ভাষার জন্য জীবন দিল যারা

কাজী দিলরুবা রহমান

বাঙালী বীরের জাতি তার প্রমান দিয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। প্রতিবারই আত্মত্যাগে বলিয়ান এ জাতি। শত নয়, হাজার নয়, লাখও শহীদের রক্তের বিনিময়ে এসেছে ভাষার স্বাধীনতা, ভৌগলিক স্বাধীনতা, সাংবিধানিক স্বাধীনতা।

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি মূলত ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পূর্ব থেকেই। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে এবং জুলাই মাসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল তার প্রতিবাদে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও মুহাম্মদ এনামুল হকসহ বেশ কজন বুদ্ধিজীবি প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ করেন। দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অঙ্গ রাজ্য তথা পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয় তখনই ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করাসহ স্কুল ও মিডিয়াতে ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাবের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ সহ সর্বস্তরের জনগণ।

পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী সর্বস্তর থেকে বাংলাকে মুছে ফেলে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তুতি নেন। এসব সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি জনগন তথা ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং সাধারন জনতা বিক্ষুব্ধ হয় এবং ছাত্রদের একটি বড় অংশ বাংলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা কলেজ,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জমায়েত হয়ে মিছিল ও আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী গণ পরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ও নাকচ করা হয়। সব ধরনের মুদ্রা ও ডাক টিকিট থেকে বাংলা মুছে ফেলা হয়। ফলশ্রুতিতে আন্দোলন আরো জোরদার হতে শুরু করে। ঢাকা শহরে প্রতিবাদ মিছিল ও ধর্মঘট পালিত হয়। প্রতিবাদ মিছিলের স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এই মিছিলে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ভাষা সৈনিকদের অনেকেই। প্রতিবাদে গঠিত হয় সর্বদলীয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।  রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে লাগাতার ধর্মঘট,  মিছিল,  সমাবেশ প্রতিবাদ চলতে থাকায় বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিসহ ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তান গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণে ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।’ ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খানা নাজিমুদ্দিন পুনরায় রেসক্রস ময়দানে ভাষনকালে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা দিয়ে ৮ দফা স্বাক্ষরিত চুক্তি ভঙ্গ করেন।

ফলে আন্দোলন আরো জোড়ালো হতে থাকে। ক্রমাগত আন্দোলনের চাপে ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন ঠেকাতে পাকিস্তান সরকার স্থানীয় সরকার কর্তৃক এক মাসের জন্য সব ধরনের মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষনা করে ১৪৪ ধারা জারি করে। এই ঘোষনার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে পরে এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জড়ো হতে শুরু করে। দুপুরের কিছু পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টা করে। এই সময় উপাচার্য পুলিশকে গুলি চালাতে নিষেধ করেন এবং ছাত্রদেরকে ক্যাম্পাস ছাড়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু পুলিশ কিছু ছাত্রকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অপরাধে গ্রেফতার করেন। এর প্রতিবাদে বেলা ১১টায়  ঢাকা মেডিকেলের একাংশে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের সভা হয়। এই সময় ছাত্র জনতা মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা গণ পরিষদ  অবরোধ করে সেখনে তাদের প্রস্তাব উত্থাপনের দাবি জানায়। ছাত্রদের একটি দল বিল্ডিংয়ে ঢোকার চেষ্টাকালে পুলিশ গুলি চালায়। সেই গুলিতে রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরো অনেকে শহীদ হন এবং ২২ ফেব্রুয়ারি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ মিছিলে পুনরায় গুলি চালালে নিহত হন  সালাম, সফিউল-সহ আরো অনেক নিরীহ পথচারী।

আহম্মেদ রফিক তার একুশ থেকে একাত্তর বইয়ে নিহতদের মধ্যে আব্দুল আউয়াল, কিশোর অলিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেন। ‘একুশের ঘটনা পুঞ্জি’ নামক একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় শহীদের লাশ ঢাকা মেডেকেল হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এ কারণেই ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিএবং ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল ও আন্দোলনে ঠিক কতজন শহীদ হয়েছিলেন তার সঠিক তথ্য বলা কঠিন। কারো মতে এই সংখ্যা ২৬ কারো মতে ৩৯, আবার কারো মতে এই সংখ্যা ৪০ হতে পারে।  তাই গুটিকতক ভাষা শহীদের নামই ঘুরে ফিরে আসে সবার মুখে।

এই আন্দোলনে নারীদের একটি বড় অংশ  অংশগ্রহন করে বিশেষ ভুমিকা রেখেছেন। ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ভুমিকা ছিল সক্রিয়।  ভাষার দাবির স্লোগান সম্বলিত পোষ্টার লিখে গেছেন রাতের পর রাত জেগে। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের সাথে তর্কবির্তক করে এবং শারীরিক বল প্রয়োগ করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে অন্যন্যা ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় গেইট থেকে বের করতে সরাসরি ভাষাযোদ্ধার ভুমিকায় ছিলেন। আহতদের চিকিৎসার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রীরা চাঁদা সংগ্রহ করতেন। সেই সময়ের ঘটনা নিয়ে আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, ভাষা সৈনিকদের নিয়ে স্মৃতি চারণ এবং দলিল ও বইতে এর প্রমান রয়েছে। ভাষা আন্দোলনে নারী নেত্রীর ভুমিকায় ছিলেন ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন, রওশনারা বাচ্চু সহ আরো অনেকে।

২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জে অনেক ছাত্রী আহত হন। এদের মধ্যে ছিলেন রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর, সাফিয়া ইব্রাহিম, সুরাইয়া ডলি ও সুরাইয়া হাকিম। ঢাকার বাইরে যে সকল নারীরা আন্দোলনে যুক্ত হন তাদের মধ্যে নারায়গঞ্জের মমতাজ বেগম অন্যতম, কারাভোগের কারণে তার সংসার ভেঙে যায়। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন ছিলেন ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদের’ অন্যতম সদস্য। আরো যারা ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন তারা হলেন নাদেরা বেগম, লিলি হক, হামিদা খাতুন, নুরজাহান মুরশিদ,আফসারী খানম, রানু মুখার্জী প্রমুখ।

২১শে ফেব্রুয়ারীর ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পরে এবং সেই জের ধরে চলতে থাকে লাগাতার হরতাল। ২৩ ফেব্রিয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোষ্টেল প্রাঙ্গণে দ্রুততার সাথে গড়ে উঠে শহীদ মিনার যেটি উদ্বোধন করেন ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। এভাবে সর্বস্তরের জনগনের সমর্থনে আন্দোলন ছড়িয়ে পরতে থাকায় শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার ১৯৫৪ সালের ৭ মে বাংলাকে সরকারিভাবে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ভাষা শহিদের রক্তের বিনিময়ে আর বাংগালি জাতির অনেক অত্যাচার, নিপীড়ন, লাঞ্চনা, বঞ্চনার বিনিময়ে বাংলা ভাষা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষার মর্যাদা অর্জন করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে ইউনেস্কোর সাধারন অধিবেশনে  ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/