শুভ জন্মদিন ‘বাঙালির বাতিঘর’ ড. আনিসুজ্জামান

আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি-প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের জন্মদিন। শিক্ষকতা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর ব্যাপক  গবেষণা ছাড়াও আমাদের ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার ব্যাপক অবদান রয়েছে তার। সোজা কথা দেশের যেকোনও সঙ্কটময় মুহূর্তে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন এবং সমাধানের সচেষ্ট থেকেছেন। দেশের  সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ভাবনার ক্ষেত্রে তার অশেষ ভূমিকার কারণে অনেকে তাকে ‘চেতনার বাতিঘর’হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা কর্মের স্বীকৃতি হিসাবে দেশে বিদেশে নানা পুরস্কারে ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এই লেখক। এগুলোর মধ্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক উল্লেখযোগ্য।  

আনিসুজ্জামানের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে, ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। তার বাবার এ টি এম মোয়াজ্জেম ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিনী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল। আনিসুজ্জামানের শিক্ষাজীবন শুরু কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে। কিন্তু সেখানে বেশিদিন পড়ালেখার সুযোগ হয়নি তার। ৪৭-এর দেশভাগের পর তার পরিবার প্রথমে বাংলাদেশের খুলনাতে আসেন। পরে তারা ঢাকায় স্থায়ী হন।

১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও ১৯৫৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ. পাস করেন। এরপর মাত্র ২২ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন।

বাংলা একাডেমির বাংলা বানান রীতির অভিধানসহ যেকোন প্রকল্পে তার অবদান ছিল সীমাহীন। দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অবদান রেখেছেন ড. আনিসুজ্জামান। ১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্ম-শতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬৭ সালে  রবীন্দ্রনাথের গান পাকিস্তানের জাতীয় ভাবাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধের নির্দেশ দেয় তৎকালীন সরকার। এর প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বিবৃতিতে আনিসুজ্জামান স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন এবং সেটা বিভিন্ন কাগজে ছাপতে দেন। মূলত এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই জোড়ালো হয়ে উঠেছিল বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা।

১৯৭১ সালে মুজিব নগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। পরবর্তী সময়ে ভারত গিয়ে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া যুদ্ধকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। এছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধান বাংলা ভাষায় অনুবাদের যে কমিটি ছিল সেটার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী গোলাম আযমের বিচারের জন্য ১৯৯১ সালে গঠিত গণ আদালতের একজন অভিযোগকারী ছিলেন তিনি।

সেই ষাটের দশক থেকেই আনিসুজ্জামান তার ভূমিকার জন্য মধ্যবিত্ত বাঙালির সংস্কৃতির আন্দোলনের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়ান। দেশের প্রতিটি সংকটকালে তার বক্তব্য, মন্তব্য এবং ভূমিকা দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। আর একারণেই তাকে  ‘সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ভাবনার ক্ষেত্রে চেতনার বাতিঘর’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যুক্ত হন। শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো। ২০১৮ সালের ১৯ জুন ড. আনিসুজ্জামানকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে ঘোষনা করে বাংলাদেশ সরকার।

এতসব গুরুত্বপূর্ণ  দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিল্পকলাবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা যামিনী এবং বাংলা মাসিকপত্র কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এই গবেষক।

শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে দেশে বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এগুলো মধ্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক,  স্বাধীনতা পুরস্কার,  ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক, ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দুবার আনন্দবাজারপত্রিকার আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতীর ডি. লিট. ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক উল্লেখযোগ্য।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর অসংখ্য গবেষণা গ্রন্থ, স্মৃতিকথা ও অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেছেন যেগুলোর মধ্যে -মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯), স্বরূপের সন্ধানে (১৯৭৬), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), আমার একাত্তর (১৯৯৭), বিপুলা পৃথিবী, সাহিত্যে ও সমাজে (২০০০), পূর্বগামী (২০০১), কাল নিরবধি (২০০৩) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

২০২০ সালের ১৪ মে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান আনিসুজ্জামান। তাকে আজিমপুর কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।

আজ এই মহান শিক্ষাবিদ ও লেখকের ৮৫তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন ‘বাঙালির বাতিঘর’ ড. আনিসুজ্জামান।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/