শুভ জন্মদিন প্রিয় লেখক সৈয়দ শামসুল হক

আজ ২৭ ডিসেম্বর আমাদের সাহিত্য জগতের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। কেননা আজকের দিনে জন্ম নিয়েছেন দেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, চিত্রনাট্যসহ সাহিত্যের সকল শাখায় সার্থক বিচরণের জন্য তিনি 'সব্যসাচী লেখক' হিসাবে সমধিক পরিচিত। তার লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছর ব্যাপী বিস্তৃত। তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন, যা একটি রেকর্ড। কেননা এত অল্প বয়সে আর কোনও কবি বা লেখক এই পুরস্কার পাননি। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো সম্মানজনক স্বীকৃতি।

প্রাথমিক ও কর্মজীবন

সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। আর মা হালিমা খাতুন গৃহবধূ। তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।

কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক (বর্তমানের এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সৈয়দ শামসুল হক। তার বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে ডাক্তারি পড়বে। কিন্তু তিনি তো কলেজে ভর্তি হওয়ার বদলে ভারতের মুম্বাই শহরে পালিয়ে যান সৈয়দ শামসুল হক। সেখানে তিনি বছরখানেকের বেশি সময় ধরে এক সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫২তে  তিনি দেশে ফিরে এসে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে মানবিক শাখায়। আইএ (এইচএসসি) পাসের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। কিন্তু ততদিনে লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়েছেন সৈয়দ শামসুল হক। তাই আর স্নাতকের পড়া অসামাপ্ত রেখেই ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে দেন।

সৈয়দ হক তার বাবা মারা যাবার পর অর্থকষ্টে পড়ে চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। তিনি প্রথমে মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেন। পরে তোমার আমার, শীত বিকেল, কাঁচ কাটা হীরে, ক খ গ ঘ ঙ, বড় ভাল লোক ছিল, পুরস্কারসহ আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন। বড় ভাল লোক ছিল ও পুরস্কার নামে দুটি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে বিবিসির বাংলা খবর পাঠক হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপণের খবরটি পাঠ করেছিলেন। পরে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দৃঢ়কণ্ঠ সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করেন।

বাংলা সাহিত্যে অবদান

সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখির সূচনা শৈশবে। মাত্র এগারো-বারো বছর বয়সেই তিনি কবিতার দুটি পদ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।  ১৯৪৯-৫০ সালের দিকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ব্যক্তিগত খাতায় লিখে ফেলেন ২০০টির মতো কবিতা। তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে, ফজলে লোহানী সম্পাদিত 'অগত্যা' পত্রিকায়। তার প্রথম প্রকাশিত গল্পের নাম 'উদয়াস্ত'।

তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ একদা এক রাজ্যে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে । পরে বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, পরাণের গহীন ভেতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কেরাম, বৃষ্টি ও জলের কবিতা কাব‌্যগ্রন্থগুলো তাকে পাঠকমহলে জনপ্রিয় করে তুলে। সৈয়দ হক মৃত্যুর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে তার শেষ কবিতা লিখেন। কবিতার নাম আহা, আজ কি আনন্দ অপার!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী থাকার সময়ই সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম উপন্যাস দেয়ালের দেশ প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। তার রচিত এক মহিলার ছবি (১৯৬১), অনুপম দিন (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪) উপন্যাসগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। ষাটের দশকে তার রচিত উপন্যাসগুলো পূর্বাণী পত্রিকায় ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হত। তবে তার খেলারাম খেলে যা উপন্যাসটি নিয়ে পাঠকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অনেকে সমালোচক এটিকে যৌনাশ্রিত উপন্যাস বলে উল্লেখ করে থাকেন। যদিও নিজের এই সাহিত্যকর্মকে 'এদেশের সবচেয়ে ভুল বোঝা উপন্যাস' হিসেবে অভিহিত করেছেন সৈয়দ শামসুল হক।

একজন নাট্যকার হিসেবেও সফল সৈয়দ হক। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত তার ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’এবং  ফকির বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’নাটক দুটি বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সৃষ্টি। তার অন্যান্য নাটকের মধ্যে নারীগণ, যুদ্ধ এবং যোদ্ধা, ঈর্ষা, এখানে এখন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য

পুরস্কার ও সম্মাননা

লেখালেখির স্বীকৃতি হিসাবে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন এই সব্যসাচী লেখক। তার মধ্যে  বাংলা একাডেমি পুরস্কার ১৯৬৬, একুশে পদক ১৯৮৪,  আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ১৯৬৯, চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ১৯৮২ ও ১৯৮৩,আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮৩, একুশে পদক ১৯৮৪, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১১ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

পারিবারিক জীবন

বাংলাদেশের প্রথিতযশা লেখকা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক তার স্ত্রী। এই লেখক দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে।

মৃত্যু

ফুসফুসে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সৈয়দ শামসুল হক। পরদিন তৃতীয় দফা কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

আজ তার ৮৬তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/