বায়েজিদ হোসেনের গল্প ‘বিষন্ন বিধুর’

বায়েজিদ হোসেন

বিষন্ন বিধুর

এক যুগের দাম্পত্য জীবনে একটি সন্তান জন্ম দিতে না পারার কষ্টের অনলে প্রতিদিন দগ্ধ হচ্ছে সুজাত-অন্তরা দম্পতি ৷ কলেজে পড়ার সময় পরিচয় হয় সুজাত-অন্তরার ৷ ধীরে ধীরে পরিচয় থেকে প্রেম তারপরে পরিণয়ে বাধা পড়ে দুজন ৷ মধ্যবিত্ত পরিবার অর্থের অভাব থাকলেও ভালোবাসার অভাব ছিলো না তাদের ৷ প্রেম-খুনসুটির একে একে কেটে গেছে বারো বছর ৷ এখন একটা নতুন মুখ বড় প্রয়োজন এই সংসারে ৷ ছোটছোট পায়ে ছুটোছুটি , নিষ্পাপ হাসি, যে হাসি ঘরকে বেহেস্তখানা বানাবে, তার অভাবে কাতর তারা ৷ তার উপর আত্মীয়-স্বজন,পাড়াপড়শির তীর্যক কথার বাণে বিদ্ধ হতে হচ্ছে সর্বদা ৷ যদিও এব্যাপারটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়নি, তবুও অন্তরাকে একটি সন্তান উপহার দিতে পারলে যে খুশির ঝিলিক ফুটবে তা দেখার বড্ড শখ সুজাতের ৷ সেটি না পারার কষ্ট সুজাতকে গিলে খাচ্ছে ৷

অফিস থেকে ফেরার পথে একদিন গুলিস্তানের পার্কের মধ্যে একটি ছিন্নমুল বাচ্চাদের স্কুল দেখতে পায় সুজাত ৷ একটি এনজিও পরিচালিত স্কুলে প্রায় ২০ জন ছিন্নমুল ছেলেমেয়ে ঘাসের উপর বই খাতা নিয়ে বসে আছে ৷ তাদের সবার বয়স ৭-৮ বছরের মধ্যে ৷ আশেপাশের বস্তিতে অথবা ফুটপাতই এদের ঠিকানা৷ কারো বাবা আছে মা নেই, কারো মা আছে বাবা নেই ৷ কারো কারো বাবা মা কেউ নেই ৷ সারাদিন কাগজ কুড়িয়ে, ফুল বিক্রি করে, কোনও দিন খেয়ে, কোনদিন না খেয়ে দিন পার করে ৷ দুজন স্বেচ্ছাসেবক তরুণ- তরুণী তাদের পাঠদান করছে ৷ সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের শিক্ষার কার্যক্রম খুব ভালো লাগে সুজাতের ৷ পাঠদানরত তরুণ- তরুণীকে বলে ওদের সকলের জন্য বিকালের নাস্তার ব্যবস্থা করে সে ৷ সকলে মিলে নাস্তা খাবার সময় চার বা পাঁচ বছরের একটি মেয়ের দিকে চোখ আটকে যায় তার ৷ গায়ের রং কালো ৷ শরীরে ধূলো-ময়লা লেগে থাকায় হয়ত রংটা বেশি কালো লাগছে , ডাগর ডাগর দুটো মায়াবী চোখ, ধূলিধূসর রুক্ষ এলোমেলো ছোট ছোট চুল, মায়ায় ভরা মুখশ্রী ৷ স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষিকার সাথে আলাপ করে জানা যায় মেয়েটির নাম বকুল ৷ বাবা-মা আত্মীয় কেউ নেই ৷ বাচ্চাটি দত্তক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে  সুজাত ৷ স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষিকা তাকে তাদের সংগঠনের টিম লিডারের সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন। সিদ্ধান্ত হয় পরদিন শুক্রবার টিম লিডারের সাথে কথা বলতে সুজাতকে নিয়ে যাবেন তারা ৷  সুজাত যেন অন্ধকারে আলো দেখতে পেলেন ৷ বাড়িতে একটি নতুন মুখ আসবে ৷ অন্তরার মুখে হাসি ফুটবে ৷ নিজেদের সাধ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে বকুলকে তারা বড় করবে ৷ আহা বকুল ! তুই আমার ঘরের রাজকন্যা হয়ে আসবি৷ অন্তরার কাছে কথাটি গোপন করে সুজাত ৷ অন্তরাকে সারপ্রাইজ দিবে সে ৷ যখন বকুলকে নিয়ে ঘরে আসবে তখন অন্তরার আনন্দাশ্রু সিক্ত মুখচ্ছবি কল্পনা করে পুলকিত হয় সুজাত ৷ হৃদয়ে বাসন্তী বায়ুর হিল্লোল জাগে ৷ সুখস্বপ্নে ঘুম আসে না সুজাতের ৷ বারবার এপাশ ওপাশ করতে থাকে ৷ ঘুম ভেঙে যায় অন্তরার ৷ জানতে চায় সুজাতের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা ? বহুকষ্টে কথাটি চেপে যায় সুজাত ৷ সকাল সকাল শয্যা ছেড়ে উঠে পড়ে সুজাত ৷ তখনও সকালের নাস্তা তৈরি শেষ হয়নি অন্তরার ৷ শুক্রবারে সাধারণত বেশ বেলা করেই শয্যাত্যাগ করে সুজাত ৷ আজ এতো তাড়াতাড়ি উঠে পড়ায় অবাক হয় অন্তরা ৷ গোসল করে নাস্তা খেয়ে বের হয় সুজাত ৷

দশটায় এনজিওর টিম লিডারের সাথে দেখা হবার সময় থাকলেও সুজাত পৌঁছে যায় এক ঘন্টা আগেই ৷ একা একা পায়চারি করতে থাকে পার্কের মধ্যে।  হঠাৎ পার্কে আবির্ভাব হয় বকুলের ৷ বকুলের কাছে এগিয়ে যায় সুজাত ৷ দুজনে আলাপ জমায় ৷ যদিও বকুলকে সে নিয়ে যাবে সেটা জানায় না ৷ বকুলকে নিয়ে পাশের হোটেল থেকে নাস্তা খায় সুজাত ৷ তারপর দুইটা আইসক্রিম নিয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে খেতে খেতে গল্প করে ৷ সুজাতের হৃদয়ে পিতৃস্নেহের জোয়ার ওঠে ৷ বকুল যেন তার কত আপন!  পুর্বের বহুজন্মে বকুল যেন ওরই ঔরসজাত সন্তান ছিলো ৷ আহা, বকুল!তুমি আমার কন্যা হবে ৷ আমার রাজকন্যা ৷
-সাত সকালে আইসক্রিম খাওয়া হচ্ছে ? স্বেচ্ছাসেবী স্কুলের শিক্ষিকার ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ে সুজাতের। ৷
-গুড মর্নিং সুজাত সাহেব ৷ আমি দিলরুবা ৷ দিলরুবা রহমান ৷ আপনি যে স্কুলটি দেখেছেন ওই এনজিওর টিম লিডার আমি ৷
দিলরুবা রহমানের বয়স ৩৫/৩৬ হবে হয়ত ৷ ছোট করে ছাটা চুল ৷ আধুনিক পোশাক-পরিচ্ছেদে তাকে টিম লিডারই দেখাচ্ছিল বটে ৷
-স্লামেলেকুম আপু ৷ কেমন আছেন ?
-ভালো আছি ৷ নিধি তুমি বকুলকে স্কুলের দিকে নিয়ে যাও, আমি উনার সাথে কথা বলছি , বলে শিক্ষিকাকে নির্দেশনা দেন ৷
-নিধির থেকে বকুলের দত্তক নিতে আপনার আগ্রহের ব্যাপারটা জানতে পেরেছি ৷ আপনার থেকে বিষয়টি ভালোভাবে জানতে চাই ৷
-আমার নাম সুজাত ৷ বয়স ৩৭ বছর ৷ একটি কোম্পানিতে বিপনন বিভাগে কাজ করি ৷ আমার স্ত্রী অন্তরা ৷ আমরা সমবয়সী ৷ প্রায় বারো বছর আমরা বিয়ে করেছি, কিন্তু আমাদের কোন সন্তান নেই ৷ আমার এবং অন্তরার অনেক স্বপ্ন ছিলো আমাদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে ৷ তাকে ঘিরেই আবর্তন করবে আমাদের জীবন ৷ কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস আমাদের সে স্বপ্ন পুরণের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েছি কিন্তু কোনও লাভ হলো না ৷ তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটি কন্যা সন্তান দত্তক নিবো ৷ সেদিন গুলিস্তান পার্কে বকুলকে দেখে আমার মনে হয়েছে ওকে যেন আমার ঘরের জন্যই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে ৷
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন সুজাত ৷
-দেখুন সুজাত সাহেব আপনার কষ্টটা আমি বুঝি৷কিন্তু আমি চাইলেই তো আর বকুলকে আপনার হাতে তুলে দিতে পারি না ৷ অনেক নিয়ম কানুন আছে ৷ প্রচলিত আইন আছে ৷ সেসব মানলেই তবে আপনি বকুলকে দত্তক নিতে পারবেন ৷
-কি করতে হবে বলুন ৷
সুজাতের কণ্ঠে উত্তেজনা ৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যে সে একটি কন্যা সন্তানের বাবা হবে ৷ অন্তরার কোলে আসবে বকুল ৷ আহ! ঘরটা জান্নাতে রূপ নিবে ৷ অন্তরার হাসিমুখের ছবি ভেসে ওঠে তার কল্পনার চোখে ৷ আহ! কিন্তু তার পরের কথাগুলোর জন্য তৈরী ছিলো না সুজাত ৷
-দেখুন সুজাত সাহেব বকুলকে দত্তক নিতে হলে আপনাকে নগদ দশ লক্ষ টাকার এফডিআর খুলতে হবে বকুলের নামে ৷ ওর নামে কমপক্ষে দুই বিঘা ল্যান্ড লিখে দিতে হবে ৷ এছাড়াও সরকারি যে সব বিধিনিষেধ আছে তা মানতে হবে ৷
যেন আকাশ ভেঙে পড়লো সুজাতের মাথায়। এতো টাকা সে কোথায় পাবে ? সামান্য চাকুরিজীবী সে ৷ পরিবাকে ভালোভাবে খাইয়ে পড়িয়ে চালাতে পারবে কিন্তু এতোগুলো লগদ টাকা সে কোথা থেকে পাবে ? এই জীবনে বুঝি আর বাবা ডাক শোনার ভাগ্য  হলো না ৷ তবুও একটু চেষ্টা করে দেখতে চাইলো সে ৷
–অত টাকা কোথায় পাবো আপু ? অন্য কোন উপায় কি নেই ?
–সুজাত সাহেব আপনার ইমোশনটা আমি বুঝি কিন্তু কোন উপায় নেই ৷ ওর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত না করে তো ওকে আমরা ছাড়তে পারি না ৷
–তা ঠিক তবে বকুল এখন যেমন আছে তার চেয়ে তো ভালো থাকবে ৷ খেতে পারবে, স্কুলে যেতে পারবে , মা-বাবা পাবে ৷
–রাইট বাট আমরা তো ল' এর বাইরে কিছু করতে পারবো না ৷ আফটার অল আমরা তো একটা দেশে বাস করি ৷ দেশের ও তো একটা ল' আছে নাকি বলেন ?
–হুমম আমরা একটা দেশে বাস করি বটে যে, নিজেও খাওয়াতে পারবে না আবার অন্যকেও খাওয়াতে দিবে না ৷
— আই অ্যাম সরি মি. সুজাত সাহেব আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারলাম না ৷

চলে গেলেন দিলরুবা রহমান একাকী বসে আছেন সুজাত ৷ এই রোদ ঝলমলে দিনেও অমাবস্যার অন্ধকার দেখছে সুজাত ৷ আহ! জীবন ৷ গতকাল থেকে যে হাজারো স্বপ্ন দেখছিল বকুলকে নিয়ে, তার রাজকন্যাকে নিয়ে, অন্তরার হাসি মুখ নিয়ে, বাড়িতে ছুটাছুটি করা কন্যাকে নিয়ে তা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ৷ এটা কি দুঃস্বপ্ন ছিল? শুধু অর্থের অভাবে বাবা ডাক শুনতে পাবো না আমি কখনও ?  আর অন্তরা ! মাতৃত্বের স্বাদ কখনই পাবে না ?

লেখক পরিচিতি: বায়েজিদ হোসেন একজন তরুণ লেখক। জন্ম ঝিনাইদহ জেলায় হলেও বর্তমানে বসবাস করছেন গাজীপুরে। খুব অল্প বয়স থেকেই তার কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। বিভিন্ন জাতীয় ও অনলাইন পোর্টালে নিয়মিত লিখছেন। কেবল কবিতা নয়, লিখছেন গল্প, উপন্যাসও। তার একাধিক কবিতাগ্রন্থ, উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায় আছে ৷ তিনি তার লেখার মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরার চেষ্টা করেন ৷

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/