শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রিয় আয়শা আপা

আয়শা খানম

শামীমা আফরোজ আইরিন

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারী  আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী আয়শা খানম প্রয়াত হয়েছেন গত ২ জানুয়ারি, রোজ শনিবার, ভোর ৩'৩০ মিনিটে। আমি ফজরের নামাজ আদায়ের পর বসে তসবিহ পড়ে হাত তুলে মোনাজাত করছিলাম। এমন সময় ফোন আসলো, কিন্তু ফোনটা ধরতে পারলাম না, কেটে গেলো। আবার ফোন বাজছে। ছুটে গিয়ে ধরলাম। ফোনটা ধরতেই জুয়েলার কন্ঠ শুনে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, আবার কি খবর যেন শুনতে হয়! আমার বুকের ভিতরটা  ধড়ফড় করছিলো। জুয়েলা কন্ঠস্বর খুব মলিন করে বলছেন, ‘খবর জানো, আমাদের আয়শা আপা বেঁচে নেই। তিনি আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।’

তার কাছ থেকে আরও জানলাম-ওইদিনই সকাল ৮.৩০ টার সময় কেন্দ্রীয় কার্যালয় সুফিয়া কামাল ভবনে আয়শা আপার মরদেহ নিয়ে আসা হবে। সকাল ছয়টা থেকে অপেক্ষা শুরু-কখন আটটা বাজবে, প্রিয় আয়শা আপার মুখটা  দেখতে পাবো। কতদিন আয়েশা আপাকে সামনাসামনি দেখি না! ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। এর আগে একদিন আমার বাসায় এসে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ যা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। তুমি মহিলা পরিষদের অফিসে আসা শুরু করো, ঘরে বসে থেকো না, অসুস্থ হয়ে পড়বে।’ একের পর এক প্রিয়জন, আপনজন, প্রিয় মুখ হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছি,অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছি। কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছি  দুঃসংবাদ আর দুঃখ বেদনা ভরা ব্যথিত জীবনে নিয়ে। তখন আমাকে এভাবেই সান্ত্বনা দিয়েছিলেন প্রিয় আয়শা আপা।

আয়শা আপা সম্পর্কে কিছু বলতে হলে,তার স্মৃতিচারণ করতে হলে, তার মনের মাধুর্য ও সৌজন্যবোধ এবং সকলকে ভালোবাসা ও স্নেহ করার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন সেগুলো তুলে ধরতে হবে। এইসব গুণাবলী আয়েশা আপাকে করে তুলেছিল এক অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাই আয়শা আপাকে নিয়ে লেখার সাহস আমার নেই। আর কখনও হবে না জানি, শুধু কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে যা না বলে শান্তি পাচ্ছি না।

তখন কর্মী হিসাবেমহিলা পরিষদের সাথে সবে যুক্ত হয়েছি। তখন একটি অনুষ্ঠানে জাফর ইকবাল স্যার আসার কথা। আয়শা আপার আদেশে আমার হাতে একটা ফুলের তোড়া দেয়া হলো জাফর ইকবাল স্যারকে অভিনন্দন জানানোর জন্য। হাঁটার সময় আমার পায়ের উঁচু হিলের জুতা থেকে কটকট শব্দ হচ্ছিল। আয়শা আপা আমাকে ডেকে বললেন- ‘কি জুতা পড়েছ শব্দ হচ্ছে খুলে এসো।’সবদিকে এত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল তার।

আয়শা আপার  বক্তব্য আমরা অধির আগ্রহ নিয়ে শুনতাম এবং খাতায় নোট করতাম। একদিন আমাকে সামনে পেয়ে বল্লেন-‘গতকাল তোমাকে দেখলাম মন খারাপ করে বসেছিলে। শরীর খারাপ ছিলো? এখন ভালো আছো?’ আয়শা আপা একাধারে বুদ্ধিদীপ্ত ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন একজন মহীয়সী নারী ছিলেন। আমার মেয়ের অস্ট্রেলিয়া স্কলারশিপের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে একটা ছাড়পত্রের দরকার ছিলো। আমি সভাপতি আয়শা আপা বরাবর একটি দরখাস্ত লিখলাম। আপা আমার দরখাস্তটা গ্রহন করলেন। আমার মেয়ের নাম, ঠিকানা, পেশা  দিয়ে একটি চিঠি তৈরি করে দিলাম। কেন্দ্রীয়  সংগঠন উপ পরিষদের অফিস এক্সিকিউটিভ লতাকে দিয়ে চিঠিটা পড়ানোর পর সভাপতি আয়শা আপা ও সাধারণ সম্পাদক  মালেকা আপা  দুজনেই স্বাক্ষর করে দিলেন। আয়শা আপা একবারের জন্যও জানতে চাননি, আমার মেয়ে কয়দিন মহিলা পরিষদে আসছে কি কাজ করছে।

আমার কাছে আয়শা খানম আমাদের সময়ের জীবন্ত কিংবদন্তি, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নারীবাদী ও মানবাধিকারকর্মী। আয়শা আপা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে তেমন চিনতেন না। তেমন হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না আমার সাথে। কিন্তু আমি  ও আমার স্বামী  ছিলাম আয়শা আপার ভীষণ ভক্ত।  আমি  অবাক বিস্ময়ে আপার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আপাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতাম, শ্রদ্ধা করতাম ও ভালোবাসতাম। ‘নারীবাদ একটা নকশীকাঁথা, সবাইকে এখানে বুঁনে যেতে হবে কিছু না কিছু। দাগ রাখতে হবে সবাইকে। আমি একা পারবো না, তুমিও একা পারবে না’-আয়েশা আপার বক্তব্যের মধ্যে প্রায়ই এ কথাটা আসতো।

বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও নারী পুরুষের সমতার আন্দোলনে আয়শা খানমের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার পথ অনুসরণ করে আমরা যেন নারী আন্দোলনের ধারা অব্যাহত রাখতে পারি, এখন মনে প্রাণে এটাই একমাত্র চাওয়া। দোয়া করি- আয়শা আপা যেন পরপারে খুব ভালো থাকেন ,শান্তিতে থাকেন। আমারা মহিলা পরিষদের সঙ্গে জড়িতরা সবসময় তার জন্য দোয়া করে যাবো। আয়শা আপা স্মৃতিপটে চির অম্লান হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে। আমরা যে তাকে কতটা ভালোবাসতাম, সে কথা ভাষায় প্রকাশ করার নয়।

শামীমা আফরোজ আইরিন

এই প্রবন্ধের লেখক বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার লিগ্যাল এইড সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/