বিজয়ের আনন্দ বেদনায়

সুলতানা রিজিয়া

‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে

বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা

আমরা তোমাদের ভুলবো না’

না, আমরা তাদের ভুলিনি। বাংলার জনগণ ভুলেননি। বাঙালি জাতি ভুলেননি। বাংলার জল, বাংলার স্থল, বাংলার সবুজিয়া বনানীও ভুলেনি। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস বাংলাদেশের মানুষের কাছে একাধারে আনন্দের এবং বেদনার দিন। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদানে অর্জিত স্মরণীয় দিন।

একাত্তরের ২৫শে মার্চ বাঙালি জাতির ললাটে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের জনগনকে শায়েস্তা করার অভিলাসে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের নিরীহ ঘুমন্ত মানুষকে নির্বিচারের হত্যা করেছিলো। এই গণহত্যার রক্তের দাম রাখতেই সূচনা হয়েছিলো বিশ্বের অভূতপূর্ব মুক্তিযুদ্ধ, মরনপণ লড়াই। শান্তিপ্রিয় স্বাধীনতাকামী আপামর বাঙালি জাতি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমরাস্ত্রে সজ্জিত সুদক্ষ শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরেছিলো। হাতে তুলে নিয়েছিলো সাধারণ অস্ত্র। প্রাথমিক পর্যায়ে লাঠি সোটা, দা, বটি, কুড়াল, লগি বৈঠাকে সম্বল করে ঘরছাড়া হয়েছিলো। অতঃপর আধুনিক প্রশিক্ষণ শেষে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অতন্দ্র সৈনিক হিসাবে সন্মুখ সমরে থেকেছে। তাদের জীবনপণ সেই যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদদের এক সাগর রক্তধারায় আমাদের এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানী শত্রুরা ভেসে গিয়েছিলো, বীরত্বের গরিমায় উড্ডিন লাল সবুজ পতাকার হিল্লোল ঊর্দ্ধগগনে আন্দোলিত হয়েছিলো। মুছে গেয়েছিলো শত সহস্র মা বোনদের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা ও লজ্জার গ্লানি।

মুক্তিযোদ্ধার সেই নয়মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, জীবন দানের করুণ শোকগাঁথা বিশ্বের ইতিহাসকে করেছিলো চমৎকৃত, মহিমান্বিত। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে, বাঙালি জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলো।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজুবুর রহমান ৭ মার্চে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরার ডাক দেন। তার সেই সেই আহ্বানে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া দুর্বার দুর্জয় উত্তাল সমুদ্র স্রোতসম জনসাধারণ একাট্টা হয়েছিলো। বাংলা, বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য সাধারণ নেতৃত্ব, আদর্শ, দিক-নির্দেশনা মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুর কবল থেকে বাংলার মাটি শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতার অভিষ্ঠলক্ষে পৌঁছানো তরান্বিত করেছিলো। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের কালজয়ী সেই ভাষন ছিলো বাঙালি জাতির কাছে আত্মউৎসর্গের প্রেরণা, মহান আহ্বান।

বাঙালি জাতি তাদের ঘরে যা কিছু ছিলো তাই নিয়েই যুদ্ধের দামামায় গর্জে উঠেছিলো। শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে আপামর জনগোষ্ঠি এই জীবনপণ সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলো। ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী ময়দানে পরাজিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ৯১,৬৩৪ জন সদস্য ছিলো। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠনিকভাবে আত্মসমর্পন করে। ঢাকার রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পন করেন। পাকিস্তান সরকারের ২৩ বছরের জোর, জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার ও দখলদারিত্বের অবসান হয়। পূর্ববাংলার মানুষ বিজয়ের আনন্দে জীবনের পথে ঘুরে দাঁড়ায়।

১৬ ডিসেম্বর আমাদের গৌরবময় বিজয়ের দিন। লাখো শহীদের আত্মত্যাগে আর্জিত বিজয়ের মুহূর্ত। এর মাত্র দুইদিন পূর্বে ১৪ ডিসেম্বরে এদেশকে মেধাশূন্য করার নীলনকশায় ছলে বলে কৌশলে বুদ্ধিজীবী হত্যার পথ বেছে নিয়েছিলো। আমরা হারিয়েছি আমাদের সোনার সন্তানদের। যাদের জ্ঞান, মনীষা ও অধ্যবসায় এদেশের মানুষকে পথ দেখিয়েছিলো।

এর আগে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তেজদীপ্ত স্বাধীনতার আহ্বানে ভীত সন্ত্রস্ত পাকিস্তানীর হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় ২৫ শে মার্চের কালোরাতে। নিরীহ জনগনের রক্তের স্রোতে ফুটে উঠেছিলো স্বাধীনতার রক্তরবি। তারই আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিলো বাঙালির স্বাধীনতার পবিত্র তৃষ্ণা। সেই তৃষ্ণাই এই দেশকে দিতে পেরেছে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ, বাংলাদেশ। যে দেশের মাটিতে আমরা প্রাণখুলে গাইতে পারি- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’

সেই স্বাধীনতার সোনালি সূর্যের উজ্জ্বলতায় নতুন করে, দীপ্তিময়তায় আমাদের স্মরণের আলো-ছায়ায় আন্দোলিত হয় লাল সবুজ বিজয়ের আনন্দ। সেই আনন্দে আমরা যেমন উচ্ছ্বল হই, তেমনি ভাবেই প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায় মুহ্যমান থাকি। শ্রদ্ধায়, কৃতজ্ঞতায় এবং মুগ্ধতায় শহীদদের স্মরণ করি। তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি। এই দেশ, বাংলাদেশকে বিশ্বসেরা ভেবে আমরা পুলকিত হই। মনে মনে আওড়াই-

‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি

সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি!’

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/