শুভ জন্মদিন বিশ্ব সাহিত্যের ‘রহস্য মানুষ’ এডগার অ্যালান পো

বিখ্যাত মার্কিন কবি ও লেখক এডগার অ্যালান পো‘য়ের জন্মদিন ছিল ১৯ জানুয়ারি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সমালোচনা, অনুবাদসহ সাহিত্যের নানা শাখায় সুদীপ্ত বিচরণ থাকলেও মূলত গোয়েন্দা ও রহস্য কাহিনীর জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন এই সাহিত্যিক। আরও স্পষ্টভাবে বললে তার হাত ধরেই বিশ্বসাহিত্যের এই শাখাটি সমৃদ্ধ ও পরিপুষ্ট হয়েছে। যে কারণে তাকে গোয়েন্দা ও রহস্য কাহিনীর জনক হিসাবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।

প্রাথমিক ও কর্মজীবন

এডগার অ্যালান পো ১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বোস্টন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অভিনেতা ডেভিড ও এলিজাবেথ এলিজা পো দম্পতির তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। ছোটবেলা থেকেই অভাব অনটন আর নানা দুঃখজনক ঘটনার ভিতর দিয়ে বেড়ে ওঠেন পো। তার জন্মের মাত্র এক বছর পরেই তাদেরকে ছেড়ে যান তার বাবা। এর পরের বছরই মারা যান মা।  ফলে বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই প্রতিভাবান সাহিত্যিক সারা জীবন কেটেছে নানা রকম যন্ত্রণা, আর্থিক দৈন্যদশা ও মানসিক অস্থিরতার মধ্যে। তাছাড়া নিজের উচ্ছৃঙ্খল স্বভাবের জন্যও ভুগতে হয়েছে অমিতব্যয়ী এই লেখককে।

বাবা-মায়ের অবর্তমানে ভার্জিনিয়ার ধনাঢ্য ব্যক্তি ফ্রান্সেস অ্যালানের আদরযত্নে বেড়ে ওঠেন পো। যদিও তিনি কখনই তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দত্তক নেননি। ফলে আর্থিক অনাটনও তার পিছু ছাড়েনি। তাছাড়া পো’য়ের ধার দেনা করার স্বভাব এবং জুয়া খেলার নেশা পছন্দ ছিল না অ্যালানের। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে মত পার্থক্য দেখা দেয়ায় তার পড়ার খরচ দিতে অস্বীকার করেন অ্যালান। এরই মধ্যে স্কুলের পড়া শেষ করে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন পো। কিন্তু অর্থের অভাবে মাত্র এক বছর পরই বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। পরে অবশ্য অ্যালানের অর্থেই  ১৮২৭ সালে ভর্তি হন ওয়েস্ট পয়েন্টের মিলিটারি একাডেমিতে। কিন্তু পো তার উচ্ছল স্বভাব আর তার পাতানো পিতার কৃপণতার কারণে ১৮৩১ সালে অপমানিত হয়ে বিতাড়িত হলেন মিলিটারি একাডেমি থেকে। এরই প্রেক্ষিতে ১৮৩৮ সালে ফ্রান্সেস অ্যালানের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন পো।

ব্যক্তিগত জীবনের সেই সংকটের মধ্যেই সাহিত্যের আঙিনায় পা রাখেন পো। প্রথম দিকে সাফল্য না আসায় বেছে নিলেন সাংবাদিকতা। এসময় সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও খ্যাতি জুটেছিল তার। কিন্তু তারপরও দারিদ্র্য তার পিছু ছাড়লো না।  সেই অবস্থায় ১৮৩৬ সালে মামাতো বোন ভার্জিনিয়াকে বিয়ে করলেন। বিয়ের ১১ বছর পর যক্ষ্মা রোগে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর পুরোদমে সাহিত্যে রচনায় মনোনিবেশ করেন পো। যদিও খুব বেশিদিন লেখালেখি করার সুযোগ পাননি এই প্রতিভাশালী লেখক। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে জীবনের সব হিসাব কিতাব চুকিয়ে অজানা জগতে পাড়ি জমান পো।  

সাহিত্যে অবদান

কিশোর বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন পো। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতার বই ছাপা হয়। মাত্র ৪০ পৃষ্ঠার ওই বইটির নাম ছিল টেমারলেন এন্ড আদার্স পোয়েমস, যদিও এটি পাঠক ও সমালোচকদের নজর কাড়তে পারেনি। তবে তার পোয়েমস গ্রন্থটি কিন্তু দারুণভাবে সফল হয়েছিলো। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। রচনা করে গেছেন একের পর এক নান্দনিক কবিতা। তার রচিত বিখ্যাত কবিতাগুলির মধ্যে ‘হেলেনের প্রতি’, ‘স্বপ্ন’, ‘ইস্রাফিল’, ‘দাঁড়কাক’, ‘অ্যানাবেল লি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার ‘দ্য রেভেন’ বা ‘দাঁড়কাক’ কবিতাটি রোম্যান্টিকতা, মোহন সুরেলা ছন্দোময়তা ও তার রহস্যময় পরিমণ্ডলের জন্য বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতারূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

কবিতা দিয়ে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করলেও ডিটেকটিভ ও ভৌটিক গল্পের জন্যই কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যে বিখ্যাত হয়ে আছেন পো। এসব ছোটগল্পে তিনি নৈপুণ্যের সঙ্গে গা ছমছমে রহস্যময়তা, ভুতুড়ে, মৃত্যু, খুনখারাবি ও আতঙ্কিত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। তিনি হচ্ছেন প্রথম মার্কিন লেখক যিনি প্রথমবারের মতো সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ গোয়েন্দা কাহিনী লিখেছিলেন। তার আগে কেবল লেখক আগুস্তে ডুপিনে কিছু রহস্য উপন্যাস রচনা করেছিলেন। পোয়ের গোয়েন্দা কথাসাহিত্যের গল্পগুলি ভবিষ্যতের গোয়েন্দা সাহিত্যিকদের ভিত্তি তৈরি করেছিল। এজন্য বিখ্যাত ডিটেকটিভ লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল বলেছেন, পো’য়ের গোয়েন্দা গল্পগুলো থেকেই মূলত সাহিত্যের এই ধারাটির বিকাশ ঘটেছে। পো এ ধরনের গল্প রচনা করার আগে গোয়েন্দা গল্পের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। আর এ কারণেই আমেরিকার  দ্য রহস্য লেখকদের সংগঠন  Mystery Writers of America তাদের প্রবর্তিত সেরা গোয়েন্দা কাহিনীর পুরস্কারের নাম দিয়েছে "এডগার্স"।

তার রচিত দি ফল অফ দ্য হাউস অফ আশার,  দি পিট এ্যান্ড দি পেন্ডুলাম, দি ব্লাক ক্যাট, আমন্তিলাডোর পিপা, দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ, দ্য পোরলোইড লেটারসের মতো  গোয়েন্দা-গল্প  তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে।

পো ছিলেন উনিশ শতকের প্রথম আমেরিকান লেখক যিনি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইউরোপে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, বিশেষ করে ফ্রান্সে। বিখ্যাত ফরাসি কবি চার্লস বাউডিলেয়ারের সাহিত্যকর্ম অনুবাদের কারণে ফ্রান্সে বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছিলেন  পো। বাউডিলেয়ারের অনুবাদগুলি পুরো ইউরোপ জুড়ে পোয়ের কাজের সুনির্দিষ্ট উপস্থাপনা হয়ে ওঠে।

পোয়ের সাহিত্য বিজ্ঞানের কল্পকাহিনীকেও প্রভাবিত করেছিল। এদের মধ্যে বিখ্যাত কল্পকাহিনীর লেখক  জুল ভার্নের নাম  উল্লেখযোগ্য। তিনি পোয়ের ‘দ্য ন্যাচারিয়েটি অফ আর্থার গর্ডন পাইম অফ ন্যান্টটকেট’উপন্যাসের সিক্যুয়াল লিখেছেন যার নাম অ্যান্টার্কটিক রহস্য। এটি  দ্য স্পিঞ্জস অফ আইস ফিল্ডস নামেও পরিচিত। কেবল জুল ভার্ন নন-বিশ্বের বহু লেখক পোয়ের রহস্য ও গোয়েন্দা কাহিনীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, সাহিত্যের এই শাখাটিতে এতটাই অবদান রয়েছে তার। রহস্যকাহিনীর বর্তমান যে ধারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহিত্যে দেখা যায়, তার পথিকৃত ছিলেন অ্যালান পো।

পো-র উচ্চমানের রচনাশৈলী এবং প্রতীকবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালের অনেক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন আইরিশ কবি ডব্লিউ. বি. ইয়েটস, ফরাসি কথাসাহিত্যিক মোপাসাঁ, কবি শার্ল বোদলেয়ার ও অল ভালেরি। আজও পো-র সাহিত্যকর্ম সাধারণ পাঠক ও বিদগ্ধ সমালোচক সবার কাছে সমাদৃত হচ্ছে। তার রচিত কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও সমালোচনা বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসাবে বিবেচিত। কেবল সাহিত্য রচনা নয়, তিনি সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু থিউরিও উদ্বাবন করে গেছেন।

রহস্যজনক মৃত্যু

কেবল রহস্য গল্পের রচয়িতা হিসাবেই নন,  ব্যক্তি জীবনেও অনেক রহস্যের জন্ম দিয়েছিলেন এই লেখক। এমনাকি তার মৃত্যু নিয়েও কম রহস্য হয়নি।

মৃতুর আগে পো একা একা বাস করতেন নিউইয়র্কের কাছাকাছি ছোট্ট এক কুটিরে। অনেকেই মনে করেন, সেসময় তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিষন্ন এবং সাধারণ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এক আলাদা মানুষ। ১৮৪৯ সালের ৩ অক্টোবর হঠাৎ তাকে পড়ে থাকতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের রাস্তায়। জোসেফ ওয়ালকার নামের এক সহৃদয় ব্যক্তি তাকে ভর্তি করে দেন ওয়াশিংটন কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু তিনি মাত্র চারদিন পর ৭ অক্টোবর মারা যান।

ঠিক কী কারণে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তার কারণ আজও জানা যায়নি। কেউ কেউ মনে করেন, মৃত্যুর আগে অ্যালকোহলে আসক্ত ছিলেন পো। যে কারণে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। আবার অনেকেই মনে করেন, ব্যথানাশক ওষুধ সেবনের ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে।

তবে বেশিরভাগ লোকেরই ধারণা, সম্পত্তির লোভে তাকে কেউ হত্যা করছেন। যদিও এ সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য আজও পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর পর সঙ্গে সঙ্গেই এ নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। সংবাদপত্রে তখন বলা হয়েছিল, মস্তিষ্কের মারাত্মক রোগে পো মারা গেছেন। এরপর ছোট্ট আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তাকে সমাহিত করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এ সাহিত্যিকের মৃত্যু নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। শুরু হয় গবেষণা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে হাসপাতালে পো মারা গেছেন সেখানে তার মৃত্যু ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো নথি পাওয়া যায়নি। ফলে তার মৃত্যু রহস্যের আজও কোনও কিনারা হয়নি। এটাও একটা রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।

বিখ্যাত এই লেখকের ২১৩তম জন্মদিনে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে তার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন রহস্যকাহিনীর জনক এডগার এ্যালান পো।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/