শুভ জন্মদিন শিক্ষাবিদ ও অনুবাদক কবীর চৌধুরী

আজ ৯ ফেব্রুয়ারি, দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক কবীর  চৌধুরীর জন্মদিন। লিখেছেন জীবন, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নানা বিষয় নিয়ে। তবে মৌলিক লেখালেখির চেয়ে অনুবাদ সাহিত্যিক হিসাবেই বেশি সফল এই লেখক। ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি এবং একইভাবে অনুবাদও করেছেন দুই ভাষাতেই। অনুবাদ সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।

শিক্ষা ও কর্মজীবন
১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন কবীর চৌধুরী। তার পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার গোপাইরবাগ গ্রামে। বাবা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী এবং মা আফিয়া বেগম। তার পুরো নাম আবুল কালাম মোহাম্মদ কবীর, ডাকনাম মাণিক।

কবীর চৌধুরীর পড়াশোনায় হাতেখড়ি বাড়িতে। পরিবারের সাহচর্যে তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর ভর্তি হন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখেন তিনি। ১৯৩৮ সালে তিনি ম্যাট্রিকে সপ্তম স্থান এবং১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টামিডিয়েট কলেজ (বর্তমান নাম ঢাকা কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অনার্সে ১৯৪৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ শ্রেণীতে ১৯৪৪ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক অর্জন করেন।

পরে ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তিধারী হিসেবে আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কিন সাহিত্য সম্পর্কে এবং ১৯৬৩-১৯৬৫ সালে সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসন সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করেন। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে।

সরকারি চাকুরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন কবীর চৌধুরী। পরে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকালে তিনি নাট্যকলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও পাঠদান করতেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি ইংরেজি বিভাগে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন।  ১৯৯৮ সালে জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা লাভ করেন কবীর চৌধুরীকে। এছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ‘কালচার স্টাডিজ’কোর্সে গ্রাজ্যুয়েট স্তরে শিক্ষা দান করেছেন।

অনুবাদ সাহিত্যে অবদান
শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখিতে বিশেষ করে অনুবাদ সাহিত্যে তার ব্যাপক অবদান রয়েছে। পঞ্চাশের দশকেই অনেকটা শখ থেকেই শুরু করেন অনুবাদের কাজ। পরে এটি তার জীবনের অংশ হয়ে যায়। তার রচিত, সম্পাদিত ও অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতেরও বেশি।

তার প্রথম বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে, ক্লিফোর্ড ওডেট্সের একাঙ্কিকার বঙ্গানুবাদ ‘আহবান’। পরে এটি শহীদের প্রতীক্ষায় ও সমরেশ কোথায় নামেও পুনর্মুদ্রিত হয়। ইংরেজিতে অনুবাদের প্রথম বই ছিল বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত Selected Poems of Nazrul Islam (১৯৬৩)। তারপর অজস্র কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত করেছেন।

তিনি যেসব বিখ্যাত বিদেশি সাহিত্যিকদের গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন তাদের মধ্যে- আয়োনেস্কো, অ্যারিস্টফেনিস, ইউজিন ও’নীল, ইবসেন, কাফকা, আলেক্সান্ডার দ্যুমা, স্ট্রিনবার্গ, ইবসেন, স্যামুয়েল বেকেট,  জেএম কোয়েতজি, বেওউলফ, হোসে সারামাগো, নগীব মাহফুজ, কাহলিল জিবরান, জিরাদু,  চিনুয়া আচেবে, ব্রেখট, বোর্হেস, মলিয়ের, মার্কেজ, মেরী শেলী, রবার্ট পেন ওয়ারেন, রিচার্ড রাইট, শেখভ, স্কট ফিটজেরাল্ড, স্টেইনবেক ও হেমিংওয়ে অন্যতম।

তিনি বাংলাভাষী যেসব কবি ও সাহিত্যিকদের কাজ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তার কবিতা, উপন্যাস ও গান অনুবাদ করেছেন। এছাড়া আবদুল গনি হাজারী, আবুল হোসেন, আল মাহমুদ, তসলিমা নাসরিন ও শামসুর রাহমানের কবিতা; ফয়েজ আহমদের ছড়া; আনোয়ার পাশা, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত ওসমান, হাসনাত আবদুল হাই ও হোসনে আরা শাহেদের উপন্যাস; আবদুল্লাহ আল মামুন ও মুনীর চৌধুরীর নাটক এবং বাংলাদেশের কবিতার একাধিক সংগ্রহ তার হাতে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। একদিকে বাঙালি পাঠকদের বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতি করে তোলা এবং অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যকে ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে বিদেশি পাঠকদের সামনে তুলে ধরা ছিল কবীর চৌধুরীর অনুবাদকর্মের অনন্যসাধারণ সাফল্য।

পাশ্চাত্য সাহিত্যের নানাদিক নিয়ে তিনি লিখেছেন এবং এ-বিষয়ে ইংরেজিতে লেখা বই অনুবাদ করেছেন। তিনি লিখেছেন প্রাচীন ইংরেজি কাব্য সম্পর্কে, আধুনিক মার্কিন সাহিত্য সম্পর্কে; ফরাসি নাটক ও ইউরোপীয় নাট্যকার সম্পর্কে; অ্যাবসার্ড নাটক ও অভিব্যক্তিবাদী নাটক সম্পর্কে; শেক্সপিয়র ও শিলার, স্তঁধাল ও প্রুস্ত, পুশকিন ও লোরকা –পাশ্চাত্যের এসব বিখ্যাত পণ্ডিত ও লেখকদের সম্পর্কে। তিনি সাহিত্যকোষ সংকলন করেছেন, সাহিত্যসমালোচনা ও নন্দনতত্ত্বের পরিভাষা নিয়ে লিখেছেন। কত বিচিত্র ও বিস্তৃত তাঁর রচনার ক্ষেত্র, এ-থেকে তার কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।

তার আরেকটি প্রিয় ক্ষেত্র পাশ্চাত্য চিত্রশিল্পীদের পরিচয়দান। বত্তিচেল্লি, রুবেনস, ভেলাসকুয়েজ, রেমব্রাঁ, ভারমিয়ের, গয়া, কুরবে, মিলে, সেজান, সার্জেন্ট, মাতিস, রদাঁ, পিকাসো এবং আরো অনেকের বিষয়ে তিনি বাঙালি পাঠককে অবহিত করেছেন। তাছাড়া গ্রন্থ রচনা করেছেন মানুষের চিত্রকর্ম, ন্যুড চিত্রশিল্প, পাশ্চাত্য চিত্রশিল্পী এবং ফরাসি চিত্রশিল্পী সম্পর্কে।

অনুবাদ কর্ম ছাড়াও অজস্র মৌলিক প্রবন্ধ লিখেছেন কবীর চৌধুরী। এগুলোর মধ্যে মানবকল্যাণ ও অন্যান্য (২০০০), মৌলবাদ, তার ইতিহাস ও প্রকৃতি অনুসন্ধান (২০০০), বুদ্ধির মুক্তি ও বিশ্বাসের শৃঙ্খলের (২০০০), অসমাপ্ত মুক্তিসংগ্রাম ও অন্যান্য (১৯৯১), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা (১৯৯২) ও স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় (১৯৯৪) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তার স্মৃতিকথা নাই বা হল পারে যাওয়া (পাঁচ খন্ড, ২০০৩-০৫) অতি উপভোগ্য রচনা।

রাজনীতিতে অবদান
কবীর চৌধুরী আজীবন ছিলেন প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসী এবং সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবক্তা। একাধিক সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে বরাবরই তিনি ছিলেন সোচ্চার ও কর্মচঞ্চল। তিনি ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ফোরাম এগেইন্সট ফান্ডামেন্টালিজম অ্যান্ড এন্টি-সেক্যুলারিজম-এর সভাপতি, সেন্ট্রাল ট্রাস্ট ফর দি মেমোরিজ অব দি লিবারেশন ওয়ার-এর সভাপতি, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ-এর সভাপতি, থিয়েটার ড্রামা গ্রুপের সভাপতি, বাংলাদেশ-জার্মান ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির সভাপতি, ইউনাইটেড সিটিজেন মুভমেন্টের সভাপতি, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রিটিসিজম কমিটির ঢাকা কেন্দ্রের সভাপতি এবং বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি।

এসব সংগঠনের বিভিন্ন কাজে এবং শিক্ষাবিদ হিসাবে বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমনেরও সুযোগ পেয়েছেন কবীর চৌধুরী। তিনি ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, হংকং, জাপান, তুরস্ক, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েট ইউনিয়ন, মঙ্গোলিয়া, উত্তর কোরিয়া, উগান্ডা ও এঙ্গোলায় বিভিন্ন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এবং কোনো কোনো সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা
লেখালেখির স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। এগুলোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান গর্ভনর স্বর্ণপদক (১৯৬৮), পাকিস্তান লেখক সংঘ পুরস্কার (১৯৬৯), ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮৬), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৩),  একুশে পদক (১৯৯১), বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৪), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭),  কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি প্রদত্ত ট্যাগোর পীস অ্যাওয়ার্ড,  পশ্চিমবঙ্গের উইলিয়ম ক্যারি রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডি সেন্টার প্রদত্ত উইলিয়ম ক্যারি গোল্ড মেডাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তিনি কেবল পুরস্কার নিয়েই ক্ষান্ত হননি, নিজ নামে প্রবর্তন করেছেন পুরস্কার। তার অর্থায়নে কবীর চৌধুরী শিশু সাহিত্য পুরস্কার নামে বাংলা একাডেমি একটি পুরস্কার প্রদান করে থাকে প্রতি বছর।

পারিবারিক জীবন
বাংলাদেশের এক আলোকিত পরিবারের সদস্য কবীর চৌধুরী। দেশের প্রখ্যাত নাট্যকার শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তার ছোট ভাই এবং নাট্যশিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার তার ছোট বোন। ১৯৪৫ সালের জুন মাসে মেহের কবিরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। মেহের কবীর নিজেও শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক।

আরও পড়তে পারেন-শুভ জন্মদিন শিক্ষাবিদ-নাট্যকার মুনীর চৌধুরী

মৃত্যু
২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার নয়াপল্টন নিজ বাসভবনে ৮৯ বছর বয়সে মারা যান কবীর চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে দাফন করা হয়।

আজ তার ৯৯তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের মহীরুহ অধ্যাপক কবীর চৌধুরী।

শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/