শুভ জন্মদিন ভার্সেটাইল সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন

আজ ১৩ জানুয়ারি, বাংলা সাহিত্যের আলোচিত কবি ও লেখক নবনীতা দেবসেনের জন্মদিন। গল্প, কবিতা, উপন্যাসসহ সাহিত্যের সব শাখায় অবাধ বিচরণ করলেও রম্য রচয়িতা হিসাবেই বিখ্যাত হয়ে আছেন এই লেখক। নারী লেখকদের মধ্যে এ ধরনের রম্য সাহিত্য রচনার উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নাই। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও স্বীকৃতি।

প্রাথমিক ও কর্মজীবন

১৯৩৮ সালে দক্ষিণ কলকাতায় হিন্দুস্থান পার্কে এক উদার, আধুনিক ও সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্ম নবনীতা দেবসেনের। তার বাবা নরেন দেব ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। একই সঙ্গে সাহিত্যিক হিসাবেও তার সুনাম ছিল। অন্যদিকে তার মা রাধারাণী দেবীও একজন সাহসী নারী ও কবি হিসাবে কলকাতার সাহিত্য সমাজে ছিলেন সমাদৃত। তার বাবা-মা দুজনের সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লেখক শরৎচন্দ্রসহ বহু কবি ও সাহিত্যিকদের ভালো সম্পর্ক ছিল। তার নবনীতা নামটি দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে লেখক শরৎচন্দ্র তার নাম দিয়েছিলেন অনুরাধা। কালের পরিক্রমায় রবি ঠাকুরের নামটিই টিকে যায়।

ছোটবেলা থেকেই লেখালেখিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন নবনীতা দেবসেন। অল্প বয়সেই ভালো কবিতা লিখতে পারার খ্যাতি জুটেছিল তার। একই সঙ্গে লেখাপড়াতেও ছিলেন দুর্দান্ত। গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল থেকে পাশ করার পর ভর্তি হন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। এরপরে পড়েন কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর প্রিয় ছাত্রী ছিলেন নবনীতা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান হাভার্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।  উচ্চশিক্ষার পরে দেশে ফিরে এসে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। এখান থেকেই অবসরে যান এই সাহিত্যিক। শুধু যাদুবপুরে নয়,পড়াতে যেতেন অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়তেও।

সাহিত্যে অবদান

আমৃত্যু দু হাতে লিখে গেছেন নবনীতা দেবসেন।  ১৯৫৯ সালে ‘প্রথম প্রত্যয়’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যে আগমন তার। শুরুটা কবিতা দিয়ে হলেও সাহিত্যের সব শাখায় সদর্পে বিচরণ ছিল এই সাহিত্যিকের। গল্প, কবিতা, উপন্যাস,  প্রবন্ধ, ছোটগল্প, শিশু সাহিত্য, কবিতা, রম্যরচনা, আত্মজৈবনিক গদ্য, ভ্রমণকাহিনী, নাটক বাংলা সাহিত্যের কি লেখেননি বলুন তো!  বিংশ-একবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যে ভার্সেটাইল লেখক নবনীতা কিন্তু একজনই। সব মিলিয়ে প্রায় আশিটির মতো গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন নবনীতা দেব সেন। এগুলোর মধ্যে কবিতা-প্রথম প্রত্যয়, স্বাগত দেবদূত, তুমি মনস্থির করো; উপন্যাস –আমি অনুপম, প্রবাসে দৈবের বশে, অন্য দ্বীপ; গল্প – মঁসিয়ে হুলোর হলিডে, গল্পগুজব, খগেন বাবুর পৃথিবী; নাটক – অভিজ্ঞান দুষ্মন্তম; আত্মজীবনীমূলক রম্যরচনা-নটী নবনীতা, ভালো-বাসার বারান্দা; শিশুগ্রন্থ –পলাশপুরে পিকনিক, চাকুম চুকুম, স্বপ্নকেনার সওদাগর; গবেষণা – ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, সীতা থেকে শুরু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার বই ইংরেজি ও হিন্দিসহ নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

কেবল বাংলা বা ইংরেজি নয়-হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, সংস্কৃত, জার্মান, হিব্রুসহ একাধিক ভাষাতে ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য।

নারী স্বাধীনতা ও অধিকার অবদান

একজন সচেতন মানুষ হিসাবে নারী স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন নবনীতা দেবসেন। তাই বলে তাকে কখনই তথাকথিত নারীবাদীদের দলে ফেলা যাবে না। তিনি নারীদের উৎসাহ জুগিয়েছেন ভালোবেসে। তাই তার নারী চর্চা কেবল 'অ্যাক্টিভিজম'য়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি, মানবীবিদ্যার চর্চা প্রকাশ পেয়েছে তার নানা সাহিত্য কীর্তিতেও। ২০০০ সালে, মা রাধারানী দেবীর জন্মদিনে গড়েছিলেন বাংলা ভাষায় নারী লেখিকাদের নিজস্ব গোষ্ঠী 'সই'।  নারীদের প্রতি তার মমত্ববোধ আর ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন ছিল নারীদের নিয়ে করা বইমেলা, যার নাম হয়েছিল ‘সইমেলা।’ সম্ভবত এটিই বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র বইমেলা ছিল যেখানে কেবল নারীদের প্রাধান্য ছিল; হোক তা লেখিকা হিসেবে কিংবা প্রকাশক অথবা স্টলের কর্মী। একই সঙ্গে তৈরি করেছেন ওয়েবসাইট, আর নারী লেখিকাদের জন্য ব্লগ।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী এবং একদম সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা তেলেগু ভাষার কবি মোল্লাকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন নবণনীতা। দুই নারী কবির লেখা রামায়ণের বিশ্লেষণ করেছিলেন তিনি। এইসব গবেষণা কাজে তার প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন তার মা। একজন নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাহিত্যকে বিচার বিশ্লেষণ করার রসদ তিনি পেয়েছিলেন তার মায়ের জীবন এবং সাহিত্যচর্চা থেকে।

পুরস্কার ও সম্মাননা

সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার যার মধ্যে সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার, কমলকুমার জাতীয় পুরস্কার, গৌরী দেবী মেমোরিয়াল পুরস্কার, ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার, মহাদেবী বার্মা পুরস্কার, হারমনি পুরস্কার, রকফেলার সোসাইটির দেয়া সেল্লি পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার এবং ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া শরৎ পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ২০০০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রীতে ভূষিত হয়েছিলেন নবনীতা দেবসেন।

বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত ও অনুষ্ঠিত সাহিত্য এবং একাডেমিক সম্মেলনগুলোতে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। এমনকি, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ সেমিওটিক এবং স্ট্রাকচারাল স্টাডিজ এবং ইন্টারন্যাশনাল কম্পারেটিভ লিটারেচার অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনিবাহী পদে অধিষ্ঠিত হবার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি।

পারিবারিক জীবন

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলেন ১৯৫৯ সালে। যদিও সেই ঘর টেকেনি, ১৯৭৬ সালে আলাদা হয়ে যায় তারা। অন্তরা দেব সেন ও নন্দনা সেন নামে তাদের দুটি মেয়ে রয়েছে। তবে বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও কখনও এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য শোনা যায়নি নবনীতা দেবসেনের মুখে। কেননা জীবনকে সহজভাবে দেখার শিক্ষাটা যে পেয়েছিলেন ছোটবেলাতেই। তাই অমর্ত্য সেনের নোবেল প্রাপ্তির সংবাদে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে দ্বিধা করেননি।

মৃত্যু

দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে ভোগার পর ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় কলকাতায় মারা যান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল নবনীতা দেব সেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

আজ এই প্রখ্যাত সাহিত্যিকের ৮৪তম জন্মদিকে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন প্রিয় সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/