আজও অবহেলিত দুঃসাহসী নারী বীর মুক্তিযোদ্ধারা

আনজুমান আরা শিল্পী

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তার ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসটি শেষ করেছেন এভাবে: যুদ্ধে একটি পা হারিয়ে প্রেমিক ফিরে এসেছে স্বাধীন দেশে। প্রেমিকা তখন পাকিস্তান সেনা কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার ফলে গর্ভবতী। দুজনের যখন দেখা হয় তখন প্রেমিকা প্রেমিককে বলে, ‘ভালো করে দেখো হামাক। তুমহি দেছো পা। হামি দিছি জরায়ু। তুমহার পায়ের ঘা শুকায়ে গেছে। কয়দিন পর আমারও জরায়ুর ঘা শুকায়ে যাবে। আমি ভালো হয়ে যাব’। কি হৃদয়বিদারক কথা। একজন বীরঙ্গনা নারী হিসেবে যুদ্ধে নারী-পুরুষের সমান অংশীদারিত্বের কথা এভাবে উল্লেখ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলার প্রতিটি মা-বোন একেকজন একেকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। কেউ নির্যাতিত হয়ে কেউবা ধর্ষণের শিকার হয়ে আবার কেউ তাদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ অথবা সাহায্য করে, আবার কেউ স্বামী, পুত্র, বাবা হারিয়ে। দুঃসাহসী নারীরা যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবে কাজ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নারীর জীবন অধ্যয়নের একটি বড় দিক। মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সব ধর্মের নারীই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কেবল বাঙালি নয় সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আদিবাসী নারীরাও। এই যুদ্ধে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ ছিল জীবন বাজি রাখার ঘটনা। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে মূলধারায় স্থাপন না করার ফলে নারীর প্রকৃত ইতিহাস যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। নারী মুক্তিযুদ্ধে যে গৌরবগাঁথা রচনা করেছিল তা ধর্ষিত এবং নির্যাতিত নারীর ভূমিকায় অদৃশ্য হয়ে আছে। বহু নারী আছেন যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন, সেবা করেছেন, অনাহারী-অর্ধাহারী ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কখনও মমতাময়ী মায়ের মতো, কখনও বোনের মতো। নিজে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। এই অসামান্য অবদান অনেককাল রাষ্ট্র, সমাজ, জনগণ কেউ তেমন গুরুত্বের সাথে দেখেনি। কোনো মতে দায়সারা গোছের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েই নিজেদের ধন্য মনে করেছিল। ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মত সরকার নারী উন্নয়ন নীতিতে নারীদের মুক্তিযুদ্ধের অবদান স্বীকৃতি দেন। যুদ্ধের সময় পরিবার, সমাজ, বাঙ্কারে, যুদ্ধ ময়দানে, শরণার্থী শিবিরে নারীর সরব উপস্থিতি এই স্বীকৃতি পেতে সাহায্যে করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দুই নারীকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। একজন তারামন বিবি আরেকজন সেতারা বেগম। তারামন বিবি দেশের মধ্যেই গাইবান্ধা অঞ্চলে দুই-তিনটা সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আর সেতারা ইন্ডিয়াতে শরণার্থী শিবিরে আর্মি মেডিকেল কোরে স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছিলেন। তাদের ১৯৯৫ সালে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ১৯৯৫ সালে সন্ধান পাওয়া যায় আরো এক নারীকে তার নাম কাঁকন বিবি। সিলেটের সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজারে লক্ষ্মীপুর গামের এই খাসিয়া নারী অন্তত ২০টি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি খাসিয়া বেটি নামেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বেগম সুফিয়া কামাল গড়ে তুলেছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’। তার কার্যক্রম শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সারাদেশে ছড়ানো ছিল। তখনকার কিছু নারীদের আমরা স্মরণ করতে পারি। যেমন : পাবনায় নেতৃত্ব দেন রাকিবা খাতুন, ঈশ্বরদীতে জসিম ম-ল, বরিশালে মনোরোমা বসু, কুমিল্লায় সেলিনা বানু। আরো অনেক নাম না জানা মা-বোনেরা। পুরুষের পাশাপাশি নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সাহসের ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। যুদ্ধের সময় অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক বাঙালি নারী। তাদের মধ্যে কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এসব নারী সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গোবরা, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। গোবরা ক্যাম্পে মেয়েদের দেওয়া হতো তিন রকম ট্রেনিং। যেমন : সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং, অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অনেক নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের এত অবদান থাকা সত্ত্বেও নারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ কোনো স্বীকৃতি পাননি। অনেক নারীযোদ্ধাই সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছেন, কেউ তাদের খবরও রাখেনি। যুদ্ধের সময় যদিও বাংলাদেশ সরকারের নীতিতে নারীদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া, গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এবং প্রশাসনিক কাজের নেতৃত্বে নারী সাংসদদের দায়িত্ব দেওয়া ইত্যাদির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি তারপরও এ ক্ষেত্রে নারীরা ছিলেন অনড়। তারা সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়ার তীব্র আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছিলেন। কলকাতায় রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রতিনিধি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় গোবরা ক্যাম্পের ৩শ’ তরুণীকে গোবরা ও ‘বিএলএফ’ ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে গীতা মজুমদার, গীতা কর, শিরিন বানু মিতিল, ডা. লাইলী পারভীন অস্ত্রচালনা শেখার পরও তাদের সম্মুখ সমরে যেতে দেওয়া হয়নি। নারীদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশ্নে সেই সময় যুদ্ধকালীন সরকারের ভেতরেই দ্বিধা ছিল। অন্যদিকে বিভিন্ন যুবশিবিরে যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য অস্ত্রসংকটে অপেক্ষায় ছিলেন বিপুলসংখ্যক তরুণ। ছেলেরা যেখানে অস্ত্র পাচ্ছে না, যুদ্ধে যেতে পারছে না, প্রশিক্ষণ পাচ্ছে না, সেখানে মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেওয়ার গুরুত্ব বাংলাদেশ সরকার ও রাজনীতিবিদদের প্রচলিত ধ্যান ধারণায় ছিল না। নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সে সময় মোটেও ন্যায়সঙ্গত হয়নি। তারপরও আলমতাজ বেগম ছবি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। বরিশালের করুণা বেগম ছিলেন অকুতোভয় মুক্তিসেনা। পুরুষের পোশাকে এ যুদ্ধে পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ করেছিলেন শিরিন বানু মিতিল, আলেয়া বেগম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে এটা এখন সহজেই অনুমেয়, ১৯৭১ সালে এবং পরবর্তী সময়ে প্রায় দুই দশকজুড়ে এ দেশে নারী মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় তেমনভাবে আলোচিত হয়নি। যে কারণে একজন বীথিকা বিশ্বাস বা শিশির কণা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের গানবোট গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিলেও যুদ্ধ পরবর্তীকালে তারা যথাযোগ্য বীরের মহিমায় অভিসিক্ত হননি। উপরন্তু তাদের ললাটে জোটে সামাজিক লাঞ্ছনা। যুদ্ধ শেষে এই বীথিকা বিশ্বাস ও শিশির কণাকে তাদের পরিবার ও সমাজ গ্রহণ করেনি। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে এমন উদাহরণ অসংখ্য।

  • মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছিলেন একাত্তরের জননী গ্রন্থের লেখক চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। একাত্তরে নির্যাতনের শিকার অনেক নারীর মতো এ নারীর জীবনেরও ট্র্যাজেডি হলো, যুদ্ধের পর স্বামীগৃহে তার ঠাঁই মেলেনি। যুদ্ধকালে যেসব নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের প্রয়োজন ছিল, স্বামীহারা বিধবাদের দরকার ছিল আশ্রয়। এসবই তখন বড় করে দেখা হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৭১-এর নারী নির্যাতনকে বীরত্বের মহিমা দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছে রাষ্ট্র। ফলে নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’আখ্যা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালের নারীসমাজকে অবলোকন করা দরকার আন্তরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে। প্রথমত বুঝতে হবে যুদ্ধের সময় দেশের সর্বত্র যে বিপুল নারী নিগৃহীত হয়েছেন তা কেবল তারা নারী বলেই। নারীদের এ-ও একধরনের যুদ্ধ, তার শরীরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ আর সেটা বুঝতে সময় লেগেছে রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবারই। মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধার মতোই নারী আত্মোৎসর্গ করেছেন সেটা বুঝতেও সময় লেগেছে অনেকের।
  • ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে নারীরা ও ছাত্রীসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। এই নারীরাই আবার অংশগ্রহণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন ও অভ্যুত্থানে নারীরা ও ছাত্রীসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। এই নারীরাই আবার অংশগ্রহণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এসব নারীর মধ্যে স্বল্পসংখ্যক ছিলেন শ্রমজীবী নার্স, সমাজসেবী, গৃহকর্মী ও চাকরিজীবী। অধিকাংশই ছিলেন গৃহিণী। এসব নারীর কেউ কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের ভেতরে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভারতে স্থাপিত হাসপাতালে নার্স হিসেবে, চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করেছেন কয়েকজন। দেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পৌঁছে দেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করেছেন অনেকে। এ নারীরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে পরিমাপ করা যাবে না। এ বিশালতায় যেসব নারী বিভিন্ন অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন তাদের অনেকের নাম এখনও অজানা। তবে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীরা সারা দেশেই তৎপর ছিলেন। তারা বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষকে বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত হওয়ার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছেন। মমতাজ বেগম, কাজী রোকেয়া সুলতানা, বেবী মওদুদ, রানী খান, রোকেয়া কবীর, মনিরা আক্তার প্রমুখ নারী জনমত গঠনের পাশাপাশি ফিজিক্যাল ফিটনেস, মার্চপাস্ট, অস্ত্র চালনা, ফাস্টএইড প্রদান এবং আত্মরক্ষার নানা কৌশল- এসব ব্যাপারে ট্রেনিং নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষা দিতেন। বদরুন্নেসা আহমেদ পুনর্বাসন কার্যকলাপ ও মহিলা সংগঠন মুজিবনগরের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন একাত্তরে। বেগম নূরজাহান খুরশীদ বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকা- পরিদর্শন ও রিপোর্ট আদান-প্রদানের কাজ করলেও পরবর্তী সময়ে কূটনীতিকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সাজেদা চৌধুরী তার বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। সেই সঙ্গে সচেতন করতেন কোন কোন বিষয়ে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ মুক্তিযুদ্ধে মহিলা মুক্তিফৌজের হাল ধরেছিলেন। এ মহিলা কমিটি মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছিল। এ কমিটির প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ ছাড়াও গীতারানী নাথ, নিবেদিতা দাস, সুধারানী কর মঞ্জুদেবী, সুষমা দাস ও রমা রানী দাসের নাম উল্লেখযোগ্য। কাজের সুবিধার্থে প্রশিক্ষণ সেবা, ধাত্রীবিদ্যা, প্রাথমিক চিকিৎসা, কুটিরশিল্প, মুদ্রণ ও রামকৃষ্ণ মিশন এরকম কয়েকটি সাব ইউনিটে বিভক্ত হয়ে কাজ করেছেন নারীরা। তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণ সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত কানন দেবী, উপাসনা রায়, সুধারানী কর, পূর্ণিমা রানী দাস ও নিপা রানী মুজমদারের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ, শুক্লা রানী দে, হেমলতা দেব ছাড়াও আরও অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। নাজিয়া ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। সেলিনা বানু সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে তৎপর ছিলেন। এসব কাজে বেগম মুশতারী শফী, মতিয়া চৌধুরী, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, রীনা খান প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য। কয়েকজনের কথা বললে বোঝা যাবে নারীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কত বড় সহায়কশক্তি ছিল। সাধারণ মানুষ জানতে পারবেন যুদ্ধ নারীকে কত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়ার মতো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি পায়নি। অদৃশ্য হয়ে গেছে এসব নারী। এগিয়ে আছে পুরুষরা। কারণ ক্ষমতা, রাজনীতি এবং পুরুষতন্ত্রের সুবাদে পুরুষরা সুযোগ গ্রহণের মুখ্য ভূমিকায় থাকে। সাংস্কৃতিক প্রণোদনায় সর্ববৃহৎ ক্ষেত্র ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। স্বাধীনতাকামী জনগণের মনোবল দৃঢ় রাখার উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে নারীরা। খবর পাঠ করে, কথিকা পড়ে, গান গেয়ে বেতারে অনবরত প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছে তারা। শিল্পীরা গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধ শিল্পী সংস্থা। ভারতের বিভিন্ন স্থানে সংগীত পরিবেশন করে তারা সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এ গ্রুপটির কর্মকা- নিয়ে পরবর্তীকালে ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এছাড়া সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, গেরিলা যুদ্ধে শত্রুর অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রেকির ভূমিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রন্ধনশালায়, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করে, হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রƒষায়, গ্রামে-শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দান করে, শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে আবার অস্ত্র হাতে লড়াই করে, বিভিন্ন দূতাবাসে প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে, সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে জনযুদ্ধের সাফল্যকে নিশ্চিত করেছিল নারীরা। তাদের ব্যতিক্রমী অবদান হিসেবে তিনজন নারীকে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল। বীরত্বগাঁথার এমন অবদান সত্ত্বেও সাংগঠনিক প্রতিনিধিত্বের অভাবে অসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধা আড়ালে পড়ে থাকেন। তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের পরিচিতি সংরক্ষণ করার কাজটিও উপেক্ষিত হয়ে এসেছে দেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ব্যাপৃত অনুসন্ধানীদের কাছে প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাহত সৈনিকদের সহায়তা করতে নারীরা নিজেদের জীবনোৎসর্গ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে মুজিবনগর সরকার একটি নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচে ৩২ জন বাঙালি নারী এখান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও যুদ্ধক্ষেত্রে সেবাদানের জন্য পাঠানো হয়। এ ছাড়াও অনেক শিক্ষিত ছাত্রছাত্রী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অল্প কিছুদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে বিভিন্ন শিবিরে গমন করেন। ২নং সেক্টরে বাংলাদেশ সরকারের ১টি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ হাসপাতালে বহু নারী সেবিকা দিন-রাত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাদান করেন। সেবাকর্মে দলবদ্ধভাবে নিয়োজিত হতে আগরতলা আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী পূর্বাঞ্চল শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়াও নারীরা বিভিন্ন হাসপাতালে ও শরণার্থী শিবিরে সেবাদান করতেন।
  •  
  • যে নারীদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো তাদের যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে ‘বীরাঙ্গনা’খেতাবে ভূষিত করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তিনি পাবনার বেড়া উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে যান বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করতে। সে অনুষ্ঠানে কয়েকজন নারী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। তারা যুদ্ধকালীন সময়ে কিভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন সে সব ভয়ঙ্কর সব ঘটনার কথা বলেন। কথাগুলো শুনে বঙ্গবন্ধুর চোখে জল চলে আসে। বঙ্গবন্ধু তাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন। তারপর বাঁধ নির্মাণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিতা মহিলারা সাধারণ মহিলা নয় তারা এখন থেকে ‘বীরাঙ্গনা’খেতাবে ভূষিত। কেননা দেশের জন্যই তারা ইজ্জত দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের অবদান কম নয় বরং কয়েক ধাপ উপরে যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই সব স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশ্যে আমি বলছি যে, আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা পিতা হয়েছেন। তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা’। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের বীর নারীদের বঙ্গবন্ধু যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছেন। তাদের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩-১৯৭৮) পরিকল্পনায় স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে দেশে যুদ্ধ শিশু নিয়ে প্রশ্ন উঠে পরিবার সমাজে। এদের মেনে নেয়ার মত মানসিকতা ছিল না মানুষের। কিন্তু এ শিশুরা বীরাঙ্গনাদের সন্তান এমন উপলদ্ধি থেকেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যেসব শিশু জন্মাবে তাদের জন্মাতে দাও। অনেক দম্পতি সন্তানের জন্য হাহাকার করে। তাদের সেই শিশুদের দেয়া যেতে পারে। তিনি সে সময় বিদেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তকের ব্যবস্থা করেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল আইনের। তিনি আন্তর্জাতিক শিশু দত্তক আইন এবং গর্ভপাত আইন নামে দুটি অধ্যাদেশ জারি করেন। বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা। যার মাধ্যমে ৭১ সালের নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুদের পুনর্বাসন এবং আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল অর্গানাইজেশন ফর রিহ্যাবিলিটেশন, মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটির মাধ্যমে বহু যুদ্ধশিশুকে বিদেশে দত্তক দেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো দত্তক হয়নি এমন শিশুদের বিভিন্ন শিশুসদনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। এমন মহৎ কাজের পেছনে একমাত্র অবদান ছিল বঙ্গবন্ধুর। একজন পিতা যে, কন্যার সুখ-দুঃখে পাশে থাকে তার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু। তিনি ৭১ ‘এর মুক্তিযোদ্ধাদের বীর শ্রেষ্ঠ, বীর প্রতীক খেতাব দেয়ার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা নারীদের জন্য দিয়েছেন বীরাঙ্গনা খেতাব। তার এ উচ্চমার্গীয় চিন্তার কাছে শ্রদ্ধায় অবনত হয় দেশ ও জাতি।মহান মুক্তিযুদ্ধে এভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলার নারী সমাজ তাদের সর্বংসহা চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে পাক সেনার বিরুদ্ধে বুকটান দাঁড়িয়েছিল বলেই স্বপ্নের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছিল বলেই আমাদের বিশ্বাস। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। নারী-পুরুষের অবদান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা রচিত হোক মুজিব জন্মশতবর্ষে।
  • ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/