শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল

আজ ১৩ মার্চ, দেশের  বরেণ্য কবি আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্মদিন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও উপস্থাপক। অনেক কালজয়ী বাংলা গানের স্রষ্টা হিসাবেও সুখ্যাতি রয়েছে তার। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার।

প্রাথমিক ও কর্মজীবন
১৯৩৬ সালের ১৩ মার্চ  পাবনা জেলার উল্লাপাড়ার গোবিন্দা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন  আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বাবা এম. শাহজাহান আলী ছিলেন স্কুল শিক্ষক। আর মা খালেসুননেসা ভালো গান গাইতেন। মায়ের প্রভাবে শৈশবে গায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন এই কবি। তবে গায়ক না হতে পারলেও হয়েছেন দেশের সেরা গান রচয়িতা। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শৈশব থেকেই লেখাপড়ায় ভীষন মনোযোগী ছিলেন আবু হেনা। যে কারণে শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।

পাবনা জেলা স্কুল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাস করেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ১৩তম স্থান অধিকার করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে  উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ৭ম স্থান লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। দুই পরীক্ষাতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। পরে লন্ডন থেকে কমনওয়েলথ শিক্ষাবৃত্তিসহ বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং-১৮১৮-১৮৩১ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৫৯ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বিভিন্ন সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলা একাডেমির মতো শিল্প সাহিত্যের পীঠস্থান হিসাবে স্বীকৃত  দুটি প্রতিষ্ঠানে মহাপরিচালক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

সাহিত্যে অবদান
ছাত্রজীবন থেকেই নিয়মিত কবিতা, গান লিখেছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। পঞ্চাশের দশকে ঢাকাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে নতুন ভুবন তৈরি হচ্ছিল তিনি ছিলেন সেই পরিবৃত্তের তরুণ সদস্যদের একজন। স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম, হৃদয়ের অন্তরঙ্গ অনুভূতি, গভীর আবেগ সব মিলিয়ে আধুনিক শিল্প চর্চার এক পরিশিলিত রূপের দেখা মেলে তার কবিতা আর গানে। অন্তরঙ্গ অনুভব, গাঢ় আবেগ, রোমান্টিক আর্তি এবং স্বদেশবোধের শিল্পিত পরিচর্যা বিশিষ্টতা দিয়েছে তার কবিতা ও গানগুলিকে।

১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ `আপন যৌবন বৈরী`। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ `যেহেতু জন্মান্ধ` প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের দশ বছর পর, ১৯৮৪ সালে। এর চার বছর পর১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় এবং সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ `আক্রান্ত গজল`। তিনটি গ্রন্থে মোট কবিতা আছে শতাধিক। এর বাইরে তার আরও অনেক কবিতা অপ্রকাশিত থেকে গেছে। গান দিয়ে যেমন শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছিলেন তেমনি কবিতা দিয়েও পাঠকের মন জয় করেছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। সমালোচকরাও তার কবিতার প্রশংসা করেছেন।

কবিতা ও গানের পাশাপাশি গদ্য রচনার ক্ষেত্রেও  সৃষ্টিশীলতার নিদর্শন রেখেছেন আবু হেনা। সাহিত্যপাঠের ব্যাপকতা, সাহিত্যবোধের রসঘনতা এবং ভাষাপরিচর্যা তার গদ্য রচনায় এনেছে স্বতন্ত্র স্বাদ। প্রবন্ধ, গবেষণাধর্মী লেখা, সমালোচনা, ভাষ্য-সব ধরনের গদ্য রচনার বক্তব্য, ভাষা, উপস্থাপনা ও ভঙ্গিতে তার স্বকীয়তা সুস্পষ্ট। বাংলা সাহিত্য ও বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন করে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লিখেছেন মোস্তফা কামাল। এসব প্রবন্ধ  ‘শিল্পীর রূপান্তর’ ও ‘কথা ও কবিতা’ নামের দুটি প্রবন্ধ-সংকলনে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্য-সমালোচনায় তার এ গ্রন্থ দুটি বিশিষ্টতার দাবি রাখে।

সমাজ, সাহিত্য ও সমকালীন বিষয়ের ওপর নিয়মিত কলাম লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। দৈনিক বাংলা পত্রিকায় তিনি কলাম লিখতেন `অমৎসর` ও `দ্বিতীয় চিন্তা` নামে। সাপ্তাহিক পত্রিকা `বিচিত্রা`-য় লিখতেন `অবান্তর কথকতা` নামে। `চিত্রালী উপহার` পত্রিকায় লিখতেন `অতিথির কলাম`। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত `ধান শালিকের দেশ` পত্রিকায় `ইছামতীর সোনালী-রূপালী` শিরোনামে নিজের ছেলেবেলার নানা ঘটনা লিখেছেন।

অনুবাদ সাহিত্যেও অবদান রেখেছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তিনি বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক আলবেয়ার কামুর `ক্যালিগুলা` নাটকটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।

সঙ্গীতে অবদান
বহু কালজয়ী বাংলা গানের স্রষ্টা হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ও বন্ধু আবু বকর খান, আনোয়ারউদ্দিন খান ও মোঃ আসাফদ্দৌলার সহযোগিতায় আধুনিক সঙ্গীত চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র গড়ে তুলতে সমর্থ হন তিনি। তার রচিত অনেক গানে কণ্ঠ ও সুর দিয়েছেন বন্ধু আনোয়ারউদ্দিন খান। এছাড়া বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পী ফেরদৌসী রহমান, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, বশির আহমেদ সানন্দে নিজেদের কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন তার রচিত গান।

যদিও জীবিত অবস্থায় নিজের গানের কোনো সংকলন করেননি আবু হেনা মোস্তফা কামাল। মৃত্যুর পর ১৯৯৫ সালে তার রচিত দুই শতাধিক গান নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রকাশ করে ‘আমি সাগরের নীল’গ্রন্থ। সব মিলিয়ে দুই হাজারের মতো গান লিখেছেন তিনি। আবু হেনা মোস্তফা কামাল গান লিখেছেন শ্বাসত প্রেম, নিসর্গ, প্রকৃতি, উৎসব, দেশাত্ববোধ ও ভাষা নিয়ে। তার গান সম্পর্কে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও সমালোচক আনিসুজ্জামানবলেন- ‘আবু হেনার কবিতার মতো গানেও প্রাধান্য পেয়েছে প্রেম। এক মোহমুগ্ধ, স্বপ্নচারী, আবেগময় সত্ত্বা ক্রিয়াশীল ছিল তার অধিকাংশ গীত রচনার ক্ষেত্রে।’

তার রচিত গানের মধ্যে-অনেক বৃষ্টি ঝরে/ তুমি এলে যেন এক মুঠো রোদ্দুর/ আমার দু`চোখ ভরে; সেই চম্পা নদীর তীরে/ দেখা হবে আবার যদি/ ফাল্গুন আসে গো ফিরে; হাতের কাঁকন ফেলেছি খুলে/ কাজল নেই চোখে/ তবু তোমার কাছে যাবো/ যা বলে বলুক লোকে; আমি সাগরের নীল/ নয়নে মেখেছি এই চৈতালি রাতে; ভ্রমরের পাখনা যতদূরে যাক না ফুলের দেশে/ তুমি তবু গান শুধু শোনাও এসে; নদীর মাঝি বলে: এসো নবীন/ মাঠের কবি বলে এসো নবীন; ওই যে আকাশ নীল হলো আজ/ সে শুধু তোমার প্রেমে; মহুয়ার মোহে গেল দিন যে/ তোমার কাছে আমার কত ঋণ; তুমি যে আমার কবিতা, আমার বাঁশির রাগিনী; এই পৃথিবীর পান্থশালায় গাইতে গেলে গান; তোমার কাজল কেশ ছড়ালো বলে/ এই রাত এমন মধুর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচিত `ওই যে আকাশ নীল হলো, সে শুধু তোমার প্রেমে` গানটি দিয়ে, এতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন ফেরদৌসী রহমান।

পুরস্কার ও সম্মাননা
সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন বহু পুরস্কার। এগুলোর মধ্যে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), সুহৃদ সাহিত্য স্বর্ণপদক (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্বর্ণপদক (১৯৮৯), সাদত আলী আকন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯১) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

পারিবারিক জীবন
আবু হেনা মোস্তফা কামালের বড় বোন সাবেরা খাতুন শামসুন আরা অধ্যাপক এবং মঞ্চ ও বেতারের অভিনেত্রী ছিলেন।  তার স্বামী খ্যাতিমান সাংবাদিক ও গীতিকার কেজি মুস্তাফা। তার ছোট আবুল হায়াৎ মোহাম্মদ কামালও গীতিকার হিসেবে সুপরিচিত। আবু হেনা মোস্তফা কামালের ছেলে  সুজিত মোস্তফা একজন নজরুল সংগীত শিল্পী। এছাড়া  সংগঠক ও গবেষক হিসাবেও তার সুনাম রয়েছে।

মৃত্যু
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসাবে কর্মরত অবস্থায়  ১৯৮৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মারা যান আবু হেনা মোস্তফা কামাল। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৩ বছর।

আজ এই সাহিত্যিকের ৮৮তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন বরেণ্য কবি, লেখক ও গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

শুভ জন্মদিন কথাসাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীন

শুভ জন্মদিন জনপ্রিয় কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদার

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/