ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স: কিছু স্মৃতি

নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুস সালাম ও আইসিটিপি মেইন বিল্ডিং

পুরুষোত্তম চক্রবর্তী

ইতালির ত্রিয়েস্তে শহরে অবস্হিত বিশ্ববিখ্যাত ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স’ বা সংক্ষেপে আই-সি-টি-পি। স্বনামধন্য নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালাম প্রতিষ্ঠিত ও তার নামাঙ্কিত এই গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে ডেপুটেশনে আমাকে চার মাসের জন্য পাঠানো হল আই-সি-টি-পি তে। উদ্দেশ্য ওখানে ‘কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স’ এর উপরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করা। কলকাতা থেকে একমাত্র আমিই ঐ কর্মশালায় যোগদান করার সুযোগ পেয়েছিলাম।

ত্রিয়েস্তে ইতালির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর এবং সমুদ্র বন্দর। আড্রিয়াটিক সাগর এবং ইতালি-স্লোভেনিয়া সীমান্তের মাঝে যে সরু অঞ্চলটি রয়েছে তার শেষ প্রান্তে শহরটির অবস্থান। এর দক্ষিণ, পূর্ব এবং উত্তর তিন দিকেই স্লোভেনিয়া এবং একদিকে ত্রিয়েস্তে উপসাগর। জার্মান সাম্রাজ্য, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য এবং স্লাভিক সংস্কৃতির দেশগুলোর ঠিক মাঝখানে অবস্থিত হওয়ার কারণে ইতিহাসের বিভিন্ন সময় জুড়ে এটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বলে বিবেচিত হতো। ১৩৮২ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত যে হাবসবুর্গ রাজতন্ত্র অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সম্রাজ্য শাসন করেছে তার সবচেয়ে পুরনো স্থানগুলোর একটি এই ত্রিয়েস্তে। সে সময় এটি ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর ছিল। ভূমধ্যসাগরের একটি সমৃদ্ধ বন্দর হওয়ার কারণে ত্রিয়েস্তে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সম্রাজ্যের চতুর্থ বৃহত্তম শহরে (ভিয়েনা, বুদাপেস্ট এবং প্রাগ-এর পরেই) পরিণত হয়েছিল। fin-de-siècle যুগে এটি সাহিত্য ও সঙ্গীতেরও অন্যতম কেন্দ্র ছিল। অবশ্য অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সম্রাজ্যের পতন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালির সাথে ত্রিয়েস্তের একীকরণের পর এই শহরের ইউরোপীয় গুরুত্ব বেশ কমে গেছে। ১৯৩০-এর দশক এবং স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে আবার এখানে অর্থনৈতিক উন্নতি শুরু হয়। ইউরোপের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের স্নায়ু যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এই শহর। বর্তমানে এটি ইতালির সবচেয়ে সুন্দর ও ধনী শহরগুলোর একটি, বিশেষত সমুদ্র বাণিজ্যের কারণে।

আই-সি-টি-পি তে থাকাকালীন অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী দের বক্তৃতা শুনবার সুযোগ হয়েছিল ও তাদের সাথে পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাদের মধ্যে আব্দুস সালাম ছাড়াও আরও কয়েকজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ছিলেন। কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে মনে পড়ছে, যেমন সুইজারল্যান্ডের IBM Zurich এর Gerd Binnig ওHeinrich Rohrer, যারা সদ্য Scanning Tunneling Microscopy আবিস্কারের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন এবং দুজনেই এই আবিস্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ঐ বছরই high-temperature superconductor এর উপর গবেষণা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে সারা পৃথিবীতে। ওই বিষয়ের উপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আমাদের কর্মশালার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সুবাদে তদানীন্তন তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই বিষয় নিয়ে রীতিমত বাকবিতণ্ডা বা তর্কবিতর্ক শুনবার সুযোগ হাতছাড়া করতে পারিনি। তখন BCS (Bardeen-Cooper-Shrieffer) theory ই ছিল একমাত্র microscopy theory of superconductivity এবং সেই থিওরি একরকম সারা ফেলে দিয়েছিল সমগ্র পৃথিবীতে। সেই BCS theory – খ্যাত নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী Robert Schrieffer এর সাথে সরাসরি কথা বলতে পেরে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল। সেই একই সম্মেলনে এসেছিলেন আরেক নোবেলজয়ী রাশিয়ার Vitaly Ginzburg, যার পান্ডিত্য ছিল অপরিসীম।  Superconductivity ও Superfluidity দুটো বিষয়েই ছিলেন তার অনায়াস বিচরণ।

এসেছিলেন Polish Academy of Science এর পদার্থবিজ্ঞানী Tomasz Dietl, যিনি একই সঙ্গে Warsaw University’র তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। Cryogenics এবং Spintronics এর উপর গবেষণায় এর খ্যাতি ভূবনজোড়া। আলাপ পরিচয় থেকে একসাথে খাওয়া দাওয়া, একই রুম শেয়ার করা ইত্যাদি আমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু হবার সুযোগ করে দিয়েছিল। আইসিটিপি কর্মশালায় আমার একটি বক্তৃতা শুনে টমাজ এত খুশি হয়েছিলেন যে আমাকে সরাসরি আমন্ত্রণই  জানিয়ে ফেললেন পোলিশ অ্যাকাডেমী অফ সায়েন্স ভিজিট করার জন্য। পরের বছর সেই আমন্ত্রণের সদ্ব্যবহার করতে পোল্যান্ডে গিয়েছিলাম। পোলিশ অ্যাকাডেমী অফ সায়েন্স ও লুবলিনে (Lublin – মাদাম কুরির জন্মস্থান) বিখ্যাত মেরি কুরি স্ক্লোডওস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে এত সুখ্যাতি পেয়েছিলাম যে ভাবলে আজও নিজেকে গর্বিত মনে হয়। মেরি কুরি ইউনিভার্সিটির ভিতরে অবস্হিত 'ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স' এর অধিকর্তা প্রফেসর Bogdan Adamczyk (বগডান আ্যাডমচিক) এর ভালোবাসা যুক্ত আমন্ত্রণ ও তার আথিতেয়তার টানে পোল্যান্ডে আরও কয়েকবার গিয়েছি এবং  ইনষ্টিটিউট অব ফিজিক্সে বক্তৃতা দিয়েছি। পোল্যান্ড আমার ভালোবাসার দেশ, এক বিরাট অভিজ্ঞতার দেশ! এ বিষয়ে পরে কখনও বিস্তারিত আলোচনা করবো।

আইসিটিপি কর্মশালার শেষের দিকে এল সেই সুবর্ণ সুযোগ, যা ছিল আমার কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত। কোন এক দুপুরে আইসিটিপির 'আদ্রিয়াটিকো' ক্যানটিনে সবেমাত্র লাঞ্চ খেতে বসেছি, একেবারে একই টেবিলে আমার বিপরীতেই বসে পড়লেন স্বনামধন্য আব্দুস সালাম। আমার বিপরীতে বসে আছেন আইসিটিপির প্রতিষ্ঠাতা ও অধিকর্তা নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালাম – এ যে কল্পনাতীত! ১৯৭৯ সালে আব্দুস সালাম তার ‘theory of unification of weak and electromagnetic interactions between elementary particles’ এর জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তার এই আবিস্কার পরবর্তী কালে যে 'Higgs Boson' আবিস্কারের চাবিকাঠি হয়ে উঠেছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। সেদিন খাবার টেবিলে বসে আমার সঙ্গে প্রফেসর সালামের খোলামেলা হাস্যময় আলাপচারিতা আজও আমার স্মৃতিপটে অমলিন হয়ে আছে। সঙ্গের দুটি ছবির একটিতে আইসিটিপি মেইন বিল্ডিং ও অপরটিতে প্রফেসর আব্দুস সালামকে দেখানো হয়েছে।

দেখতে দেখতে চার মাস শেষ হয়ে গেল। ত্রিয়েস্তে বিমান বন্দর থেকে প্লেনে এক ঘন্টার মধ্যেই রোমের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এসে পৌঁছালাম। প্রায় ঘন্টা ছয়েক পরেই দিল্লির প্লেনে উঠতে হবে। মনে আছে, রোম থেকে ইতালীয় এয়ারলাইন্স "আলিতালিয়া" তে দিল্লি পৌঁছাবার কথা। টিকিট দেখিয়ে চেক-ইন পর্ব চুকিয়ে লাগেজ পাঠিয়ে দিলাম কনভেয়র বেল্টে। বোর্ডিং পাস হস্তগত হলো। ইমিগ্রেশন হয়ে যাবার পর একেবারে ভিতরে এসে নির্ধারিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। ভাবলাম অনেকটা সময় আছে, একটু ঘোরাঘুরি করা যাক। পকেটে বিশেষ পয়সা নেই। সর্বসাকুল্যে দশ ডলারের মত হবে। কাঁধে শুধু একটি ছোট ব্যাগ যার মধ্যে কিছু কাগজপত্র,পাসপোর্ট ও ওয়ালেট। ব্লেজারের পকেটে বোর্ডিং পাশ। এক ডলার দিয়ে কফি খেলাম। এয়ারপোর্টের ভিতরে স্টলগুলো ঘুরে দেখতে ভালো লাগে এবং প্রয়োজন না থাকলেও দু-একটি ছোটখাটো জিনিস কিনতে আরও ভালো লাগে। তাই দুচারটে দোকান পরিদর্শন ও একটু পায়চারি করতে থাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাইকে মহিলাকন্ঠ নিঃসৃত ঘোষণা ভেসে এলো – ‘আলিতালিয়া দিল্লি ফ্লাইট নাম্বার ১২ – প্যাসেঞ্জারস্ আর রিকোয়েস্টেড টু প্লিজ প্রসিড টু দা গেট নাম্বার বি – ৫৭ ইমিডিয়েটলি ফর বোর্ডিং।’

ছুটতে শুরু করলাম। নির্ধারিত গেটের কাছে এসে দেখি বিরাট লম্বা লাইন। একদম পিছনে দাঁড়িয়েই হঠাৎ ব্লেজারের পকেটে চোখ পড়লো। সর্বনাশ – বোর্ডিং পাশ কোথায়! তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও বোর্ডিং পাশ পেলাম না। হাত পা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। চোখে জল চলে এলো। হায় হায় কি করবো এখন! এই ভাবতে ভাবতে বোর্ডিং – গেটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে একজন বললো ‘বোর্ডিং পাশ প্লিজ!’

বোকার মত ক্ষীণ কন্ঠস্বরে বললাম ‘I've lost my boarding pass. Will you allow me to board in please?’
ও প্রান্ত থেকে উত্তর ‘What?’
আমি বললাম ‘Please check my name in your computer. I'm a bonafide passanger in this flight’.
ভদ্রমহিলা কম্পিউটার ঘেঁটে বলে উঠলেন ‘sorry, I don't find your name. You are not at all any passanger. Your name is not in the passanger list’.

আমি তো বিষ্ময়ে হতবাক। বলে কি? আমার নামটাই নেই কম্পিউটারে এই ফ্লাইটের passanger list এ? বুঝতে অসুবিধে হোলনা যে আমার বোর্ডিং পাশটি বিক্রি হয়ে গিয়েছে অন্য কারও নামে এবং সেটা এয়ারপোর্টের ভিতরেই কারো দুস্কৃতি! ইতালিতে ছিনতাইয়ের কথা আগেও শুনেছিলাম, সেটার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সাক্ষী আজ হলাম। বুঝতে পারলাম আমার ব্লেজারের পকেট থেকে উঁকি মারা বোর্ডিং পাশ টি কেউ আমার অজান্তেই পকেটমারি করেছে ও রাতারাতি আমার নাম প্যাসেঞ্জার লিস্ট থেকে মুছে দিয়েছে। অর্থাৎ আমার বোর্ডিং পাস টি এই মুহূর্তে অন্য কারও  মালিকানাধীন হয়েছে।

আমি একেবারে শোকে মূহ্যমান ও নীরবে অশ্রুপাত করা ছাড়া আমার আর কোন পথ ছিলনা! আকাশ পাতাল ভাবছি কি করবো! একটু পরেই কাঁচের মধ্য দিয়ে আমার দিল্লিগামী ফ্লাইটটিকে টেক অফ্ করতে দেখলাম এবং নিমেষেই সে আমার লাগেজ কে নিয়ে আকাশে ঊড্ডীয়মান হলো।

কিছুক্ষণের জন্য চতুর্দিক একদম ফাঁকা। পরবর্তী অন্য কোন ফ্লাইটের বোর্ড লেগে গেল সেই গেটে। কাউন্টারের এখন অন্য মহিলারা, কার সঙ্গে কথা বলবো ভেবে উঠতে পারছিলাম না। ভাবলাম, এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলা যাক। দেখা যাক উনি কিছু সুরাহা করতে পারেন কি না! দেখা করলাম এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের সাথে। উনি ইতালীয় অ্যাকসেন্টে ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে বললেন ‘ও কে, ইউ হ্যাভ তু বাই এ ফ্রেস তিকেত ফর দি নেক্সত ফ্লাইত। আই অ্যাম গোয়িং তু ইসু এ তিকেত ফর ইউ’। আমি বললাম, ‘I've no money. How can I buy a ticket?’ ভদ্রলোক বেশ রেগে বলে উঠলেন ‘আই দোন্ত নো। ইউ মাস্ত বাই ইওর তিকেত।’

আমি প্রায় কেঁদেই ফেললাম। বললাম ‘please help me! My luggage is gone! My family is waiting for me. I have no money’. ভদ্রলোক একটু পোলাইট হয়ে বললেন ‘হোয়ার আর ইউ ফ্রম?’ আমি একটু সাহস সঞ্চয় করে গড় গড় করে বল্লাম- ‘ICTP in Trieste’. I was attending an international workshop on condensed matter physics there as an ICTP Associate’.

মুহূর্তে ভদ্রলোকের মেজাজ একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল। অনেকটা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ইসিটিপি, ব্রাভো!’ বুঝতে পারলাম, ইতালিতে আইসিটিপির খুবই কদর ও মর্যাদা। ভদ্রলোক আমাকে বিনীত ভাবে বললেন ‘ওকে, উই আর গোইং তু ইসু এ তিকেত ফর দি নেক্সত্ আলিতালিয়া দেল্লী ফ্লাইত ফর ইউ। ইউ দোন্ত হ্যাভ তু পে। বাত দি ফ্লাইত ইজ নত তুদে, ইত ইজ দে আফতার তু-মরো।’ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভদ্রলোক কে ধন্যবাদের পর ধন্যবাদ দিতে থাকলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নতুন টিকিট হাতে এসে গেল। ভদ্রলোক কে বললাম ‘আচ্ছা, আমি কি এখানে থাকতে পারি দুটো রাত?’ ভদ্রলোক বললেন ‘নো, নো, ইউ মাস্ত গো আউত অ্যান্দ হ্যাভ তু দু ইমিগ্রেশন এগেইন দে আফতার তু-মরো। ইউ মাস্ত গো আউত।’

আকাশ ভেঙে পড়লো মাথায়। দুদিন কোথায় থাকবো, খাবো কি? পকেটে মাত্র দশ ডলার সম্বল! সে এক কঠিন পরীক্ষা। ঈশ্বর বোধহয় আমাকে সেদিন অসীম দয়া করেছিলেন, তা না হলে আমার দু-দিন হয়তো রোমের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হতো! এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে এসে একটি ট্যাক্সি ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলাম ‘খুব কাছাকাছি সস্তায় কোন থাকবার জায়গা আছে? লোকটি ইংরেজী ভালোই বলতে পারে দেখলাম। ও আমাকে বললো ‘তোমাকে এয়ারপোর্টের খুব কাছে costal area Fiumicino তে নামিয়ে দিচ্ছি। ওখানে অনেক ছোট ছোট ঘর আছে যা দিনে ১০ ডলারের মত ভাড়া।’ বললাম ‘ঠিক আছে।’ পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফুমিচিনো জায়গাটিতে এসে পৌঁছালাম। পাঁচ ডলার চলে গেল ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে দিতে। পড়ে রইল আর পাঁচ ডলার।

একেবারে সমুদ্র সৈকত। কয়েকশো জেলে মাছ ধরছে আর পাড়ে পাহাড়ের মত মাছ স্তুপাকৃতি করে রাখছে। মাছের গন্ধে একেবারে ম ম করছে সমস্ত অঞ্চলটি। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগিয়ে গেলাম সমুদ্র কূলবর্তী লোকালয়ের দিকে। সারিবদ্ধ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘর। একজন লোক কোনরকমে ঢুকতে পারে। দু ফুটের মত চওড়া একটি তক্তাপোশ। কোন বিছানা নেই, একটি ছোট্ট বালিশ মাত্র। ঘরগুলোতে কোন জলের ব্যাবস্হা নেই। বাথরুম বা পায়খানা একটি আছে কিছুটা দূরে; অনেকের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। প্রতিটি ঘরের দৈনিক ভাড়া ৮ ডলার। মালকিন একজন ইতালীয় বয়স্কা মহিলা, আনুমানিক ৭০ বছর বয়স! তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার কাছে গিয়ে দাড়াতেই আমার পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। পাশেই কাউকে দিয়ে পার্শ্ববর্তী কোনও দোকান থেকে পাসপোর্টের একটি ফোটোকপি করিয়ে আনলেন এবং পাসপোর্টটি আমায় ফেরৎ দিলেন। একটি ঘরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন এবং বললেন ‘ঐ টি তোমার, ১৬ ডলার লাগবে দু-রাত্রের জন্য।’

আমি ততক্ষণে কেঁদে ফেলেছি, মুখ থেকে কোন কথা বেরচ্ছে না। তাকে মা বলে সম্বোধন করলাম। বললাম ‘মা, আমার কাছে মাত্র পাঁচ ডলার আছে। এটা দিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে আমাকে পরশু আবার এয়ারপোর্টে যেতে হবে। এছাড়া আমার কাছে কোন পয়সা নেই। আমার বোর্ডিং-পাস চুরি হয়ে গিয়েছে। আমার দিল্লিগামী পরবর্তী ফ্লাইট আগামী পরশু। আমি তোমাকে কি করে পয়সা দেবো, আর কি ই যে খাবো তাই তো জানি না।’ ঐ ভদ্রমহিলা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর দেখলাম তার চোখে জল! আমাকে বললেন ‘তুমি থাকো এখানে। একটা পয়সাও দিতে হবে না। তোমার খাবার আমি তোমার ঘরে পৌঁছে দেবো। তুমি একটু হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি তোমার খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

একটু পরেই একটি কাচের প্লেটে গরম স্প্যাগটি, সঙ্গে একটি চামচ। চিজের গুঁড়ো ছড়ানো প্লেটভর্তি মোলায়েম স্প্যাগটি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মনে হলো যেন করুণাময় পরমেশ্বর উপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সেই মহীয়সী নারীই যে স্বয়ং ঈশ্বর বা ঈশ্বরপ্রেরিত মহামানবী, তাতে কোন সংশয় ছিল না। দুটো দিন দুটো রাত সেই মায়ের আশ্রয়েই কেটে গিয়েছিল পরম নিশ্চিন্তে!

পুরুষোত্তম চক্রবর্তী: প্রফেসর, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ আফ্রিকা। অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র প্রফেসর, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, আনবিক শক্তি দপ্তর, ভারত সরকার, কলকাতা।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/