শুভ জন্মদিন দুঃসাহসী রোমাঞ্চ লেখক জ্যাক লন্ডন

আজ ১২ জানুয়ারি, বিখ্যাত মার্কিন লেখক জ্যাক লন্ডনের জন্মদিন। তার প্রকৃত নাম জন গ্রিফিথ চ্যানি। কিন্তু লেখালেখির জগতে তিনি জ্যাক লন্ডন হিসেবেই বেশি পরিচিতি। সাহিত্যের নানা শাখায় পদচারণা থাকলেও মূলত উপন্যাস ও ছোটগল্পের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন এই লেখক। তার বিভিন্ন লেখায় নান্দনিকভাবে ফুটে ওঠেছে পশ্চিমের লোমহর্ষক ও কঠিন জীবনের সাবলীল বর্ণনা, ভাষায় এতটাই দক্ষতা ছিল তার। লেখালেখি ছাড়াও ফটোশিল্পী হিসাবেও সুনাম রয়েছে জ্যাক লন্ডনের।

প্রাথমিক ও কর্মজীবন

আজ থেকে প্রায় আড়াই শ’বছর আগে অর্থাৎ ১৮৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের স্যানফ্রান্সিস্কো শহরে জন্মগ্রহণ করেন জ্যাক লন্ডন। তার শৈশব কেটেছে ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডের এক বস্তিতে। তার বাবা উইলিয়াম চ্যানি ছিলেন একজন জ্যোতিষী আর মা ফ্লোরা ওয়েলম্যান ছিলেন গৃহিনী। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশি ভালো না থাকায় অল্প বয়সেই জীবিকার খোঁজে বের হতে হয়েছিল জ্যাক লন্ডনকে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগও ছিল না তার। তবে স্ব-শিক্ষিত হয়ে নিজের জীবন গড়েছিলেন লন্ডন।

বেঁচে থাকার জন্য নানা ধরনের কাজ করেছেন এই লেখক। দারিদ্র্যপীড়িত শৈশবে জীবন ধারণের জন্য প্রতিদিন ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত তাকে পরিশ্রম করতে হতো।  মাত্র ১৮ বছর বয়সে জাহাজের নাবিক হিসাবে কাজ শুরু করেন। আর সে জাহাজ ডুবে গেলে বাধ্য হয়ে তিনি মৎস্যজীবীদের দলে যোগ দেন। এর পরের কয়েক বছর খাবার কারখানার শ্রমিকের কাজ থেকে শুরু করে কয়লা উত্তোলন, পাটকলের কেরানি, শুঁড়িখানার বিক্রেতা হিসাবেও  কাজ করেছেন। কাজের আশায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এক শহর থেকে অন্য শহরে। পয়সার অভাবে বিনা টিকেটে ট্রেনে চড়তেও বাধ্য হয়েছেন। ঝিনুক আহরণ করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে জীবনধারন করেছেন। এমনকি ক্ষুধার তাড়নায় ঝিনুক চুরির মতো ঘৃন্য কাজ করতেও দ্বিধা করেননি। শুধু তাই নয়-একসময় ভবঘুরে ও গৃহহীন অবস্থাতেও দিনযাপন করতে হয়েছে জ্যাক লন্ডনকে। আর এতসব বৈচিত্রময় কাজ করেছেন বলেই তার রচিত সাহিত্যে এত বিচিত্র বিষয় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন নান্দনিকতার সাথে।

রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে একজন সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারনার ঘোর সমর্থক ছিলেন জ্যাক লন্ডন। তিনি কেন সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করেন তা নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছেন। রাজনীতির কারণে জেলও খেটেছেন।

লেখক জ্যাক লন্ডন

১৮৮৫ সালে ওইডা রচিত ভিক্টোরিয়া যুগের 'সিগনা' উপন্যাসটি পড়েই সাহিত্য চর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠেন তিনি। তারপরই ভাষার সৌন্দয় শিখতে বই পড়তে শুরু করেন। এক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করেন ওকল্যান্ড লাইব্রেরির লাইব্রিরিয়ান ইনা কুলব্রিথ। এরই মধ্যে ১৮৯৩ সালে মায়ের অনুপ্রেরণাতে একটি গল্প লেখার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন জ্যাক লন্ডন। এই প্রতিযোগিতা তাকে লেখক হতে উৎসাহিত করে। লেখক হবার উদ্দেশ্য নিয়েই দীর্ঘদিন পর আবার হাই স্কুলে ফিরে আসেন এবং কয়েক মাসের চেষ্টায় প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । কিন্তু পড়াশোনায় তার মন বসলো না। অবশেষে তিনি স্কুল ছেড়ে দেন এবং ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য কানাডায় পাড়ি জমান।

যদিও এসময় থেকেই তার লেখালেখির চর্চা অব্যাহত ছিল এবং তিনি প্রতিদিন নিয়মিত লিখতেন। ১৮৯৮ সালটি জ্যাকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই বছরেই একটি প্রথম শ্রেণির সাময়িকপত্র তার ‘অ্যান ওডিসি অব দ্য নর্থ’ গল্পটি ছাপা হয়। এ গল্পটির প্রকাশ তার ভাগ্য বদলে দিল। ১৮৯৯ সালে তিনি  ‘ওভারল্যান্ড মাসিক’ এর মত প্রকাশনাগুলিতে নিজের লেখা কয়েকটি ছোট গল্প বিক্রি করেন।  এর কিছুদিন পর জনৈক বিশিষ্ট প্রকাশক The son of the wolf: Tales of the far North গল্পগ্রন্থ প্রকাশের জন্য লেখকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন। ১৯০০ সালে এ বইটি প্রকাশিত হয় যাতে ছোট-বড় মোট ৯টি গল্প ছিল। সবগুলোরই পটভূমি উত্তরের বরফের রাজ্য। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রীরা ছাড়াও অশ্বেতাঙ্গ স্থানীয় আদিবাসীদের কথাও এ বইয়ে নিপুণ হাতে ব্যক্ত হয়েছে।

বইটি প্রকাশের অল্পদিনের মধ্যেই লেখক হিসাবে জ্যাক লন্ডনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আর পুরোপুরি লেখাতে মনোনিবেশ করেন লন্ডন। লিখে ফেলেন দারুণ সব গল্প আর উপন্যাস। যদিও  খুব বেশিদিন লেখালেখি করার সুযোগ পাননি তিনি। মাত্র ৪০ বছরের জীবদ্দশায় লিখেছেন অর্ধশত গ্রন্থ। এগেুলোর মধ্যে দ্য কল অব দি ওয়াইল্ড, হোয়াইট ফ্যাঙ, দ্য রোড, দি আয়রন হীল, দ্য সী উল্ফ, দ্য গেম  উল্লেখযোগ্য। গল্প-উপন্যাস ছাড়াও তিনি বেশ কিছু কবিতা, নাটক, স্মৃতিকথা ও রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখেছেন। আরেক বিখ্যাত মার্কিন লেখক আর্নেষ্ট হেমিংওয়ের আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন পৌরুষদীপ্ত লেখকের আর্দশ। তিনি একাধারে ছিলেন সমাজবিজ্ঞানী, ভবঘুরে, নাবিক, যুদ্ধ সাংবাদিক ও ‘ওয়েষ্টার পায়রেট’। তার অনেক উপন্যাস নিয়ে ছবি ও টেলিভিশন সিরিজ নির্মিত হয়েছে।

[

জ্যাক লন্ডনের তোলা সান ফ্রান্সিসকো ভূমিকম্পের ছবি

আলোকচিত্রী জ্যাক লন্ডন

আলোকচিত্রী সাংবাদিক হিসেবেও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন জ্যাক লন্ডন। যদিও তার এই কৃতিত্বের খবর অনেকেরই অজানা। লেখালেখির মতো সমান দক্ষতায় জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তিনি ধারণ করে রেখেছেন তার তোলা অনবদ্য কিছু ছবিতে। তার দুঃসাহসী জীবনাচারণ সেই সাথে সংবাদদাতা হিসেবে তার কাজের পরিধি-সবমিলিয়ে বিশ শতকের গোড়ার দিককার জীবনের অসাধারণ প্রতিচ্ছবি এসব আলোকচিত্র।

তার মৃত্যুর একশো বছর পূর্তির কিছু আগে ইতালীর কনট্রাস্ট বুকস পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার আলোকচিত্র নিয়ে বই ‘জ্যাক লন্ডন. দ্য পাথস মেন টেক’। প্রায় ১২শ ছবির দুর্লভ সংযোজন বিখ্যাত লেখকের বৈচিত্র্যময় জীবনের পাশাপাশি ফুটিয়ে তুলেছে সেই সময়কার সমাজ বাস্তবতা। বইটিতে রয়েছে লন্ডন, জাপান, চীন, কোরিয়া, ভূমিকম্প-পরবর্তী সান ফ্রান্সিসকো এবং দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরে তোলা ছবিগুলোর সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে জ্যাক লন্ডনের নানা বক্তব্য।

ব্যক্তিগত জীবন

জ্যাক লন্ডন ১৯০০ সালের  ৭ এপ্রিল এলিজাবেথ মে’কে  বিয়ে করেন। বিয়ের দিনটি তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিন হিসাবে স্বীকৃত। কেননা ওইদিনই তার তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সন অব দ্য উলফ’ প্রকাশিত হয়। তবে এই বিয়ে খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯০৪ সালে তিনি বেসেকে তালাক দেন। এরই মধ্যে তাদের দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। এলিজাবেথকে তালাক দেয়ার পরের বছরই বিয়ে করেন চার্মিয়ান কিট্রেডেসকে, যিনি লন্ডনের প্রকাশক ম্যাকমিলানের সচিব হিসেবে কাজ করতেন।

মৃত্যু

১৯১৬ সালের ২২ নভেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ায় নিজ বাড়িতে মাত্র ৪০ বছর বয়সে মারা যান জ্যাক লন্ডন। কেউ কেউ মনে করেন এই লেখক আত্মহত্যা করেছেন। তবে তিনি কিডনি রোগে ভুগে মারা গেছেন বলে তার ডেথ সার্টিফিকেটে উল্লেখ রয়েছে।

আজ এই বিখ্যাত লেখকের ১৪৬তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন দুঃসাহসী রোমাঞ্চ লেখক জ্যাক লন্ডন।

উইকিপিডিয়া অবলম্বনে

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/