্যাস ‘নয়নপুরের মাটি’। পরে এই উপন্যাস নিয়ে পরে এক সাক্ষাৎকারে লেখক বলেন-‘আমার লেখা ‘উত্তরঙ্গ’-এর বহু পূর্বে এ বই আমি লিখেছি। অর্থাৎ সাহিত্য আসরের দরজার চৌকাটটা তখন আমি দূর থেকে উঁকি মেরে দেখেছিলাম। এখন দরজার কাছে (বোধ হয় চৌকাটটা পেরিয়ে?) এসেছি। ইচ্ছেটা আস্তে আস্তে আসরের মাঝখানে গিয়ে বসি।’

এই উপন্যাস যখন ধারাবাহিকভাবে ‘পরিচয়’ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে তখনও সমরেশ হননি সুরথনাথ। তিনি লিখছেন কালকূট ছদ্মনামে। এই নামেই তার সাম্বা ও অমৃত কুম্ভের সন্ধানের মতো বিখ্যাত উপন্যাসগুলো লিখেছিলেন। তাকে সমরেশ বসু নামটি দিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেবশংকর মুখোপাধ্যায়, এক উপন্যাসের নায়কের নাম থেকে। নামটি পছন্দ হলো সুরথনাথের। এরপর থেকেই তিনি সমরেশ বসু।

কলকাতার সাহিত্য মহলে সমরেশ বসু লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পান যে উপন্যাসের দিয়ে সেটি 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে'। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাস পড়ে তখনকার স্বনামধন্য প্রকাশক সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্ত লেখককে সোনার কলম পুরস্কার দেবার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে শারদীয় দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত 'বিবর' উপন্যাস। অনেক সাহিত্য সমালোচক এটি  দশটি শ্রেষ্ঠ বাংলা উপন্যাসের অন্যতম বলে মনে করেন।

সমরেশ বসু সবমিলিয়ে দুই শতাধিক ছোটগল্প একশ উপন্যাস লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে- উত্তরঙ্গ, গঙ্গা, বিবর, প্রজাপতি, দেখি নাই ফিরে, সওদাগর, কোথায় পাবো তারে, নয়নপুরের মাটি, বাঘিনী, চলো মন রূপনগরে, পাতক, মুক্তবেণীর উজানে, টানাপোড়েন, স্বীকারোক্তি, অপদার্থ, সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা, মহাকালের রথের ঘোড়া, শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে, বিপর্যস্ত, শাম্ব, বিটি রোডের ধারে, শ্রীমতি কাফে, অবশেষে, আম মাহাতো, কামনা বাসনা, কে নেবে মোরে, খন্ডিতা, জবাব, তিন পুরুষ, দাহ, তিন ভুবনের পারে, নিঠুর দরদী, পথিক, প্রাণ প্রতিমা, রক্তিম বসন্ত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার অনেক ছোটগল্প ও উপন্যাস নিয়ে ছবিও হয়েছে।

লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তার নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে তার সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনি গোয়েন্দা গোগোল ও গোগোলের কীর্তি নামে চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে।

তবে প্রকৃত সাহিত্য মূল্য কখনই পাননি এই সাহিত্যিক। বরং বিবর ও প্রজাপতির মতো উপন্যাসের জন্য তাকে নানাভাবে নিগৃহীত করা হয়েছে।  তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে অশ্লীল সাহিত্য রচনার অভিযোগ। তার সবচাইতে আলোচিত উপন্যাস প্রজাপতি অশ্লীলতার দায়ে দীর্ঘ ১৮ বছর নিষিদ্ধ ছিল। এই মামলায় লেখক সমরেশ বসু ও প্রজাপতির পক্ষে আদালতে সাক্ষী দিয়েছিলেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু এবং নরেশ গুহ। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালে অশ্লীলতার দায় থেকে মুক্তি পায় এই উপন্যাস।

শখের সাহিত্যিক হওয়ার জন্য নয়, জীবিকার প্রয়োজনেই লিখতেন তিনি। প্রত্যেকদিন সকালবেলা নিয়ম করে বসতেন, লিখতেন একটানা বিকাল ৫টা পর্যন্ত। লেখাটা যেন তার প্রতিদিনের সাধনা। যেহেতু লিখেই সংসার চালাতে হতো তার, সেইজন্য তাকে লিখতে হয়েছে প্রচুর, স্বনামে এবং কালকূট নামে ছাড়াও ভ্রমর ছদ্মনামেও তিনি লিখেছেন প্রচুর। এত লিখলে সাহিত্য মান অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু সমরেশ বসু এ নিয়ে আপোষ করেননি। প্রত্যেক বছরই বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কিছু লেখার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছেন এবং সার্থক হয়েছেন। তার কমিটমেন্ট ছিল নিজের কাছে, মহাকালের দিকে তিনি অবহেলার সঙ্গে টুসকি মেরেছেন।

সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি ও আনন্দ পুরস্কার।

ক্ষণজন্মা লেখক সমরেশ বসু ১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ মারা যান। মৃত্যুকালেও তার লেখার টেবিলে ছিল ১০ বছরের অমানুষিক শ্রমের অসমাপ্ত ফসল শিল্পী রামকিংকর বেইজের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে ’।

আজ  এই লেখকের ৯৭তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে রইলো অশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি। শুভ জন্মদিন প্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসু।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/