বীর প্রতীক খেতাব পাওয়া ৩ নারী মুক্তিযোদ্ধা

বাম থেকে তিন নারী বীর প্রতীক সিতারা বেগম, তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি

মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। স্বাধীনতার যুদ্ধে লড়াইরত বাঙালি যুবকদের পেছনে থেকে অনুপ্রেরণা কিংবা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেননি নারীরা। বন্ধুক হাতে রণাঙ্গণে পুরুষ যোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন এমন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। এদের মধ্যে স্বীকৃতস্বরূপ বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিন নারী। এরা হলেন—ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম,  তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি। তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি ২০১৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন, এর আগে দীর্ঘকাল ধরে ছিলেন বিস্মৃতির অন্ধকারে ছিলেন এই দুইজন। প্রথম বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত সিতারা বেগম দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছেন প্রবাসে। তাই তাদের কারও অনুভূতি জানা সম্ভব হচ্ছে না আমাদের পক্ষে। আমরা কেবল মুক্তিযুদ্ধে তাদের অসীম অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।

সিতারা বেগম

 ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্ম সিতারা বেগমের। বাবা মোহাম্মদ ইসরাইল এবং মা হাকিমুন নেসা। তবে বৈবাহিক সূত্রে তিনি সিতারা রহমান নামে পরিচিত। স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন সিতারা। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের ভেতর তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা মোঃ ইসরাইল মিয়া পেশায় ছিলেন আইনজীবী। যুদ্ধে সময় তার বড় ভাই এটিএম হায়দারও সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।  তার সাথে কিশোরগঞ্জে শৈশব কাটান সিতারা বেগম। সেখান থেকে মেট্রিক পাশ করার পর হলিক্রস কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করার পর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনামেডিকেলে লেফটেন্যান্ট হিসাবে যোগ দেন।

১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোতে সিতারা বেগম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। সেই সময় তার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা মেজর এ.টি. এম.হায়দার পাকিস্তান থেকে কুমিল্লায় বদলি হয়ে আসেন। তিনি কুমিল্লার ৩য় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিতারা ও তার ভাই হায়দার ঈদের ছুটি পালন করার জন্য তাদের কিশোরগঞ্জের বাড়িতে যান। কিন্তু সেই সময়ে দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে।হায়দার তার বোনকে ক্যান্টনমেন্টে আর ফিরে না যাবার জন্য বলেন। পরবর্তীতে তিনি তার বোন সিতারা, বাবা-মা ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে পার্শবর্তী দেশ ভারতে পাঠান। কিশোরগঞ্জ থেকে মেঘালয়ে পৌছাতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগে যায়।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য মেলাঘরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল নামে ৪৮০ শয্যার একটি হাসপাতাল ছিলো। ঢাকা মেডিকেলের শেষ বর্ষের অনেক ছাত্র সেখানে ছিলো। ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা সেক্টর-২ এর অধীনে সেখানের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। হাসপাতালে একটি অপারেশন থিয়েটার ছিলো। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বাঙালি ছাড়াও সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোকজন চিকিৎসাসেবা নিত।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ধরে দিনের পর দিন এ হাসপাতালে ডাক্তার সিতারার কাজ ছিল অসাধ্য সাধন করে যাওয়া। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসা গুলিবিদ্ধ, স্প্লিন্টারের আঘাতে ঝাঁঝরা, গুরুতর জখম মুক্তিযোদ্ধাদের সারিয়ে তুলতে হতো খুব সামান্য আর সাধারণ ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে। ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব কেমন ছিল তা বোঝা যায় হাসপাতালের কাঠামোগত বর্ণনা থেকেই। সিতারা বেগমকে কেবল ওষুধ সংগ্রহের জন্য নিয়মিত আগরতলা যেতে হতো। তার রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিপুণ পরিচালনার ফলে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধরত ভারতীয় সেনাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে আনা সম্ভব হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেডিওতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সংবাদ শুনে ঢাকা চলে আসেন ডঃ সিতারা। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে তার ভাই মেজর হায়দার নিহত হলে ডা. সিতারা ও তার পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী ভাবে থাকা শুরু করেন।

তারামন বিবি

স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেটে তার বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৯৪। গেজেটে নাম মোছাম্মৎ তারামন বেগম। তারামন বিবি ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[৪] তার বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মায়ের নাম কুলসুম বিবি তারামন বিবি ১১ নং সেক্টরে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন।[২][৫] তখন ১১ নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।[৬] যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিলো মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। কিন্তু পরবর্তিতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনা শেখান।

পরবর্তীতে সহকর্মীদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের সাথে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক বিমল কান্তি দে প্রথম তার সন্ধান পান। এ কাজে বিমল কান্তিকে সহায়তা করেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী।

এরপর নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। সেই সময় তাকে নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবির হাতে বীরত্বের পুরস্কার হাতে তুলে দেয়।

তারামন বিবিকে নিয়ে আনিসুল হকের লেখা ‘বীর প্রতীকের খোঁজে’ নামক একটি বই রয়েছে। আনিসুল হক রচিত ‘করিমন বেওয়া’ নামক একটি বাংলা নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন তারামন বিবি।

তারামন বিবির স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তিনি কুড়িগ্রামের রাজিবপুরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। তারামন বিবি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থায় ভুগছিলেন। ২০১৮ সালের  ১লা ডিসেম্বর তিনি নিজ বাড়িতে মারা যান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া তালতলা কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।

কাঁকন বিবি

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীরযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও গুপ্তচর কাঁকন বিবি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে ৫ নং সেক্টরের গুপ্তচরের কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। তবে এ বিষয়ে সরকারি ভাবে কোন গেজেট প্রকাশিত হয়নি।

তার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে। কাঁকন বিবি, আসল নাম কাঁকাত হেনিনচিতা। মুক্তিবেটি নামে পরিচিত এই নারী খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল বাড়ি ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে। ১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নতুন নাম হয় নুরজাহান বেগম।

১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ তিনি এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। কন্যাসন্তান জন্মদেবার ফলে স্বামীর সাথে তার মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে মৌখিক ছাড়াছাড়ি হয়। পরবর্তীতে এপ্রিল মাসে তার সাথে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের বিয়ে হয়। মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। দুই মাস সিলেটে স্বামীর সাথে বসবাস করার পরে তিনি আগের স্বামীর ঘর থেকে সখিনাকে আনতে যান। মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসার পর তিনি স্বামীকে না পেয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তার স্বামী বদলি হয়ে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোন এক ক্যাম্পে আছেন।

স্বামীকে খুঁজতে বের হন তিনি। সীমান্তবর্তী ঝিরাগাঁও গ্রামে জনৈক শহীদ আলীর আশ্রয়ে শিশুকন্যাকে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে যান তিনি। ১৯৭১ সালের জুন মাস তখন। পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন, তাদের বাঙ্কারে দিনের পর দিন অমানুষিকভাবে নির্যাতন করে তাকে ছেড়ে দেয় তারা। এরপরেই কাকন বিবি স্বামীকে পাবার আশা ত্যাগ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হবার তাড়না লাভ করেন। জুলাই মাসে তার সাথে দেখা হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দেখা করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তার সাথে সেক্টর কমাণ্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের সাথে দেখা করিয়ে দেন। তার উপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করার। তিনি অসমসাহসিকতার সাথে বিভিন্ন রূপে পাকিস্তানীদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করেন। তার সংগৃহীত তথ্যের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সফল আক্রমণ চালান।

গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাক বাহিনীর হাতে পুনরায় ধরা পড়েন তিনি। এবারে একনাগাড়ে ৭ দিন পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকারেরা তাকে বিবস্ত্র করে তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেয়া হয়। মৃত ভেবে অজ্ঞান কাকন বিবিকে পাক বাহিনী ফেলে রেখে যায়। কয়েকদিন পরে জ্ঞান ফিরে আসলে তাকে উদ্ধার করে বালাট সাবসেক্টরে নিয়ে আসা হয়। সুস্থ হয়ে তিনি পুনরায় ফিরে আসেন বাংলাবাজারে। অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে। পরবর্তীকালে তিনি সম্মুখ যুদ্ধ আর গুপ্তচর উভয় কাজই শুরু করেন। এরপরে প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি।[ ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাক সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। এই যুদ্ধে তার দেহে কয়েকটি গুলি বিদ্ধ হয়।

দেশ স্বাধীন হলে কাকন বিবি দোয়ারাবাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে এক ব্যক্তির কুঁড়েঘরের বারান্দায় মেয়ে সখিনাসহ আশ্রয় নেন। এর পরের প্রায় দুই যুগ তিনি ছিলেন সবার চোখের অন্তরালে। ১৯৯৬ সালে স্থানীয় সাংবাদিক বিষয়টি সকলের গোচরে নিয়ে আসলে দেশব্যাপী এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে এক একর খাস জমি প্রদান করেন। সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান তাকে ঐ জায়গার ওপরে একটি ছোট কুঁড়েঘর নির্মাণ করে দেন।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী তাকে বীরপ্রতীক উপাধীতে ভূষিত করার ঘোষণা দেন। কিন্তু আজও তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি। ২০১৮ সালের ২১ মার্চ ১০৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা।

তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/