নারী দিবসের বিশেষ গল্প ‘অপলা’

 মাহমুদা আকতার                                     

-হে ভিনদেশী যুবক, নদী যখন কথা বলে তখন নিঃশ্চুপ থাকতে হয়।
-নদী নয়, আমি তোমার কথা শুনতে চাই।
-নদী আর নারী তো আলাদা নয়। নদী তো নারীর কথাই কয়।
-কিন্তু আমার যে নারীর কথা নারীর মুখেই শুনতে ভালো লাগে।
–নারী কথা কয় নীশিথে। চুপিচুপি। একা একা। সেই কথা কি পরপুরুষ শুনতে পারে!
-পর নই গো, আমি যে তোমার আপন পুরুষ হইতে চাই।
-নারীর কোনো আপন নাই। তার কাছে সব পুরুষই পরপুরুষ।
-কিন্তু নারীরাও তো ভালোবাসে। আমি তোমার সেই ভালোবাসার মানুষ হইতে চাই।
-নারীর যে ভালোবাসা মানা। তার তো কোনো ভালোবাসার মানুষ নাই। আছে কেবল ভোগের মানুষ। ভালোবাসার কথা বলে কত পুরুষ যে নারীকে প্রতারণা করে!
কথা মিথ্যা নয়। অপলা যে-ই রাজ্যের মেয়ে তাতে তার কোনো পুরুষকে ভালোবাসার কথা নয়। সে তো জানে, এই রাজ্যের কোনো নারীরই ভালোবাসার অধিকার নাই। ভালোবাসা তাদের কাছে পাপ। আর ভুলবশত কেউ যদি এই পাপকার্যে লিপ্ত হয় তাহলে তার শাস্তি যে কত ভয়াবহ হতে পারে এই কথাও তো অজানা ছিল না অপলার। তারপরও সে কেনো অচেনা অজানা এই যুবকের সঙ্গে ভালোবাসার খেলায় মত্ত হল! ঘটনাটা তাহলে শুরু থেকেই বলি।

উদয়পুর রাজ্যের রাজা বিক্রমাদিত্য প্রজাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার সুশাসনের কারণে রাজ্য জুড়ে সুখ আর শান্তি। গাছে গাছে ফল, মাঠে মাঠে ফসল। আর কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে পায়রা নদী। প্রজারা রাজা বিক্রমাদিত্যকে ভালোবাসতো এবং তার প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ। কিন্তু তাদের কপালে এই সুখ সইল না। একদিন এক দেবতা এসে ঠাঁই নিল সে রাজ্যে। দেবতা বলে কথা। রাজা রাজ্যের এক নির্জন স্থানে দেবতার জন্য মনোরম প্রাসাদ নির্মাণ করে দিলেন। তার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কোনোই ত্রুটি রাখলেন না। কিন্তু এসব পার্থিব জিনিসে তার মন ভরল না। আসলে সে নিজের এক গোপন ব্রত পূরণের জন্যই বিক্রমাদিত্যের রাজ্যটি বেছে নিয়েছিল। সেই ব্রতটি হল, প্রতিটি ভরা পূর্ণিমার রাতে একজন করে অনাঘ্রাত অষ্টাদশী কুমারী কন্যাকে ভোগ করা। দেবতা ভোগ করার পরই সেই নারীকে বিয়ে করতে পারবে অন্য পুরুষ। তার আগে নয়। এভাবে বার বছরে মোট একশ চুয়াল্লিশ জন কুমারীকে ভোগ করতে পারলেই তার অমরত্ব লাভ হবে। দেবতা রাজাকে ডেকে সেই ব্রতের কথা জানালেন। রাজা তাকে নিবৃত্ত করার অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু নিজের লক্ষ্যে অবিচল দুষ্ট দেবতা বললেন,‘আরে আমি যে এই রাজ্যের মেয়েদের ভোগ করতে রাজি হয়েছি, এতেই তো তাদের সন্তুষ্ট হওয়ার কথা। দেবতার স্পর্শ পাওয়া একজন মেয়েকে তোরা ভোগ করতে পারছিস এ কি কম ভাগ্যের ব্যাপার! এক্ষুণি কাজে লেগে পড়। গোটা রাজ্যে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দে।’
রাজা আর কি করেন! ভগ্ন হৃদয়ে প্রাসাদে ফিরে আসেন। তার পাইক পেয়াদারা রাজ্য জুড়ে নতুন নিয়মের কথা জানিয়ে দেন। আঠার বছরের আগে কোনো মেয়ের বিয়ে দেয়া যাবে না। আঠার বছর পূর্ণ হওয়া মাত্রই প্রজারা তাদের মেয়েদের দেবতার কাছে রেখে আসবেন। দেবতার ভোগের পরই তাদের পাত্রস্থ করার চেষ্টা করবে অভিভাবকরা। ব্যস উদয়পুরে চালু হয়ে গেল এক অদ্ভুত নিয়ম।
এদিকে মরমে মরে যান রাজা বিক্রমাদিত্য। এর কি বিহিত তাও তার জানা নাই। তাই তার রাজকার্যে মন নেই। উদাস হয়ে বসে থাকেন সারাদিন। এই রাজারই মেয়ে অপলা। দেখতে তেমন আহামরি কিছু নয়, যেমনটি সাধারণতঃ রাজকন্যারা হয়ে থাকেন। আর তার পোশাক পরিচ্ছদ আর সাজ সজ্জাও খুব সাধারণ। তবে অসাধারণ হচ্ছে তার মাথার দীঘল কালো চুল। ঘন চুলগুলো ছাড়লে মনে হয় যেন চঞ্চল ঝর্ণার জল ছলছল করে গড়িয়ে পড়ছে। পাখির পালকের মত নরম আর ঝরঝরে সেই চুল। তবে এ নিয়ে কোনোই অহঙ্কার নেই অপলার। কেউ যদি বলে,‘আহা! কী সুন্দর চুল তোমার! দেখলেই ছুঁয়ে দিতে মন চায়।’ তখন নিষ্পৃহভাবে অপলা বলে,‘তাহলে ঈশ্বরের প্রশংসা কর। কারণ এতে তো আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। সবই ঈশ্বরের দয়ার দান!’

যখন রাজ্যে দেবতার নিষ্ঠুর নিয়মটি চালু হয় তখন অপলা ছিল মাত্র বার বছরের কিশোরী। দিনে দিনে তার বয়স বাড়ে। আর কদিন বাদেই আঠারতে পা দেবে রাজকন্যা। পাল্লা দিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ে রাজা বিক্রমাদিত্যের। মাঝে মাঝে ভাবেন, তার মেয়েটার বয়স আরো কম থাকলেই যেন ভালো ছিল। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, এক প্রকার আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন রাজা। কেননা এতদিন তো কেবল প্রজা কন্যাদের দেবতার কাছে পাঠিয়েছেন রাজা। তার পাইক পেয়াদারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখেছেন কোন মেয়েটা আঠার বছরে পরেছে বা দিন কয়েকের মধ্যে পরবে। তারা সেইসব মেয়েকে পূর্ণিমার রাতে দেবতার ভোগের জন্য পাঠিয়েছে। এখন রাজা যদি নিজের মেয়েকে দেবতার ভোগে না পাঠান তাহলে সেটা হবে বড় রকমের অনিয়ম। এতে মনক্ষুন্ন হবে প্রজারা। এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন রাজা! কিন্তু এই দুশ্চিন্তার কথা তো কাউকে মুখ ফুটে বলাও যায় না। কিন্তু নিজ হাতে অপলাকে কীভাবে পাঠাবেন তিনি! আর মেয়েকে ডেকে এই কথা নিজ মুখে বলেনই কীভাবে? এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হতে থাকেন রাজা বিক্রমাদিত্য।
ডাকসাইটে রূপসী না হলেও বুদ্ধিতে দারুণ পাকা অপলা। মুখে ফুটে না বললেও বাবার কষ্টটা সে ঠিকই বুঝতে পারছিল। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো দ্বিধা ছিল না। দেবতার কাছে যাওয়ার জন্য ভিতরে ভিতরে সে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেছিল দেবতা সম্পর্কে। সে দেখতে কেমন। তার কি পছন্দ অপছন্দ। আর এই অদ্ভুত নিয়মের আসল উদ্দেশ্য কি? আস্তে আস্তে সবই জেনে নিয়েছিল অপলা। এক শ’ চুয়াল্লিশ জন কুমারী নারীকে ভোগ করার পর সে হবে ওই অঞ্চলের দেবতাপতি। অর্থাৎ আরো শক্তিশালী এবং আরো ক্ষমতাধর। কিন্তু ভুলক্রমে কোনো ব্যবহৃত নারীকে ভোগ করলে তার এত বছরের সাধনা পণ্ড হয়ে যাবে। দেবতার ওপর সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করার পর কাজে লেগে পরে অপলা।

আর রাজা ভাবছিলেন, আর মাত্র বাহাত্তর জন নারীকে ভোগ করতে পারলেই পূর্ণ হবে দেবতার ব্রত। সে তো প্রায় ছয় বছরের ব্যাপার। অপলার বয়সটা যদি কোনোক্রমে লুকানো যেত। কিন্তু তা তো অত সহজ নয়। কারণ রাজকন্যার জন্মের পর ধুমধাম করে উৎসব পালন করা হয়েছে। সাত দিন সাত রাত ধরে পুড়েছে আতশবাজি। পেট পুরে খেয়েছে পুরো রাজ্যের মানুষ। সেই দিনের কথা তো অত সহজে ভুলে যাওয়ার কথা নয় প্রজাদের।
এদিকে দুই বছর আগে মনিপুর রাজ্যের যুবরাজ সোহানের সঙ্গে বাগদান সম্পন্ন হয়েছে অপলার। বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক হয়ে আছে। রাজ্য শাসন ও সমরাস্ত্র বিষয়ক জ্ঞানার্জনের জন্য বর্তমানে দুর্গম দুর্গে অবস্থান করছে যুবরাজ। সেখান থেকে ফিরলেই শুরু হবে বিয়ের তোড়জোড়। বেজে ওঠবে বিয়ের সানাই। কিন্তু মনিপুরের রাজা জয়দেব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তার ভাবি পুত্রবধূ এবং ভবিষ্যতের পাটরানী অপলাকে কিছুতেই দেবতার ভোগে পাঠান চলবে না। এমনটা হলে তিনি বিয়ে ভেঙে দিবেন। এই সব কারণে মুষড়ে পড়েছেন রাজা।

একদিন অপলা তার প্রিয় সখী কমলাকে ডেকে বলল,‘এই বিশ্বে কি কোনো সাহসী পুরুষ নাই যে একজন নারীকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে?’
-নারীকে ভালোবাসার মত পুরুষ তো কতই আছে। কিন্তু দেবতার সঙ্গে লড়াই করার মত পুরুষ আছে কিনা বলতে পারব না।
-দেবতার সঙ্গে লড়াই করার দরকার নেই। আপাততঃ আমাকে ভালোবাসলেই হবে।
-ভালোবাসা তো করা যায় না রাজকন্যা। ভালোবাসা হয়ে যায়।
-কিন্তু আমার হাতে যে অত সময় নেই কমলা। তুমি কিছু একটা ব্যবস্থা কর। আমার একজন সাহসী পুরুষ চাই।

এর কিছুদিন পরের কথা। গভীর রাতে পায়রা নদীতে ভাসছে এক ময়ুরপংখী নাও। সেই না’য়ে বসে আছে রাজকন্যা অপলা। সে কথা বলছে এক সুবেশী সুদর্শন যুবকের সঙ্গে। তারা গদ্য পদ্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, প্রকৃতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলাপ শেষে পৌঁছেছে নদী সংক্রান্ত আলোচনায়। যুবক ক্রমশ অস্থির আর চঞ্চল হয়ে উঠেছে। আর আমাদের রাজকন্যা ততোধিক স্থির আর শান্ত। অপলা বলে
-নদী আর নারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমার সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে আগে নদীকে বুঝতে হবে।
-কিন্তু নদীকে কি করে বুঝবো আমি? নদী তো কথা বলে না।
-অবশ্যই বলে। নদীর কথা বুঝতে হলে চুপ থাকতে হয়। চোখ দুটো বন্ধ করে কান দুটো খোলা রাখুন।
-কিন্তু চোখ বন্ধ করলে তোমাকে কি করে দেখব?
-মনে মনে দেখবেন।
-তাই! তুমি কি আসবে আমার মনে?
-আগে তো চোখ বন্ধ করুন।
অপলার কথা মত চোখ বন্ধ করে যুবক। কিন্তু চোখ বন্ধ থাকলেও মুখ বন্ধ থাকে না তার। যুবকের অস্থিরতা বেড়েই চলে। অপলা বলে চলে
-শুনতে পাচ্ছেন নদীর কথা? সে এখন কথা বলছে। কুল কুল কুলকুল কুলকুল। তুমি কে? তুমি কে? তুমি কে?
-আমি এক ভিনদেশি সওদাগর। আমার পরিচয় তো তুমি জানো। কিন্তু তোমার পরিচয় তো আমি জানতে পারলাম না মেয়ে। তুমি কে? তোমার কথা বল।
-আমি একজন নারী। আর নারীরা তো নদীর মতই। নারীর কথা নদীর মুখেই শুনুন।
-হায় নারী, কেন রহস্য করছ? আমি তোমাকে জানতে চাই বুঝতে চাই।
-বোঝাবুঝির দিন তো অনেক পরে আছে। আজ শুধু নদীকে দেখুন।
-নদীকে নয়, আমি শুধু তোমাকে দেখব।
আর এইসব কথাবার্তার এক ফাঁকে নিভে যায় প্রদীপ। সেই রাতে আকাশে কোনো চাঁদ ছিল না। তাই নৌকার মধ্যকার কোনো দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়নি। কেবল শোনা যাচ্ছিল পায়রা নদীর বয়ে যাওয়ার কুলকুল ধ্বনি।

আজ সেই নির্ধারিত পূর্ণিমার রাত। চাঁদের আলোয় ঝকমক করছে চারদিক। একদম নতুন বৌয়ের মতই সেজেছে অপলা। লাল বেনারসির ওপর কমলা রংয়ের ফিনফিনে ওড়না। খোলা চুলের এক পাশে দুলছে একগুচ্ছ বেলফুলের মালা। ধীরে ধীরে সে গিয়ে দাঁড়ায় রাজার পাশে।
-বাবা আমি প্রস্তুত। আমাকে নিয়ে চল দেবতার কাছে।
মেয়ের সাহস দেখে স্তব্ধ হয়ে যান রাজা।
-কি বলছিস মা তুই!
-বাবা আমি ঠিকই বলছি। আজ যদি তুমি আমাকে না পাঠাও তাহলে প্রজাদের কাছে তুমি মুখ দেখাতে পারবে না। তোমাকে কেউ বিশ্বাস করবে না, সম্মান করবে না। ভালোবাসা তো দূরের কথা। তোমার এই অসম্মান আমি সইতে পারব না।
-কিন্তু আমি যে মনিপুরের রাজাকে কথা দিয়েছি। আর কয়েক দিন পরেই তো দেশে ফিরছে যুবরাজ সোহান। তাকে আমি কি বলব?
-আমার কাছে আমার বাবার সম্মান সবার আগে। আমাকে আর আমার বাবার মান সম্মানকে যে গুরুত্ব দেয় না তার সঙ্গে তো কোনো সম্পর্ক হতে পারে না।
রাজা কিছুতেই অপলাকে নিরস্ত করতে পারেন না। হেরে যান যুক্তিতেও মেয়ের কাছে। অগত্যা তিনি অপলাকে নিয়ে চললেন দেবতার প্রাসাদে। মেয়ে চলছে পালকিতে করে। বাবা চলছে ঘোড়ার পিঠে। রাজার দু চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু। তিনি জানেন, আজকের পর তার মেয়েকে কোনো রাজপুত্র বিয়ে করবে না। সারা জীবনের জন্য অনূঢ়া হয়ে থাকতে হবে অপলাকে। তিনি তো কোনো সাধারণ যুবকের সঙ্গে তার কন্যার বিয়ে দিতে পারবেন না। কারণ তিনি যে রাজা! আর এটাই তার সীমাবদ্ধতা। অথচ দেবতার ভোগের পর দিব্যি বিয়ে হচ্ছে প্রজাকন্যাদের। অনেক যুবক তো এটাকে সম্মানজনক বলেই মনে করছে। দেবতার স্পর্শ করা কোনো নারীকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে তারা নিজেকে ধন্য মনে করছে। রাজা এত কিছু ভাবলেও রাজকন্যা কিন্তু নির্বিকার। সে শান্তভাবে বসে আছে পালকিতে।
প্রাসাদের ফটকে গিয়ে পালকি থামলে প্রহরীরা অপলাকে অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। কিন্তু রাজা রাজপ্রাসাদে ফেরত আসেন না। তিনি বসে থাকেন দ্বারের পাশে। কন্যাকে সঙ্গে না নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরতে পারবেন না।
এদিকে রাজকন্যাকে দেখে দারুণ খুশি দেবতা। পুরোহিত মন্ত্র পড়ে অপলার মাথায় গঙ্গাজল আর ফুল ছিটান। দেবতার সঙ্গে মালা বিনিময় করে অপলা। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিদায় নেন পুরোহিত। অপলাকে দু হাতে জড়িয়ে শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন দেবতা। ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত তার চন্দনকাঠের পালঙ্ক। একপাশে ধূপদানিতে সুগন্ধী ছড়াচ্ছে ধূপ। সারিবদ্ধ প্রদীপের আলোতে আলোকিত গোটা ঘর। প্রথমবারে মত দেবতার সামনে মুখ খুলে অপলা।
-প্রভু আজ পূর্ণিমার রাত। কী সুন্দর চাঁদের আলো! প্রদীপের কি প্রয়োজন?
-তোমার আলো পছন্দ নয়?
-অবশ্যই পছন্দ প্রভু। তবে চাঁদের আলো আধাঁরি পরিবেশে আমার মন বেশি রোমাঞ্চিত হয়। আর আমার মন ভালো থাকলে আপনারও নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।
দেবতা এবার অপলাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করেন। তেমন আহামরি সুন্দরী নয় রাজকন্যা। তবে তার একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে এর আগে যা তিনি অন্য কোনো নারীর মধ্যে দেখেননি। আরও একটা আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তার চোখে জল নেই। এর আগে তিনি এ রাজ্যের যেসব মেয়েদের ভোগ করেছেন তারা সবাই খুব কান্নাকাটি করেছে। কেউ কেউ তো তার পা জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু এই মেয়েটা তাদের মত নয়। একেবারে অন্যরকম। তবে সাধারণ মেয়েদের সঙ্গে এর পার্থক্যটা যে কি তা তিনি ধরতে পারছেন না। দেবতা কিছুটা বিস্মিত হন। একই সঙ্গে অপলা সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে ওঠেন। কিন্তু মনের ভাব গোপন রেখে তিনি বলেন
-ঠিক আছে তুমি যা চাও তাই হবে। রাজকন্যা বলে কথা!
-ধন্যবাদ প্রভু।
নিজ হাতে ঘরের সমস্ত প্রদীপ নিভিয়ে দেন দেবতা।
-আপনি এবার খাটে ওঠে বসুন। আমি আমার কেশ দিয়ে আপনার পদযুগল পরিস্কার করে দেই।
প্রসন্ন চিত্তে পালঙ্কে পা ঝুলিয়ে বসেন দেবতা। অপলা তার লম্বা চুল দিয়ে পরম যত্নে দেবতার পা যুগল মুছিয়ে দেয়।
-এবার বস্ত্র পরিহার কর রাজকন্যা।
-আগে আপনার পোশাক খুলতে হবে প্রভু।
-কেন? বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন দেবতা।
-আপনি কেবল আমাকে দেখবেন তা কেন? আমিও আপনাকে দেখতে চাই। দুজন দুজনকে দেখব।
মনে মনে ভয় পেলেও সবকিছু কিন্তু অপলার পরিকল্পনা মতই এগুচ্ছিল। অপলা জানালাগুলো খুলে দেয়। আকাশে তখন মেয়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে চাঁদ। সে দু হাত তুলে চাঁদকে প্রণাম করে। মনে মনে বলে,‘ও চাঁদ, তুমি আমার মান রেখো। এতটা আলো ছড়িও না যাতে আমার শরীর স্পষ্ট হয়।’ পিছন থেকে কৌতুহলী দেবতা প্রশ্ন করেন
-তুমি বুঝি চাঁদের উপাসনাকারী?
-না প্রভু, আমি চাঁদের প্রণয়ী। ওকে খুব ভালোবাসি। দেবতা হেসে ওঠেন অপলার কথায়।
-এতদিন ধরে সবাই তো চাঁদকে নারীর সঙ্গে তুলনা করত। তুমি তো ওকে পুরুষ বানিয়ে দিলে হে রাজকন্যা।
এ কথার কোনো উত্তর দেয়না অপলা। ও ব্যস্ত হাতে দেবতাকে উলঙ্গ করে। এরপর নিজের পোশাক ছেড়ে শয্যায় যায়।
-রাজকন্যা, তোমার উদর এত স্ফীত কেন?
-প্রভু, আপনি তো জানেন আমি তেমন রূপসী নই। ক্ষীণ কটি, সুঢৌল বাহু, দারিম্ব ফলের মত ওষ্ঠ আর কুচফলের মত গাত্রবর্ণ এসব কোনটাই আমার নেই।
-কিন্তু তোমার চুলগুলো ভারি সুন্দর। এই চুলই ঢেকে দিয়েছে তোমার যাবতীয় ত্রুটি।
অপলা নিজেও মনে মনে তার চুলের তারিফ করে। সে চুলগুলো দুই ভাগ করে ছড়িয়ে দিয়েছে কাঁধের দুই পাশে। এতে তার স্ফীত উদোরের অনেকখানি ঢাকা পড়েছে কালো কেশের আড়ালে।
এদিকে প্রাসাদের বাইরে বসে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে ওঠেছেন রাজা। মনে হচ্ছে সময় যেন থেমে আছে। চাঁদের পুরোটাই ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। তাই পূর্ণিমার রাতকে কালোরাত্রি বলে ভ্রম হয় তার। যেন শেষ নেই এই অশুভ রাত্রের। অকস্মাৎ তীক্ষ্ন শব্দে চমকে ওঠেন রাজা। যেন দূরে কোথাও সাঁইরেন বাজছে। নিভে গেছে ভবনের সব আলো। প্রাসাদের অভ্যন্তরে কেমন যেন একটা অস্থিরতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তিনি ছুটে যান দ্বারের কাছে। আঁকুতি করেন দ্বাররক্ষীর কাছে।
-ভাই আমাকে ভিতরে যেতে দাও। আমার মেয়ের কোনো অঘটন ঘটেছে কিনা দেখতে হবে। রাজার আকুতি দেখে দ্বাররক্ষীর মন বুঝি নরম হয়। সে তাকে প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেয়, দেবতার অনুমতি ছাড়াই। হতে পারে সে নিজেও প্রাসাদের ভিতরের গন্ডগোল কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল।

 ভিতরে প্রবেশ করে বিস্ময়ে থ হয়ে যান রাজা। দেবতার সেই যুবাবেশ কোথায় বিলীন! এ যে এক লোলচর্ম বৃদ্ধ! তার দুধে আলতা শরীর যেন পুড়ে ছাই। চোখ দুটো আগুনের গোলা। যেন ওই চোখের আগুন দিয়েই গোটা পৃথিবী পুড়িয়ে ভস্ম করে দেবেন। অন্যদিকে তার মেয়ের দু চোখে তৃপ্তির আনন্দ। ঠোঁটে স্মিত হাসি। যেন আজ কত সুখী সে! রাজাকে দেখে গর্জে ওঠেন দেবতা।
-এই রাজা, তোর মেয়ে আমার এত দিনের সাধনা পণ্ড করে দিয়েছে। আমার সব যজ্ঞ শেষ। একটা অচ্ছুৎ অপবিত্র মেয়েকে তুই আমার সেবায় পাঠিয়েছিস। এত সাহস তোর!
-আমার মেয়ে ফুলের মত পবিত্র প্রভু। এমনকি চাঁদের কলঙ্ক আছে। কিন্তু আমার মেয়ের চরিত্রে কোনো দাগ নেই।
-মিথ্যা বলছিস তুই। তোর মেয়ে অসতী। একই সঙ্গে সন্তানসম্ভবা। যদিও এই সন্তানের কোনো পিতৃ পরিচয় নেই। সে হবে একজন জারজ সন্তানের মা।
দেবতার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যান রাজা।
-বাবা, উনি ঠিকই বলেছেন। আমি অস্পৃশ্য নই। তাই বলে অসতীও নই। আমি যা করেছি ভেবে চিন্তে করেছি। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। এই রাজ্যের মেয়েদের রক্ষা করার জন্য এটুকু তো আমাকে করতেই হত।
-বল, কে সেই নরাধম, যে আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়? কার এত বড় সাহস?
-তার পরিচয় তো আমি কিছুতেই আপনাকে দেব না। দিলেই বা কি? সে তো এখন অনেক দূরে। দেবতা হলেও তাকে ধরার সাধ্য আপনার নেই।
-তাহলে তোকেই এই অপরাধের শাস্তি পেতে হবে।
-সে আপনি যা ইচ্ছা করুন। কিন্তু আপনার পক্ষে এরপর আর কোনো মেয়েকে ভোগ করা সম্ভব নয়। আপনি সে ক্ষমতা হারিয়েছেন। আর আপনাকে শাস্তি দিয়েছে স্বয়ং ঈশ্বর। আপাততঃ এটুকুই আমার আনন্দ।
-কী এতবড় আস্পর্ধা! এত বড় অপরাধ করার পরও তোর দেমাগ কমে না। আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি। তুই মরবি না। জীবিতও থাকবি না। এর মাঝামাঝি অবস্থান হবে তোর। তুই না হবি সধবা। না থাকবি বিধবা। এমনই ভাগ্য হবে তোর। তোর দুঃখে গাছের পাতারাও চোখের জল ফেলবে।
রাজা দুই হাতে দেবতার পা জড়িয়ে ধরেন।
-আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু। আমার মেয়ের বয়স অল্প। না বুঝে এত বড় অপরাধ করে ফেলেছে। তাই বলে এতবড় শাস্তি ওকে দেবেন না।
কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল দেবতা এক ঝটকায় পা সরিয়ে নেন।
-যাঃ তোদের কোনো ক্ষমা নেই। নরকের আগুনে ভস্ম হবি তোরা।
-কিন্তু প্রভু আমি যে এত বছর ধরে আপনার সেবা করলাম তার কি এই প্রতিদান!
এবার বুঝি কিছুটা নরম হয় দেবতার মন। তিনি বলেন
-আমার মুখের কথার কোনো নড়চড় হবে না। তবে শাপ মোচনের একটা সুযোগ আমি তোর মেয়েকে দিব। কোনো অনাত্মীয় পুরুষ যদি কখনও ওকে সত্যিকার ভালোবাসে চুমু খায় তবেই ঘটবে ওর শাপমুক্তি। তবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ একজন মৃত নারীকে কে আর ভালোবাসবে বল?
এই কথা বলে প্রতিশোধের হাসি হাসতে হাসতে প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে যান দেবতা। এরপর তাকে আর এ রাজ্যের কোথাও দেখা যায়নি।

সেই রাতে মেয়েকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসেন রাজা। কিন্তু সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে অপলা। রাজবদ্যি এসে তার নাড়ি পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন অপলাকে। এই ঘোষণায় গোটা রাজ্য জুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। কন্যার শোকে পাথর হয়ে গেছেন রাজা। স্থবির হয়ে পড়েছে সমস্ত রাজকার্য। ক্ষণে ক্ষণে সংজ্ঞা হারাচ্ছেন রাজমাতা। রাজকন্যার অকালমৃত্যুর ঘোষণায় প্রজাদের চোখেও জল। অপলার দেহত্যাগে কাঁদছে বনের পাখপাখালি আর গাছের পাতারাও। এই অবস্থায় তার সৎকার্যের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেন রাজকর্মীরা। মন্ত্রী এসে রাজাকে বলেন
-রাজামশাই, আপনি উঠুন। একবার শেষ দেখা দেখুন। এরপর মুখাগ্নি করতে হবে আপনাকেই।
মন্ত্রীর এই কথায় যেন দিশা ফিরে পান রাজা। তিনি ত্রস্তে উঠে দাঁড়ান এবং বলেন,‘না আমার মেয়েকে আমি দাহ করব না।’ তিনি পায়রা নদীর তীর সংলগ্ন ঘন জঙ্গলে একটি দালান নির্মাণের নির্দেশ দেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পালিত হয় সেই নির্দেশ। চারকোনা ওই ঘরটি সাজান হয় প্রয়োজনীয় আসবাব দিয়ে। আরো দেয়া হয় খাবার, পানি এবং পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছু। এইসব এতটাই পরিমাণ দেয়া হয় যেন একজন মানুষের এক যুগ চলে যায়। সবশেষে অপলাকে শুইয়ে দেয়া হয় খাটে। তখনও তাকে এতটাই জীবন্ত লাগছিল যেন ঘুমিয়ে আছে। গায়ে একটা টোকা দিলেই ওঠে পড়বে সে। রাজা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ান এবং কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসেন ওই বাড়িটা থেকে। এরপরই ওই ঘরে প্রবেশের দরজাটা ইট সিমেন্ট দিয়ে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন রাজমিস্ত্রী।

প্রথম পর্ব সমাপ্ত

মাহমুদা আকতার: লেখক ও সাংবাদিক। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচটি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/