সমতার মমতা প্রতিষ্ঠায় দুর্লভ সন্ধি আমরাই লিখবো

হোমায়রা হুমা

নেতৃত্বের সমতা ও বিকাশে একবিংশতি নারী দিবসে নতুন পথ ও মত উন্মোচিত করুক-এই চাই; নারী দিবসের সংগ্রামী অভিনন্দন। নেতৃত্বের বিকাশিত পথপ্রদর্শক,আলোকিত দৃঢ়চেতা নেত্রী ক্লারা জেটকিনকে একবিংশ শতাব্দীর  অভিনন্দন জানাই। বর্তমান সময়ে সমতা ও নেতৃত্বের মধ্যবর্তী সেতুবন্ধনে শোনা যাচ্ছে নারী প্রগতির জয়জয়কার আনন্দ ধ্বণি। প্রকৃতই কি নেতৃত্ব সমতাকে পথ দেখায়? সমতা বললেই কি মিল ও অমিল দুর হয়?

সকল অধিকার পরিবারকে জুড়েই  প্রবাহিত হয়। রান্নাঘর, খাবার টেবিল, খাঁট, আলমিরা, আলনা, সোফা —এসবগুলোর নেতা কে, কার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়? সমতায় অংশগ্রহন কোন ক্ষেত্রে সমানাধিকারকে গ্রাহ্য করে। পরিবারে সকলের অবস্থান ও মর্যাদা এক নয়। কে কাকে কতটুকু সমতায় বিশ্বাসী। — বলতে পারেন ক্ষুদ্রাংশ নিয়ে এত কথা কেন? জানেন তো সংসারের মধ্যেই নারীর দুঃখ, বেদনা, বিছিন্নতা, দৃষ্টিভঙ্গী, অধিকারহীনতা, অসমতা,বৃহদাংশ বিদ্বেষীকে অনুভব করা যায়। আসলে নারীর জন্মই আজন্ম পাপ।

আমি আমাদের পাথেয় পথপ্রদর্শক পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। নুরুন্নেসা চৌধুরানী, বিদ্যাবিনোদিনী, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত,
 নওয়াবজাদী পরীবানু খানম, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মমোরমা বসু, কবি সুফিয়া কামাল, লীলা নাগ, সুহসিনী দাস আরো বহু সংখ্যক থোকা থোকা নাম-তাদের কৌশলী, সাহসী, দৃঢ়চেতা চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তিক দিকদর্শন, আত্মত্যাগ ও জয়ীতা দূরদর্শন ম্যাপ আমাদের আজ কুসংস্কার, ক্ষীণচিন্তা মনোভাব, বাকভঙ্গী থেকে আজকের স্বাধীন আকাশে উড়বার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন-আমি তাদের সংগ্রামের প্রতি নতজানু আজীবন।

একবিংশ শতাব্দীর নারীদের এগিয়ে আসবার আলোকিত পথ ও মতের গতিপথ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মতই বাধাহীন উজ্জ্বলিত গতিময়। তবু নারী ও কন্যার চলার পথের পশ্চাদপদ আতংক ও শংকা হচ্ছে ধর্ষণ, হত্যা, গুম, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহু বিবাহ। ধর্ষণের তাড়না, ভয়, বিচারব্যবস্থার শ্লথ গতি, সাক্ষীর ভয়, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাল্টে যাওয়া, মামলা রুজু করার সময় ধারা বদলে দেয়া, আসামি গ্রেফতারে দীর্ঘসূত্রীতা। আমরা তণু হত্যা,ত্বকী ও সাংবাদিক সাগর রুণি, আরো কতকি অসহায় নারীর কথা জানি শুনি কিন্তু কি করতে পারি!

বিয়ে হয়ে ঘরে আসবার পরই সে পায়ের নিচের বাসিন্দা। বিয়ের কাবিন কে দেয়? সন্তানের ভরণপোষণ কে দেয়? যৌতুক কে চায়? বিবাহিত স্ত্রীর নিরাপত্তা খাদ্য সুব্যবস্থা পরনারী আসক্ত শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদ কে সম্মান দেয়?

পরিবারের কর্মজীবি নারীর উপার্জিত অর্থ সে নিজের জন্য খরচ করতে পারে? নিজের চিকিৎসা, বিনোদন, কেনাকাটা — কোনদিকে সে স্বাধীন : পারিবারিক মা নারীটি। বা কর্মীবুয়া? অথবা বৌ, ননদ,শালী–কত সম্পর্কের মাজেজা। কার কাছে কোথায় কে সমতায় কে মমতায় কে অধিকারে বন্দি? না সবাই বিভক্ত। অফিসে, শিক্ষাঙ্গনে, বিনোদনঙ্গনে, মার্কেটে, কর্পোরালে, প্রেস কি স্যাটেলাইট, প্রিন্ট কি মিডিয়া, বাথরুম বা আরামখানায় বক্রনোয়নে নারী আর শিশুকেই আক্রমণ করে চর্তূদিক। সংবিধানে দেয়া আছে সমতা, নারী ও পুরুষের অধিকার সমান। কখনোই সমাজ ও পরিবারে কথাটি সত্য নয়। নাগরিক পাসপোর্ট, সন্তানের  অভিভাবকত্ব, সন্তান প্রতিপালনে অধিকার নেই নারীর। কৃষাণীরা কৃষিকাজে ৭৯ শতাংশ দায়িত্ব পালন করে থাকে। বীজ বোপন,বীজের যত্ন, মাটি নিড়ানি, ধান ভানা, সিদ্ধ করা, ঝাড়া, শুকানো কি না করে নারী? তবু কৃষাণীর বাজার অর্থনীতির সাথে সরাসরি যোগাযোগের কার্ড নাই, কৃষাণীর স্বীকৃতি নেই, ঋণ নেয়া, ব্যঙ্ক একাউন্ট, জমির মালিকানা তার নেই। এমনিভাবে সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার নারী।

সম্পদ সম্পত্তির এ বৈষম্য বিভাজনের কঠিন শিকার নারী ও কন্যাশিশু কেউ বাদ যায়নি। বৈষম্যের লাঞ্চনার লজ্জাজনক ভাষাকেও এ সমাজ সহজে গ্রহন করে নিয়েছে। রাস্তাঘাটে নারীকে সরাসরি অর্থাৎ মা-জননীকে নোংরা উচ্চারণে একে অপরকে গালাগাল করা হয়। রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে ব্যাপারি আর অফিসার থেকে উচ্চাসনের বসেরাও এসব জবান উচ্চারণ করে থাকেন। নিজ মাকে অন্যকে দিয়ে গালি শোনানো আবার নিজে অন্যের মাকে অপমানজনক গালাগাল করতে বিন্দুমাত্র কৃপণতা করে না। নিম্নবিত্ত হোক বা এলিটবিত্ত হোক এমন উচ্চরণে পরিবারের মেয়েরা শুনে শুনে জর্জরিত না হয়, তা নয়। প্রকাশ্যে অভিযোগ করার স্থান নেই। একজন অশিক্ষিত মাছওয়ালা স্ত্রীকে অবলীলায় যে নোংরা চরিত্রগত এ গালটি টপমোষ্টরাও উচ্চারণ করেন বটে।এগুলো শুধু নারী বলেই দেয়। নোংরামী জঘন্য  গালি দিতে মোটেও বাধে না। যেন বা গালিটি দিতে পেরে আত্মতৃপ্তি পায়। এ আচরণগুলো কখনো কোনোভাবেই নেতৃত্বের সমতায় বা প্রশিক্ষনের বারতায় এদের মাইন্ডসেট বদলানো সম্ভব নয়। সম্পদ সম্পত্তি বা অধিকারপ্রাপ্তির মতই জড়িত এ গালিগুলো বংশপরম্পর প্রাপ্ত পুরুষেরা।

তবু আন্দোলন আমাদের থামবে না। নারীর প্রতি সকলপ্রকার বৈষম্য ও নির্যাতনমূলক আচরণ দূর করার জন্যই এই প্রতিরোধ আন্দোলন। জেন্ডার সহিংসতা, নির্যাতন, দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব, কৃষ্টিসংস্কৃতি, নিবৃত্তমূলক আচরণ, শারীরিক মানসিক নির্যাতন, প্রতিহিংসা, প্রাপ্তির অধিকার বঞ্চিত, সকলপ্রকার প্রবঞ্চনা–সকল বিরুদ্ধ আচরণ শুধুই নারীর বিরুদ্ধে। এ আচরণ দূর করা সম্ভব নয় কেবল নির্যাতন থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা বৈ আর কিছুই না। আমরা নারী শিক্ষা অধিকার, উপবৃত্তির অধিকার, উচ্চশিক্ষা, সকল প্রকার চাকরিতে অংশগ্রহনের অধিকার, চাকরি পাওয়ার অধিকার, স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার,প্রজনন স্বাস্হ্যের সুব্যবস্হাসহ, ঘরে বাহিরে নিরাপত্তা, আইনগত অধিকারে নারী, কন্যাশিশু সুরক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুগ যুগ ধরে নারীবাদী আন্দোলন চলছে। আজো চলছে। নানান প্রশিক্ষনের মাধ্যমে নারী কন্যা শিশুকে অধিকার সচেতন করে তোলা হচ্ছে। নারী আন্দোলনের এই এক বিরাট সফলতা। মানবিক আচরণ, মানবাধিকার, মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে গেছেন রাজা রামমোহন রায়,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জনবান্ধব নেতারা। কে কতটুকু অগ্রসর হয়েছেন আজ অবশ্যই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

জাতিসংঘের আদেশ নির্দেশ সংযোজনে নারীর অগ্রসরমান জীবনাচরণে নানাবিধ দিকনির্শনার তরঙ্গে নারীরা এগিয়েছে অনেক বন্ধুর পথ। জাতিসংঘের সহযোগিতায় নারীর প্রতি সকলপ্রকার সহিংসতা নিরোধে সিডো সনদ প্রণিত ও অনেক দেশে গৃহীত হওয়ার ফলে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় এটি মাইলফলক হিসেবে নারীদের বৈষম্যহীন অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখবে। এই সনদে নারী জীবনের প্রতিটি স্তরে বৈষম্যকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ফলে নারীর চলার পথের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সরকার সচেষ্ট হবে। নারীকে ঘিরে সমতা প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা প্রয়োজন। যেমন রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদের সশস্ত্র আন্দোলনে সমতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন প্রীতলতা ওয়াদ্দেদার। তেমনি ব্রিটিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলজুলুমে সমতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন মনোরমা বসু মাসিমা। এমনি করে নেতৃত্বের গৌরবাণ্বিত ইতিহাস সমতার বিশ্বাসে হয়েছে শক্তিশালী। এভাবেই সমতার শব্দকোষে নারীর প্রবেশ অনেক পূর্বে ঘটলেও আজো সমতার আন্দোলন করে যেতে হচ্ছে, আর কত যুগ এ আন্দোলন চলতে থাকবে বলা মুস্কিল।

নেতৃত্ব যদিও তরতর করে বাড়ছে তবে তা নিরপেক্ষ নয়, সার্বজনীন হয়নি এখনো। পক্ষপাতিত্বমুক্ত নয়, দলগত, পক্ষগত, ইচ্ছেপক্ষ, পক্ষাপক্ষ নেতৃত্বের চলমান উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিপক্ষপাতদুষ্ট। ফলে নারী আন্দোলনের মূল আদর্শ লক্ষ,সমতার নিরপেক্ষতা আইন ও তার বাস্তবায়ন এখনও সুদূর পরাহত। কিছুপথ চলছে ব্যক্তির বা সহজাত দলগত ইমেজে। একবিংশ শতাব্দীর ক্যালেন্ডারে বিদ্রোহানলের দিন নির্দিষ্ট হলেও সার্বজনীন নেতৃত্বের ধ্বণিতে অসমতার মিছিলই দীর্ঘ, আমরা নিজেরাই চর্বিতচর্চনে ব্যস্ত এখনও। সাহসী হয় সুউচ্চে সোনালি ডানার চিল। একদিন বৈষম্যহীন মানবতায় সন্ধিস্বাক্ষর হবে আবার, হ্যামিলনের বাঁশি বাজবে, সমতা ফিরবে, একতায় উড়বে নিরপেক্ষ নেতৃত্বের বিজয় কেতন-হয়তো কখনও।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/