ভালোবাসার গল্প-২ অনামিকা

সাজেদা হক

সাজেদা হক

বাঁশঝাড়ের ভেতর সাদা ধবধবে একটি কবর। কবরের গাঁয়ে কালো অক্ষরে বড় বড় করে লেখা ভালোবাসার কোন সীমানা নেই-দেখে নিজের প্রাইভেট কার থামালো অরণ্য। দাদু বাড়ি থেকে ফিরছিলো অরণ্য। এর আগেও এ পথে বহুবার আসা-যাওয়া করেছে অরণ্য, কিন্তু তখন কেন এই কবর চোখে পড়েনি ভাবছে। সামনেই পেয়ে গেলো বাবার বন্ধু আলী চাচাকে। আলী চাচাকে দেখেই ডাক দিলো অরণ্য, চাচা।

অরণ্যকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো আলী। মধ্যবয়স্ক, গোঁফে ঢাকা মুখ, ফর্সা রংটাকে আড়াল করতে পারেনি। তারপরও রোদে পোড়া শরীরে বার্ধক্যটা বেশ স্পষ্ট। লাল-সবুজ রংয়েল পাঞ্জাবিতে এখন্য সৌম্য মনে হচ্ছে আলীকে।

-আরে, বাবা অরণ্য। তোমার তো যাওয়ার কথা? দাঁড়িয়ে পরলে যে?
-চাচা, এই কবর টাতো আগে দেখিনি। কার কবর এটা?
-তুমি চিনবে না। এক অভাগীর কবর এটা।
-অভাগী?
-হুম, অভাগী নয় তো কি বলবো বলো?
-আপনি চেনেন এই মহিলাকে?
-চিনি। ভালো করেই চিনি।
-কে চাচা?
-বললাম তো, এক অভাগী বাবা।
-চাচা, অভাগী কেন বলছেন?
-তুমি কি সত্যিই শুনতে চাও, কেন অভাগী বলছি?
-চাই চাচা, সত্যিই শুনতে চাই চাচা।
-তাহলে তোমার গাড়ি ঘুরাও। চলো তোমাদের বাসায় বসি।
-কিন্তু চাচা, আমরা তো যেকোন জায়গায় বসে আলাপ করতে পারি, কিন্তু আমাদের বাসাতেই কেন?
-কারণ আছে। শুনলে বুঝবা। সে পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
-জি চাচা।
এরপর আলী চাচাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো অরণ্য।

অরণ্যকে দেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে যাওয়া অনিম থমকে দাঁড়ালো। স্বাস্থ্যবান, সুন্দর চেহারার অনিমের পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, কাঁধে শীতকালীন চাদর। সেই চাদরের রং-ও সাদা। অরণ্যর সাথে আলীকে দেখে প্রশ্ন করলো:
-কি রে, তুই অরণ্যর সাথে কেন?
-ও অনামিকার কথা জানতে চায়!
অনামিকার নামটা শোনার সাথে সাথেই কেমন পানসে হয়ে গেলো অনিম। অরণ্যের মনে হলো, বাবার চোখের কোন মুহুর্তেই ভিজে উঠেছে। ঘরের দেউড়িতেই বসে পড়লো অনিম,সাথে আলীও। অরণ্য আর দাঁড়িয়ে থাকে কিভাবে, সেও বসে পড়লো। আলী বলা শুরু করলো। অনামিকার সাথে অনিমের দেখা ৯৬ এ। -যেবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচন করলো তোমার বাবা। সে সময় তুমি তোমার মায়ের পেটে। অনামিকাও নির্বাচন করেছিলো। অনামিকারও বিয়ে হয়েছিলো এইচএসসি পড়ার সময়। কি কারণে যেন সংসারটা করা হয় নি তার। সেই নির্বাচনে অনামিকা চিনতো না তোর বাবাকে কিংবা তোর বাবা অনামিকাকে। নির্বাচনে হেরে গেলো দুজনই। ফলাফলের পরদিন অনামিকাকে ফোন দিলো তোর বাবা।

-কেমন আছেন? আমি অনিম বলছি।
-ওহ! কামাল ভাই। ভালো আছি। আপনার সাথে আমার পরিচয় নেই মনে হয়। নির্বাচন করেছেন শুধু এটুকু জানি।
-আমাদেরকে কে মনে রাখে বলেন?
-কি যে বলেন। আপনারা নেতা মানুষ।
-শোনেন অনামিকা, আপনার সাথে তো দেখা হওয়া দরকার। নির্বাচন নিয়ে কিছু আলাপ ছিলো।
-কি আলাপ?
-ভোটের রেজাল্ট ঘোষণার সময় তো ছিলেন? দেখেছেন না কিভাবে ফলাফল ঘোষণা করলো?
-হুম।
-এখনো কিন্তু অনেক কিছু করার আছে। সেজন্য বসা দরকার।
-আচ্ছা, একদিন বসা যাবে।

এমনিতেই মন খারাপ অনামিকার। ফোন রেখে ভাবলো, যে প্যানেলের হয়ে নির্বাচন করলো, তাদের সাথে বসতে হবে। হিসেব নিকেষ এমন হলো কেন? কেন এতো সহজে ফল মেনে নিলো-এমন অনেক প্রশ্ন ভাবছে অনামিকা। হঠাৎ করেই বা কেন অনিম তাকে ফোন দিলো? বুঝতে পারছে না। এই অনিমের সাথে সামনা সামনি দেখা ভোটের দিন ভোরে। অনামিকা তার কয়েকজন কর্মীকে নিয়ে সকালের নাস্তা করার জন্য নির্বাচন কেন্দ্রের সামনের একটি হোটেলে পৌঁছেছে। এমনিতেই ভোর, তখনও নাস্তা রেডি হয় নি হোটেলের। অনমিকারা অর্ডার দিয়ে বসে পরবর্তী করণীয় কি, কে কি করবে-এসব নিয়ে আলাপ করছে। এমন সময় একটা মেয়েকে নিয়ে সেই হোটেলে ঢুকেছিলো অনিম। অনিমের সাথে আসা মেয়েটি হোটেল বয়কে রুটি দেয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছিলো। হোটেল বয়টা নাস্তা রেডি করে অনামিকাদের টেবিলের দিকে যেতেই মেয়েটা চিৎকার দিয়ে বললো, এই ছেলে, আমাদের দে আগে। ছেলেটা কথা না শুনে অনামিকাদের টেবিলের দিকেই এগুচ্ছে। এমন সময় মারার জন্য অনেকটা তেড়ে আসে অনিম। হম্বিতম্বি। অনামিকা পরিবেশ ঠাণ্ডা করার জন্য হোটেল বয়কে বলে, ওদের আগে দেন।

কিন্তু অনিমের এমন স্বভাব মোটেও ভালো লাগে নি অনামিকার। তাই এড়িয়ে গেছে। আর নির্বাচনের দিন ছিলো, সকালেই গেঞ্জাম করতে ইচ্ছে করেনি অনামিকার। সেই অনিম আর ভোট শেষ হতে না হতেই ফোন কেন দিলো-সে হিসেবটা মেলাতে পারছে না। পরদিন সকাল ১০টায় আবারো ফোন। হোস্টেলে শুয়ে আছে অনামিকা। ফোনটা ধরলো।
-কেমন আছেন?
-ভালো। আপনি?
-আমি অতোটা ভালো নাই। শোনেন, আপনার সাথে দেখা হওয়া জরুরি।
-আচ্ছা।
-আচ্ছা বললে হবে না, সময় দেন। আমি আসতেছি আজকে।
-আজ?
-হুম, আজ। কোথায় আসবো বলেন?
-সত্যিই আসবেন?
-হুম।
-তাহলে কার্জন হলের পুকুর পাড়ে চলে আসেন।
-কয়টায়?
-যখন আপনার ইচ্ছা। আমি আজ কোথাও বের হচ্ছি না, হোস্টেলেই থাকবো।
-তাহলে আমি বিকেল ঠিক তিনটায় চলে আসবো। আপনাকে কি আবার ফোন দিতে হবে?
-হ্যাঁ দিতে হবে।
-আচ্ছা।
ওইদিন বিকেলে কার্জন হলের পুকুড়পাড়ে প্রথম বসলো অনিম আর অনামিকা। প্রথম দিন নির্বাচন নিয়ে আলোচনার চেয়ে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির পরিচয় বেশি হলো। অনামিকা জানলো, অনিমের বিয়ে হয়েছে, বউ গর্ভবতী। অনামিকাও বললো, সে ডিভোর্সি। কথা আরো হলো, নির্বাচন পরবর্তী করণীয় বিষয়ক। তাও সামান্য। হেঁটে হেঁটে গেটের বাইরে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে অনামিকার হাতটা ছুঁয়ে গেলো অনিম। বাই বলে বিদায় নিলো অনামিকা।

এরপর প্রতিদিন সকালে, দুপুরে, বিকেল ফোন দেয় অনিম। ফোনে, ম্যাসেঞ্জারে আই লাভ ইউ লিখে পাঠায়। অনামিকা কিছু বলে না। এটা নিয়মিত হতে থাকলো। অনিমের এই আগ্রহের প্রতি কোনো সাড়া দেয় না অনামিক। আবার একদিন দেখা করার অনুরোধ করে অনিম। প্রায় তিন মাস পর অনামিকা অনিমকে সময় দেয়। কার্জন হলের পুকুর পাড়। পৌঁছে দেখে অনিম অপেক্ষা করছে। অনামিকাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো অনিম। কাছে আসতেই অনামিকাকে জড়িয়ে ধরলো, বাঁচবো না তোমাকে ছাড়া বলে কেঁদে ফেললো।
-আহা। ছেড়ে দেন। সবাই দেখছে।
-দেখুক, আমি ছাড়বো না। হ্যাঁ না বলা পর্যন্ত।
-এটা কেমন ছেলেমানুষী। আমাদের কথা তো হচ্ছে প্রতিদিন। তাহলে সমস্যা কোথায়?
-না, আমি কিছু জানি না। শুধু জানি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।
-ঠিক আছে। বসেন স্বাভাবিক হয়ে আলোচনা করি।
-কোন আলোচনা নেই। হ্যাঁ ছাড়া।
-আমি হ্যাঁ বললে সামলাতে পারবেন?
-হ্যাঁ পারবো।
-আপনি আপনার বউকে ভালোবাসেন না?
-বাসি, কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।
-দুজনকে কিভাবে রাখবেন?
-জানি না। তুমি বলো?
-আমার মনে হয় আপনার আরো ভাবা উচিত।
সেদিনের মতো এখানেই আলোচনার ইতি টেনে হোস্টেলে ফিরে আসে অনামিকা। অনিম অনামিকার পিছু ছাড়ে না। ফোন দেয়, দেখা করতে চায়। অনামিকা বলে, আমার অনেক বদনাম। আমাকে বিয়ে করে আপনি সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন না। আপনার সেই সাহস নেই। কিন্তু অনিম কোনভাবেই হাল ছাড়ে না। বলে পারবো, কিছুটা সময় দিতে হবে। বলে, চলো একদিন ঘূরে আসি কোথাও।
-কোথায়?
-ধরো চাঁদপুর
-প্লান কি?
-রাতে যাবো, সকালে ইলিশ খেয়ে ফিরবো।
-আচ্ছা।
অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না, তাই রাজি হয়ে যায় অনামিকা। অনিমকে যে অপছন্দ তা কিন্তু নয়। কিন্তু অনিমরে সংসারে আগুন লাগাতে চায় না অনামিকা। সে জানে, অনিমের বউ গর্ভবতী। অন্য একটা মেয়ের স্বামী অনিম। সে সংসারে সে যুক্ত হতে চায় না। ভাবলো, অনিম মনে হয় তার দেহের মোহে পড়ে এমনটা করতে চাইছে। তাই মনে মনে ভাবলো হয়তো একবার অনামিকাকে কাছে পেলে, তার প্রতি আগ্রহ হারাবে অনিম। সেকারণে এই ট্যুরের জন্য রাজি হলো সে। চাইলে, আজ অনিমের হবে অনামিকা। হলোও তাই লঞ্চের কেবিনে সেদিন সেজেছিলো অনিম আর অনামিকার বাসর।

সেই রাতেই অনিম ফোন দেয় আলীকে। বলে-দোস্ত জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছি। ধর কথা বল। অনামিকা ফোন ধরে, বলে
-আপনার কথা অনেক শুনেছি।
-আমিও শুনছি আপনার কথা, সারাদিন, সবসময়। কি যাদু করলেন আমার বন্ধুকে?
-আরে কিছু না। ও এমনিতেই এমন।
-একদিন আসেন, আমাদের গ্রামে, বেড়িয়ে যান।
-হুম, যাবো। গেলে জানাবো।
সেটাই ছিলো অনামিকার সাথে আমার প্রথম কথা-অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বললো আলী। অরণ্য বললো, তারপর? তারপর কি হলো?

তারপর বলা শুরু করে অনিম। ওইদিন অনামিকা ফোন রেখে বলেছিলো, তুমি তো এখনো নিশ্চিত নও আমাকে তোমার জীবনে জড়াবে কি না। এটা একটা গোপন সম্পর্ক এখনও। তাহলে অন্যকে জানাচ্ছো কেন?
-অন্য মানে, আলী আমার বন্ধু। আলীর সব আমি জানি, আমারও সব জানে আলী
-তাতে কি? তুমি যদি তোমার কথা গোপন রাখতে না পারো, তাহলে তোমার কথা অন্যে গোপন কেন রাখবে বলতে পারো?
-তা ঠিক।
-আর কাউকে বলো না। যখন বিয়ে করবে তখন জানলে জানুক। নিজের দুর্বলতা অন্যের কাছে বলে অন্যের কাছে নিজেকে দুর্বল করো না-অনিমকে বললো অনামিকা।

পরে সকালে ইলিশ খেয়ে আবার ফিরতি পথে ঢাকা ফিরলো দুজন। হোস্টেলে পৌঁছানোর আগে অনামিকাকে অনিম বললো, তুমি তোমার বড় মানো এমন কেউ ঢাকায় আছে আমি তার সাথে দেখা করতে চাই। আমি নিশ্চিত ছিলোম, অনামিকাকে আমি বিয়ে করবো। আমি যতটা নিশ্চিত ছিলাম, অনামিকা ততটাই অনিশ্চিত ছিলো। মনে হলো আমার চেয়ে আমাকে বেশি ভালো চেনে অনামিকা। বলে পাঞ্জাবির কোণা দিয়ে চোখের পানি মুছলো অনিম। আবার বলা শুরু করলো-
-কারো সাথে দেখা করার দরকার নাই, বললো অনামিকা
-কেন, চলো দেখা করে আসি তোমার বড় আপার সাথে।
-না, দরকার নেই। আবারো আমাকে ফিরিয়ে দিলো অনামিক।

এরপর আমাদের যোগাযোগ হতো নিয়মিত। আমাকে সব রকমের পরামর্শ দিয়েই যাচ্ছে মেয়েটা। আমার বইটা গুছিয়ে দিলো। আমাকে জোড় করে বার কাউন্সিলের সনদ নেয়ালো। এর মধ্যে তুই জন্মনিলি। আমাদের টান-টা শরীরের চেয়ে আত্মার বেশি।

হুম। কথা টেনে নিয়ে আলী বলা শুরু করলো। আত্মার টান ছিলো অনামিকার, তুই এটা দাবি করার অধিকার রাখিস না-বলে বন্ধু অনিমের দিকে কড়া চোখে তাকালো আলী। অনিম তখনও কেঁদেই চলেছে। আলী বলা শুরু করলো:

-চাইলেই অনামিকা তোমার বাপের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তোমার মায়ের সংসারে ঢুকতে পারতো। চাইলেই তোমার বাপের ভদ্র ইমেজটা সবার সামনে তুলে ধরতে পারতো। চিৎকার করে বলতে পারতো, এই ছেলেটা ভীতু, ভালোবাসতে জানে না, ভালোবাসার ভাব নেয়।
-এটা কেন বলছো চাচা? বাবা কি করেছে এমন?
-কি করেছে? তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর?

এবার আবার অনিম কথা বলছে। একদিন ধরা খেয়ে গেলাম তোর মায়ের কাছে। তোর মা বললো, অনামিকার কাছে যদি যাই তাহলে তোকেও বিষ খাওয়াবে, নিজেও বিষ খাবে। পারিবারিক এমন চাপের কথা বোধহয় অনামিকা আগেই টের পেয়েছিলো। অনামিকার আশঙ্কাই ঠিক হলো। সমাজ আর সংসারের কথা ভেবে আমি অনামিকার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। এমনকি অনামিকার ফোনও ব্লক করে দিলাম। অন্য কারো নাম্বার থেকে ফোন দিলেও ধরতাম না। আমি খুব ভীতু অরণ্য। সমাজ-সংসার-ইমেজে দাগ লাগাতে চাই নি।

একদিন শুনলাম, অনামিকা সুইসাইডের চেষ্টা করেছে। কয়েকদিন পর তোর মাকে নিয়ে দেখতে গেলাম। বিশ্বাস কর, অনামিকা আমাদের অনেক সম্মান করলো। তোর মাকে খেতে বললো। তোর মা বলল, আমরা এখন সকাল-সন্ধ্যা এক সাথে হাঁটতে বের হই। শুনে অনামিকা উত্তর দিলো, আপনারা স্বামী-স্ত্রী, এক সাথে বের হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। আমার ঠাণ্ডার সমস্যা আছে মনে ছিলো বলে তোর মাকে বলেছিলো- আপনারা চলে যান, সন্ধ্যা নামছে, শীত বাড়বে। আমরা চলে এসেছিলাম। অনামিকাকে কিছু বলতে পারি নি আমি।

-আবার যে নির্বাচনে দাঁড়ালি সে কথা বলবি না।
-ও হ্যাঁ। আমি পরের বছর আবারো নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলাম। অনামিকারও দাঁড়ানোর কথা ছিলো, কিন্তু মেয়েটা আমাকে কথা দিয়েছিলো, আমরা একজনই দাঁড়াবো, অন্যজন সহযোগিতা করবো। করেছেও তাই। আমার বিজয়ে অনামিকারও হাত আছে।

সুইসাইড থেকে বেঁচে ওঠার পরও তোমাকে হেল্প করলো?-অনিমকে জিজ্ঞ্যেস করলো অরণ্য।
-হ্যাঁ, হেল্প করলো। অনামিকা আমাকে ভালোবেসেছে ঠিকই, আমি ওকে ভালোবাসতে পারি নি।
-এটা কেন করলে বাবা?
-তোদের মুখের দিকে চেয়ে।
এটা বলিস কেন-বল আমার সাহস নেই অনামিকার মুখোমুখি হওয়ার। কেন তোর কি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা মনে নেই?
-হ্যাঁ আছে, বললো অনিম।
-হাসপাতালের ঘটনা মানে কি বাবা?
-আমার তো হার্টের সমস্যা। একদিন ওই কার্জন হলের দিঘীর পাড়েই বসে আলাপ করছিলাম দুজন। হঠাৎ শরীরটা খারাপ হলো। তখন অনামিকাই আমাকে প্রথম হাসাপাতালে নিলো। আমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত করার পর বাড়ির সবাইকে ফোন দিয়েছে। বিনিময়ে মেয়েটার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমাকে মাঝে মাঝেই বলতো আমার অর্ধ জীবন। অথচ তোর মা মেয়েটাকে নিয়ে কত বাজে আর নোংরা মন্তব্য করতো। সেসব এখনো আমাকে কষ্ট দেয়।

এবার আলী বলে, অনামিকার সাথে আমার যোগাযোগ হয় তোর বাবা কথা বন্ধ করে দিলে। একদিন হঠাৎ করে ফোন দিয়ে বলে,
-আলী ভাই, আমি অনামিকা, অনিমের বন্ধু
-আরে অনামিকা, কেমন আছেন আপনি?
-আমি ভালো নেই ভাই। আমার একটা কাজ করতে হবে।
-জি আপা বলেন, কি করতে হবে।
-আমার জন্য তিন হাত জায়গা কিনতে হবে অনিমদের গ্রামে। আমার তো আর কেউ নেই। অনিমকেই ভালোবেসেছি, ও বাসুক আর না বাসুক। মরার পর ওই গ্রামেই চির শান্তিতে ঘুমাতে চাই যে ভাই।
-কি বলেন আপা? আপনার আত্বীয়-স্বজন কি তা মেনে নেবেন?
-সে ব্যবস্থা আমি করে যাবো। আপনি শুধু জায়গা দেখেন। আর দামটা বলেন, আমি আপনাকে টাকা পাঠিয়ে দেবো। তবে শর্ত একটাই, এ কথা গোপন রাখতে হবে। অনিমকে কিছু জানানো যাবে না।
-ঠিক আছে আপা। তাই হবে।
-আর শোনেন, আমি মারা গেলে আপনাকেই ফোন দেবে লোকজন। আপনি দয়া করে এসে আমাকে আমার অনিমের কাছেই শুইয়ে দেবেন-এই অনুরোধ রইলো।

এরপর সত্যিই কিছু টাকাও পাঠালো অভাগী অনামিকা। তার জন্য এই জায়গাটা কিনলাম। এর কিছুদিন পর একটা ফোন আসলো, সুইসাইড করেছে অভাগী অনামিকা। আমি যেনো তার মরদেহ নিয়ে আসি। অনামিকা বাড়ির সবার কাছে আমার নাম বলে গেছে, সেই সাথে বলে গেছে তার শেষ ইচ্ছার কথা। তার বাড়ির কেউ আর বাঁধা দেয় নি। আর সে কারণেই অনামিকা এখন শুয়ে আছে তোর বাপের গ্রামে। সমাজ-সংসারের চোখে অনামিকার বিতর্কিত ভালোবাসা আজ সাদা কবর।

এবার আর নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না অরণ্য, আলী এবং অনিম। তিনজনই উঠে দাঁড়ালো একসাথে এগুতে লাগলো অনামিকার কবরের দিকে।

সাজেদা হক: কবি, লেখক ও সাংবাদিক। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুটি

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/