কাজী সুফিয়া আখতার
বাঙালি সংস্কৃতির এক ঐতিহ্যবাহী অনুসঙ্গ পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। পৌষ মাসের শেষ দিনে ঘট করে পালিত হয় এই পর্বটি। সেই ধারাবাহিকতায় এবার পৌষ সংক্রান্তি পালিত হয়েছে গত ১৪ জানুয়ারি।
'মকর সংক্রান্তি' শব্দটি দিয়ে নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশকে বোঝানো হয়ে থাকে। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী 'সংক্রান্তি' একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। ১২টি রাশি অনুযায়ী এরকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় এই দিবস বা ক্ষণকে ঘিরে উদযাপিত হয় নানা উৎসব। নেপালে এই দিবসটি মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদযাপিত হয়। অবশ্যিকভাবে দেশ ভেদে এর নামের মতোই উৎসবের ধরনেও থাকে পার্থক্য।
বহু প্রাচীন কাল হতে চলে আসছে এই উৎসব। এই দিন বাঙালিরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। তার মধ্যে পিঠা পায়েস খাওয়া ও ঘুড়ি উড়ানো অন্যতম। সারাদিন ঘুড়ি উড়ানোব পরে সন্ধ্যায় পটকা ফুটিয়ে ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি করে। ভারতের বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামে এই দিনটিকে ঘিরে ঐতিহ্যময় জয়দেব মেলা হয়। বাউল গান এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটা করে পালিত হয় এই উৎসব। পুরান ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তি সাকরাইন নামে পরিচিত। এ উপলক্ষে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতা, পিঠাপুলি খাওয়া ও বিলানো এবং পৌষমেলার মাধ্যমে পৌষসংক্রান্তি উদ্যাপিত হয়। মেলায় বিভিন্ন ধরনের খাবার এবং অন্যান্য উপহার ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বাউল গানের আসর বসে। এছাড়াও এই দিনে ঢাকার নবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে গরু দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে চন্দ্রখোলা ও বিল্পপল্লী সবুজ সংঘের মাঠে জমজমাট আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।
বাঙালির পিঠাপুলি,ফিরনি পায়েস খাওয়ার প্রাণের উৎসব পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। শীতের দিনে গরম গরম পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। অগ্রহায়ণে নতুন ধান উঠার পরে আত্মীয়- স্বজন সকলকে নিমন্ত্রণ করে পিঠা খাওয়ার এই উৎসবে বিবাহিত মেয়েকে বাবার বাড়িতে নাইওর আনা হয় জামাই, নাতি নাতনীসহ। সারা বাড়ি জুড়ে উৎসব উৎসব পরিবেশ। তার সাথে এইদিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসে বড়ো বড়ো মাছের মেলা। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের সুনামগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনায়।
পৌষ সংক্রান্তিতে সাতক্ষীরা অঞ্চলেও মাছের মেলা বসে। কুমিল্লা, চট্টগ্রামে, ঢাকায় বৈশাখ মাসের প্রথম দিনের শুরুতে বড় মাছের মেলা বসে। মাছে ভাতে বাঙালির উৎসব চলে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পূজা পার্বণের উৎসকথা ধরে। আর পৌষ মাসে তো প্রাকৃতিক জলাশয়ে খাল-বিলে- পুকুরে পানি কমে যায়। মাছ ধরার উৎসবে আনন্দ প্রিয় বাঙালি মেতে উঠে সপরিবারে, ছেলে বুড়ো সবাই মিলে।
সেভাবে দেখতে গেলে শীতকাল মূলতঃ বাঙালির উৎসব উদযাপনের কাল। পিঠা বানানো ও খাওয়ার ধুম চলে গোটা শীত জুড়ে। পাশপাশি পালাগান ও যাত্রা শোনার উৎসব। সকলে মিলিত হওয়ার উৎসব। তাই বুঝি অতিথিপরায়ণ বাঙালির শীতকাল খুব প্রিয় সময়। একই সঙ্গে প্রিয় পৌষ সংক্রান্তির উৎসব।
কাজী সুফিয়া আখতার: লেখক ও মানবাধিকার নেত্রী
ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/