ভূমিহীন বীর মুক্তিযোদ্ধার বসবাস রেললাইনের ধারের বস্তিতে

স্ত্রীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল

লালমনিরহাট থেকে হাসানুজ্জামান হাসান

জীবনযুদ্ধে পরাজিত ভূমিহীন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল ঠাঁই নিয়েছেন লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার রেল লাইনের ধারে গড়ে উঠা বস্তিতে। কেননা সরকার ঘোষিত মুক্তিযোদ্ধার নামে বরাদ্দকৃত বাড়ি তার ভাগ্যে জোটেনি। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরেও আজ তাই বাস্তুহারা এই মুক্তিযোদ্ধার পরিবারটি। ৭০ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা মোজ্জাম্মেলের ভারতীয় তালিকা  ৪৩৩৯৫, লালমুক্তিবার্তা নং ৩১৪০২০০৮০ ও বেসামরিক গেজেট নম্বর ৬৭৪।

পিতা মাতার একমাত্র সন্তান মোজাম্মেল। মুক্তিযুদ্ধের আগে আগেই তার বাবা রেলওয়ের সাবেক কর্মচারি মৃত সেনার উদ্দিন ছেলেকে শখ করে তার বিয়ে দিয়েছেলেন। বিয়ের ছয় মাস পরে নব পরিণীতা স্ত্রীর জন্য উপহার কিনতে জেলার হাতীবান্ধা রেলওয়ে স্টেশন বাজারে যান মোজাম্মেল। এই সময় ট্রেন যোগে পাকিস্তানি সেনারা স্টেশনে নামেন এবং হাতীবান্ধা থানার সব অস্ত্র জব্দ করে নিয়ে যায়।

বাজার থেকে ফেরার পথে ষ্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের নজরে পড়ে যান মোজাম্মেল। তাকে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে ধরে  নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। তার চোখ বাঁধা থাকলেও তিনি বুঝতে পারেন  মুক্তিযোদ্ধা মনে করে তার মতো আরও অনেককে ধরে এনেছে সেনারা। সেখানে তাদের ওপর দিনভর চলে নির্মম নির্যাতন। অনেককে কোথায় যেন নিয়ে যায় এবং তারা আর ফিরে আসেনি।  এক পর্যায়ে আসে মোজাম্মেলের পালা। তাকে  নিয়ে যেতে আসেন এক অবাঙ্গালি রেল পুলিশ। বাবার চাকুরির সুবাদে ওই  রেল পুলিশ ছিলেন তার পূর্ব পরিচিত। মোজাম্মেল তাকে আঙ্কেল বলে ডাকলে তিনি তাকে চিনে ফেলে।

ওই পুলিশ তখন মোজাম্মেলকে  ছেড়ে দেয়। এরপর জীবন বাঁচাতে পাশের জঙ্গলে গিয়ে সারারাত শুয়ে থাকেন। পরে দিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সীদ্ধান্ত নেন। অথচ পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়ার আগে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা কখনও ভাবেননি মোজাম্মেল। যদিও পাক বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের ফলে ঠিকমত দাঁড়াতেও পারছিলেন না তিনি। তারপরও বাবা-মা ও স্ত্রীর কথা ভুলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যান  ভারতে। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে ৯ মাস  ধরে সম্মুখ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন।

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে দেখেন ছেলের চিন্তায় বাবা গুরুতর অসুস্থ। তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে জমিজমা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যায় পরিবারটি। তাদের বসত ভিটা দখলে নেয় প্রভাবশালী একটা মহল। এসময় রেলওয়ের পোষ্য কোটা ও মুক্তিযুদ্ধা  কোটায় একটি চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু কোনও কর্মসংস্থান জুটেনি তার। তাই জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে বড়খাতা রেলওয়ে গেটের বাজারে নৈশপ্রহরীর চাকরি নেন মোজাম্মেল। এই নাইট গার্ডের কাজ করে মাসে মাত্র ৩ শত টাকা পেতেন। সর্বশেষ তোর মাসিক আয় ছিল ১২ শ টাকা। এভাবে প্রায় ৪০ বছর নৈশপ্রহরীর কাজ করেও শেষ রক্ষা হয়নি। মাথা গোজার ঠাঁই না থাকায় আশ্রয় নিয়েছেন রেলওয়ে গেট সংলগ্ন রেলওয়ের রেল লাইনের ধারের জমিতে।

এখানে দেড়/ দুই শত জমির ওপর দুইটি ঝুপরি তুলে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন মোজাম্মেল। ইতিমধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আর্থিক অনটনের কারণে সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেনি। ছেলে ছোট একটি পানের দোকান দিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন।

এরমধ্যে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার ক্ষমতায় এলে ২০০০ সালে  হাতীবান্ধায় ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মাত্র ৩শত টাকা করে ভাতা দেয়। তাদের  মধ্যে তিনিও একজন। এই ভাতা পাওয়ার পরই তিনি যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেটি সবাই জেনে যায়। ফলে তাকে দিয়ে কেউ আর নৈশ প্রহরীর কাজ করাতে চায়না। আবার পড়ে যান আর্থিক কষ্টে। তখন তার ছেলে পানের দোকান শুরু করেন। এভাবে চলছে তার দিন। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের কাছ থেকে প্রতিমাসে ১২ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান পাচ্ছেন। তাই দিয়ে বুড়াবুড়ির সংসার চলছে।

এখন বৃদ্ধবয়সে নানা রোগে পেয়ে বসেছে মোজাম্মেলকে। তাই আর্থিক অনুদানের অধিকাংশ অর্থ ঔষধ কিনতে গিয়ে শেষ হয়ে যায়। তার ওপর  রেললাইনের ধারে ভাঙ্গা ঝুপরি ঘরে  ঘুমাতে পারেন না কনকনে ঠাণ্ডায়। ট্রেন আসলে বিকট শব্দ ও ধুলায় দমবন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়ে যায় এই মুক্তিযোদ্ধার। তাই সরকারের কাছে একটি বাড়ি সহায়তা চেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল, চাইছেন চিকিৎসা সহায়তাও।

এই ভুমিহীন মুক্তিযোদ্ধার এক শতাংশ জমি নেই। তাই সরকার ঘোষিত মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহনির্মাণ প্রকল্পের ঘর তার কপালে যোটেনি। কখনও জুটবে কিনা এই হতাশা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। মৃত্যুও আগে তার সন্তান, নাতি, নাতনিকে একটু আশ্রয় দেখে যেতে চান তিনি।

এই মুক্তিযোদ্ধার আক্ষেপ- ‘যে দেশের ভূখণ্ডকে স্বাধীন করতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলাম সেই দেশে আমার নামে এক শতাংশ জমিও নেই। আমি স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও আশ্রয়হীন, ভুমিহীন, বাস্তুহারা, সর্বহারা।’

তার নাতি নাতনিরা একটু বড় হয়েছে। তারা তাকে বলে, ‘দাদা, তুমি না মুক্তিযোদ্ধা। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস কত দিবস পালন হয়, কত সাজসজ্জা হয়। তোমাদের নিয়ে লোকজন কত বক্তব্য দেয়, গর্ব করে। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারিনা কেন?  আমাদের ঘর কই? পেট পুরে খাবার পাইনা কেন? তুমি অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে পারিনা কেন?’

এই অবুজ নাতি নাতনিদের প্রশ্নের উত্তর জানা নেই মোজাম্মেলের। তাই তো শুধু চোখের জল ফেলেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

এ সম্পর্কে হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বীরমুক্তিযোদ্ধার সন্তান সামীউল আমীন জানান, বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেছি। এই ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল কে খাসজমি বরাদ্দ দিয়ে দ্রুত বাড়ি করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/