মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের আরও মূল্যায়ন প্রয়োজন: ডা. লতিফা সামসুদ্দিন

ডা. লতিফা সামসুদ্দিন একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। চিকিৎসক হিসাবে সফল হলেও দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান কম নয়। তিনি  মুক্তিযুদ্ধে একজন নারী সংগঠক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আজ ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা ও নারী চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি মুক্তিযুদ্ধসহ নিজের পেশাজীবনের নানা ঘটনা তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক হুমায়ূন মুজিব।

আপনার শৈশব, কৈশোর ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই?

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ আমি পুবাইলে জন্মগ্রহণ করলেও বেড়ে ওঠা ও কৈশোরে লেখাপড়া সবকিছু পুরান ঢাকার বংশালে।। বাবার নাম মাওলানা কবিরউদ্দিন রহমানি। বাবা লেখাপড়া করেছেন দিল্লির একটি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে। তিনি বংশাল বড় মসজিদের ইমাম ছিলেন। আমরা ১১ ভাই বোন। আমিই একমাত্র ডাক্তার, বাকিরা অন্যান্য পেশায়। ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী। আমাদের পরিবারে ও বংশে মিলিয়ে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। আমাদের জীবনটা আসলে বৈচিত্রময়। যেমন আমাদের জন্ম হয়েছে গ্রামে, বড় হয়েছি ঢাকা শহরে। আমি মাওলানার মেয়ে। তখন এভাবে মেয়েদের চলাচল ও শিক্ষার সুযোগ কমই ছিলো। আমি বংশাল স্কুল থেকে পাশ করে ইডেন কলেজে ভর্তি হলাম। তারপর পাস করে ১৯৬২ সালে ভর্তি হলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। তারপর ১৯৬৮ সারে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে বের হই। পাস করার পর একেএম সামসুদ্দিনের সাথে আমার বিবাহ হয়। ১৯৭০ সালে বগুড়া সরকারি মোহাম্মাদ আলী মেডিক্যাল কলেজে চাকুরিতে যোগদান করি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ও যুদ্ধপরবর্তী সময়ে আপনার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ আমার চাকরি জীবন শুরু হয় বগুড়া মোহাম্মাদ আলী মেডিক্যাল কলেজে। ১৭ বছর ওখানে চাকরি করি। বগুড়াতে সার্জারি বিভাগে আমার সিনিয়র ছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক পূর্ণেন্দ্য বিকাশ রায় (পিবি রায়) স্যার। বগুড়াতে মেডিক্যাল অফিসার কনসালটেন্ট। এরপর রাজশাহী মেজিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক, তারপর আমি চলে আসলাম স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। তারপর সিলেট মেডিকেল কলেজে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সবশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্¦বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সরাসরি ভূমিকা রাখলেও কখনো তালিকাভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বগুড়া সরকারি মোহাম্মাদ আলী মেডিকেল কলেজে মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে চিকিৎসা নিতেন। আমি আর সার্জন বিভাগের প্রধান পিবি রায় স্যার চিকিৎসা দিতাম। বগুড়া কিছুটা মুক্তাঞ্চলের মতই ছিলো। আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ও পরে বগুড়া মহিলা পরিষদের সেক্রেটারি ছিলাম। সংগঠনটি মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রীদের নিয়ে শুরু হয়ে ছিল। আমি সারাদিন তাদের নিয়ে কাজ করতাম। যুদ্ধশেষে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ফিরে এসেছেন, আবার অনেকে ফিরে আসেনি। কেউ যুদ্ধে মারা গেছেন, নির্যাতীত মেয়েরা যারা অনেকে পাক হানাদার বাহিনী দ্বারা গর্ভবর্তী হয়েছেন। ধর্ষিতা হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করেছেন। বগুড়ায় এইসব চিত্র খুব খারাপ ছিল। এ ঘটনা মনে পড়লে এখনও কান্না পায়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বগুড়ার কালিতলাতে একটি বিল্ডিং ভাড়া করে আমরা নির্যাতিত মেয়েদের সেখানে রাখতাম। আমি একমাত্র মহিলা মেডিকেল অফিসার। যারা গর্ভবর্তী তাদেরকে প্রসব করানো ও এই যুদ্ধ শিশুদেরকে বিভিন্ন চ্যারেটি অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে দেশের বাইরে পাঠানো ছিলো আমাদের কাজ। তখন আমার দায়িত্বে ৬০ জন নারী ছিল। তারা এখন কে কোথায় আছে আমি জানি না। তখন আমি তাদের জন্য একটি পূর্নবাসন কেন্দ্র স্থাপন করেছিলাম। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু সরকার কেন্দ্রটির জন্য জমি প্রদান করেন। এখনকার বগুড়া মহিলা পরিষদ সেখানেই অবস্থিত। সেই কেন্দ্রের স্মৃতি এখনও ভুলতে পারি না। সেখানে বীরঙ্গনাদের তাদের বাবা ভাইয়েরা রেখে যেত। কোনও দিন আর নিতে আসতো না, ওরা শুধু কাঁদতো আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতো, অনেক মেয়ে অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যাও করেছে। তাদের স্মৃতি আমাকে কাঁদায়।

মুক্তিযুদ্ধে নারীদের স্বীকৃতি নিয়ে কিছু বলবেন কী?

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ স্বীকৃতির কথা কখনো ভাবিনি। তবে আমি মনে করি সরকারের আরও তৎপর হওয়া দরকার। নারীদের স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। মাত্র দুইজন নারীকে বীর প্রতীক দেওয়া হয়েছে। ক্যাপ্টেন সেতারা ও তারামন বিবি। অথচ মুক্তিযুদ্ধে ৪ লাখ ৬০ হাজার নারী নির্যাতিত হয়েছে। বিধাব হয়েছে অগণিত। শেরপুরের সোহাগপুর বিধবা পল্লী তার জলন্ত প্রমাণ। বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জন, বীরউত্তম ৬৮ জন, বীরবিক্রম ১৭৫ জন, বীর প্রতীক ২জন বীরঙ্গনা ৪৩৮ জন। বেসামরিক যোদ্ধাদের স্বীকৃতি তেমন নেই বললেই চলে। সরকারের এ বিষয়ে গবেষণা করে পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত।

যুদ্ধের কোনো স্মৃতি কি আপনাকে তাড়িত করে?

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ ১৯৭১ সালের এপ্রিল, মে জুন জুলাইয়ের যে কোন এক সময়ে বগুড়া কালিতলা সুন্দর মন্দিরে পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালায় এবং সেখানে প্রার্থণারত সুন্দরী মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যায়, পরবর্তীতে তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। সেটি ছিল এক নারকীয় আক্রমণ। এই স্মৃতি এখনও আমাকে কাঁদায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যখন জয় বাংলা রণধ্বনি দিত তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম। আর মনে পড়ে খিস্ট্রান মিশনারি হাসপাতালের মকবুল ভাইকে, যিনি কেন্দ্রের মেয়েদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পুর্নবাসন করেছেন। আর মনে পড়ে আমার কর্মস্থলের সহযোগী সিস্টার শাহীনার কথা।

এদেশের নারীদের এক্লাম্পশিয়া এবং প্রি-এক্লাম্পশিয়া রোগ প্রতিরোধে আপনার বিশেষ ভূমিকার কথা শুনেছি। সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ আমার চিকিৎসা জীবনের বেশিরভাগ সময়ে দেখেছি, গর্ভবতীরা অধিকাংশ মারা যেত এক্লাম্পশিয়াতে আর পোস্ট পার্টাম বিল্ডিংয়ে, যেটা প্রসবের পরে হয়। এটার চিকিৎসা তখন বাংলাদেশে ছিল না। ১৯৯৪ এ যখন আমি ঢাকা মেডিকেলে আসি তখন আমার দেখা হয় ‘ফাদার ইমপ্রুভমেন্ট অব মেডিকেল কলেজ’ নামক ইউকের একটা গ্রুপের সাথে। তারা আমাকে জানালো যে পৃথিবীর ১৭টি জায়গায় এক্লাম্পশিয়ার ওপর কাজ হচ্ছে।
এরমধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও আছে। আমি উৎসাহিত হলাম, ভারতে যদি হয় তাহলে বাংলাদেশে কেন হবে না। তখন আমি কাজ শুরু করলাম। দেখলাম যে, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট নামে একটা ড্রাগ আছে। এতে রোগী অনেকটা সেরে যায়। এই ড্রাগটা আনার জন্য আমি অনেক চেষ্টা করি কিন্তু ফান্ডিং সহজে পাওয়া যায় না।
ম্যাকপাই ট্রায়াল নামে একটা ট্রায়াল হয়েছিল সারা বিশ্বের ১৭২ টি দেশ নিয়ে। সেখানে আমরা এনরোল্ড হলাম। বহু কষ্টে ড্রাগটা যোগাড় করে ট্রায়াল বেসিসে ঢাকা মেডিকেলের অনেক রোগীকে দিলাম। তারা ভালো হয়ে গেল। এটা আমাকে এতটা আনন্দ দিয়েছিল যা বলে বুঝানো যাবে না। তখন আমরা বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগটা দেশে আনতে চেষ্টা করলাম।
তারপর বাংলাদেশে ড্রাগটা আনা হলো। এখন বাংলাদেশে এই ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচার হচ্ছে। নাউ উই ক্যান ম্যানেজ দ্যা এক্লাম্পসিয়া। একটা বিষয় অবশ্যই উল্লেখযোগ্য তখন আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ারম্যান। শ্রীলংকায় একটা ইন্টারন্যাশন্যাল সেমিনারে গিয়ে দেখি এই ডিসিপ্লিনের এশিয়ান কান্ট্রি পারসন সবাই উপস্থিত। সেখানে মিসোপ্রোস্টল ড্রাগ সম্পর্কে জানতে পারলাম। যেটা দিলে গর্ভ পরবর্তী রক্তপাত বন্ধ হয়। কিন্তু অনুমোদন না থাকায় ড্রাগটা আমরা দেশে আনতে পারছিলাম না। অবশেষে মিসোপ্রোস্টল ব্যবহারের অনুমোদন নিলাম। একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের কাছে মিসোপ্রোস্টল পাঠালো। আজ সেই মিসোপ্রোস্টলও আমাদের দেশে ম্যানুফ্যাকচার হচ্ছে। এক সময় বাংলাদেশে প্রতি আধ ঘন্টায় একজন করে মা গর্ভকালীন এবং গর্ভপরবর্তী জটিলতায় মারা যেতেন। আজ সে সংখ্যা অনেক অনেক কম। এজন্য ডাক্তার, ওজিএসবি, বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্যরা কাজ করেছি একসাথে। এটা আমাদের সবার সাফল্য।

সারভাইকাল (জরায়ু মুখ) ক্যান্সার চিকিৎসায় আপনি অনেক কাজ করছেন। সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ আমি যখন স্টুডেন্ট বা মাত্র পাশ করেছি। ফিরোজা ম্যাডাম ছিলেন গাইনির প্রফেসর। উনি গাইনি ক্যানসার রুমে ঢুকতেন না। রুমটাতে উৎকট গন্ধ থাকতো। ক্যানসারের জায়গা থেকে দুর্গন্ধটা আসতো। ম্যাডাম আমাকে বলতেন, লতিফা তুমি রোগীগুলো দেখেছ? আমি বলতাম, জ্বি ম্যাডাম দেখেছি। তারপর উনি অন্য রোগীর পাশে চলে যেতেন। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ম্যাডাম আপনি রোগীগুলো দেখেন না কেন? জবাবে ম্যাডাম বললেন, সারভাইকাল ক্যানসারের রোগীগুলো দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে। আমি তো রোগীগুলোকে সুস্থ করতে পারব না।  
জরায়ু মুখের ক্যান্সার বাংলাদেশের নারী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। এই রোগ শরীরে বাসা বাঁধার পর ১০ বছর সময় লাগে ফুল ডেভেলপড হতে। এই সময়ের মধ্যে যদি রোগটি ধরা যায় তাহলে তা নিরাময় করা সম্ভব। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে রোগটা সনাক্ত করব কিভাবে। তখন আমরা জানতে পারলাম, ভায়া নামে একটা সাধারণ পরীক্ষা আছে। জরায়ুর মুখে ৫% সিলকা যদি লাগিয়ে দিতে পারেন যে জায়গাটা রোগাক্রান্ত সেটা সাদা হয়ে যায় আর যে জায়গাটা ভালো ওটার রঙ স্বাভাবিক থাকে। আমি দেখলাম এর চেয়ে কম খরচের পরীক্ষা আর নেই। আমি সরকারের কাছে চাইলাম এবং সরকার আমাকে দিলো। তখন আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল হাসপাতালে এই ভায়া করতে শুরু করলাম। আমরা ১০ লক্ষের বেশি মহিলাকে ভায়া টেস্ট করি। এরপর আস্তে আস্তে কলপোস্কপি, বায়োপসি ইত্যাদি আমরা করছিলাম। এ রোগের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির জন্য, ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে যেতে হয়েছে। আমার সাথে প্যাথলজি, রেডিওথেরাপি-অনকোলজির প্রফেসররাও ছিলেন। এই তো কয়েকদিন আগেও রাজশাহীতে গেলাম। এলাকায় এলাকায় মানববন্ধন করলাম। শ্লোগান দিলাম। মানুষজনকে লিফলেট দিলাম।

বাংলাদেশে নতুন করে স্বাস্থ্য আইন হয়েছে । নিশ্চয় শুনেছেন, এ নিয়ে চিকিৎসকদের মাঝে বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। আইনটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছিলাম।

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ আমি এটা নিয়ে খুব একটা বলতে পারব না। কারণ, আইনটি রিসেন্টলি হয়েছে। আইন করে কিছু হয় না। ওটা মানুষের মন থেকে আসতে হয়। আমি মনে করি, সরকার হয়ত বুঝে শুনেই করেছে। কিন্তু আমি এর মধ্যে সম্পৃক্ত না। খুব একটা বলতে পারব না আপনাকে।

আপনি জেনে অবাক হবেন যে, চিকিৎসায় অবহেলা এবং ভুল চিকিৎসায় ফৌজাদারি আইনে জেল জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে আইনটিতে। আপনার কি মনে হয় না- এর ফলে চিকিৎসকরা স্বাভাবিকভাবে চিকিৎসা দিতে পারবেন না? এ প্রেক্ষিতে যদি কিছু বলতেন।

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিন: আমার মনে হয়, সরকারের উচিত আইনটা পুরোপুরি বাদ দেয়া। কারণ আপনি যদি আমাকে সম্মান না করেন আমি কিন্তু আপনাকে সম্মান করব না। এটিই নিয়ম। আমরা আমাদের পেশাকে আমাদের কাজকে সম্মান করি। তাই কখন সূর্য ওঠে, কখন চাঁদ ওঠে তার খবর আমরা রাখি না। আমরা সেবা দিব, এটাই আমাদের মানসিকতা। তার বিনিময়ে আমরা হয়ত কয়েকটি পয়সা নিই আপনাদের কাছ থেকে। কিন্তু এ সার্ভিস যদি আমরা না দেই তাহলে কী হবে এখানে? এই কথাটা মনে করলেই বিভীষিকাময় একটা চিত্র, অন্ধকার একটা পৃথিবী দেখবেন। আমি মনে করি, এটা মারাত্মক ভুল। আমাদের একটা রোগীর অবস্থা যখন খারাপ হতে থাকে তখন আমরা প্রত্যেকেই মনে মনে বলি, আল্লাহ তুমি রোগীটার প্রাণ ফিরে দাও। যখন রোগী মারা যায়, তখন রোগীর স্বজনদের মতো আমাদের মনও খারাপ হয়। আমরা হয়ত আমাদের আবেগটা প্রকাশ করি না। এর পরেও যদি সরকার মনে করে যে, আমরা ইচ্ছে করে ভুল করি বা ইচ্ছে করে চিকিৎসায় অবহেলা করি তাহলে তো হয় না। ইট ইজ সিম্পলি ইমপসিবল। আমার মতে, সরকারের উচিত এ আইনটি এখনই চেঞ্জ করা। এখনই।

 আপনার চিকিৎসা জীবনের স্মরনীয় কোন ঘটনা যা আপনাকে খুবই আনন্দ দেয়।

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ আমি যেখানেই যাই না কেন, সেখানেই আমি আমার শিক্ষার্থীদের পাই। এটা আমাকে ভীষণভাবে আনন্দ দেয়। যেমন আমি কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলাম। রাত দেড়টার সময় দুইজন গাইনোকলজিস্ট তাদের ফ্যামিলি মেম্বার নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে আসলো। বললো ম্যাডাম,  আমরা আপনার ছাত্র। ওরা আমার সাথে তাদের ফ্যামিলি মেম্বারদের পরিচয় করিয়ে দিল। এরকম প্রায়ই হয়। এটা খুবই ভালো লাগে। আমি এবং আমার স্বামী একবার হজ্ব করতে গেলাম। সেখানেও আমার এক ছাত্রের সাথে দেখা হয়ে গেল। সে সৌদি আরবে গাইনোকলজি প্র্যাকটিস করছে। আমাদেরকে সে হোটেলে থাকতে দিবে না। জোর করেই তার বাসায় নিয়ে গেল। হজের পুরোটা সময় আমরা ওর বাসায় থেকেছি। এই আনন্দটা আর কোন আনন্দের সাথে মিলে না। আমি একবার বই মেলায় গিয়েছিলাম আমার দুই নাতনি এবং ছেলের বউসহ। হঠাৎ একজন লোক এসে সালাম দিয়ে বলল, ম্যাডাম আপনি একটু দাঁড়ান এখানে। কিছুক্ষণ পর সেই ভদ্রলোক কয়েকজন ইয়াং ছেলে মেয়েকে আমার সামনে নিয়ে আসলো। বললো, ম্যাডাম, এদের সবার ডেলিভারি আপনার হাতে হয়েছে। ওরা সবাই আমার সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুললো। এটা যে কী আনন্দ দেয় বলে বুঝাতে পারব না!

চিকিৎসক জীবনের কোন ঘটনা বা স্মৃতি যা আপনাকে কষ্ট দেয়?

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ ডাক্তারদের জীবনে প্রতিদিনই কোন না কোন কষ্টদায়ক স্মৃতি থাকে। কারণ আমাদেরকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়। কখনো আমরা জিতি কখনো হারি। কিছুদিন আগেও গাইনি ডিপার্টমেন্ট ছিল হাসপাতালের সবচেয়ে অবহেলিত ডিপার্টমেন্ট। মায়েরা হাসপাতালে ডেলিভারির জন্য আসতে চাইত না। যখন আসতো, তখন আমাদের কিছু করার থাকতো না। আগে বাল্যবিয়ের প্রচলন ছিল। অল্প বয়সে মেয়েদের বাচ্চা হয়ে যেত। আমার লেবার রুমে কমপক্ষে ৩-৪জন রোগী থাকত, যাদের বয়স ১৫-১৬ বছর। আবার বয়স্ক মহিলাদের ক্যানসার হতো কিন্তু ক্যানসারের চিকিৎসা তখন ছিল না। এই চিত্রগুলো আমাকে খুব ব্যথিত করতো।

তরুণ শিক্ষার্থী যারা গাইনিতে ক্যারিয়ার করতে চায়, তাদের প্রতি আপনার কোনও পরামর্শ?

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিন: গাইনি একটা কঠিন সাবজেক্ট। যে এখানে আসবে, তাকে ডিভোটেড হয়েই আসতে হবে। এখানে আসলে দিন-রাতের হিসাব ভুলে যেতে হবে। কারণ, কার ডেলিভারি পেইন কখন হবে তা কেউ জানে না। সকল অবস্থায় কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। আমি মনে করি, যারা আসবে তারা বুঝেই আসবে।

কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ আপনি যেসব অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন সেগুলো নিয়ে যদি বলতেন?

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিন: অ্যাওয়ার্ড তো অনেক পেয়েছি। দেশ থেকে পেয়েছি। আন্তর্জাতিক ভাবেও পেয়েছি। কয়েকদিন আগে আমাকে ফিগো অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত পাওয়া অ্যাওয়ার্ডের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ। গাইনোকলজিস্টদের জন্য এটা হাইয়েস্ট প্রেস্টিজিয়াস অ্যাওয়ার্ড এবং মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা পেয়েছি।

বর্তমানে কি কি নিয়ে ব্যস্ততা আপনার?

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিন: আমি অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলাম। এখনও এর সাথেই আছি। আমাদের যতগুলো কমিটি আছে, সব কমিটিই আমি মোটামুটি দেখি। বিশেষভাবে এক্লাম্পশিয়া ম্যানেজমেন্ট কমিটি এবং ক্যান্সার কমিটি এই দুটোতে আমি আছি। গাইনোকলজিতে সাব-স্পেশালিটি তৈরির দায়িত্বেও আছি। যেমন ইনফার্টিলিটি, গাইনোকলজিক্যাল অনকোলজি এই সাব স্পেশালিটিগুলো এখন চালু হয়েছে। আমি ইঈচঝ এর কাউন্সিলর ছিলাম। এখন ইগঅ  তে আছি। ঋওএঙ, ঝঅঠঊ ঞঐঊ ঈঐওখউজঊঘ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে কাজ করছি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে যাই। সায়েন্টেফিক জার্নালে লেখালেখি করি। গাইনোকলোজির উপরে কিছু টেক্সট বই লিখেছি। তবে এখন লেখালেখিতে আগের মতো সময় দিতে পারি না।

আপনাদের সময় যে মাতৃমৃত্যু হার ছিল তা এখন অনেক কমে এসেছে। এ বিষয়টা আপনাকে কেমন আনন্দ দেয়?

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ এটা খুবই আনন্দ দেয়। মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোলের একটি গোল ছিল এই মাতৃমৃত্যুর হার কমানো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এজন্য আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন। দেশের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। অবসটেট্রিশিয়ানদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই তা সম্ভব হয়েছে।

আমাকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিনঃ ধন্যবাদ আপনাকেও।


ডা. লতিফা সামসুদ্দিন পূর্ব্ইালের বড় কয়ের গ্রামের ভূঁইয়া বাড়িতে ১৯৪৫ সালের ১২ মার্চ জন্মগ্রহন করেন। বাবার নাম মাওলানা কবির উদ্দীন।  নারীদের চিকিৎসা সেবায় একজন অগ্রপথিক, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেয়া ও যুদ্ধ পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারী, যুদ্ধ শিশু, বীরঙ্গনাদের সামাজিক পূর্নবাসনে বগুড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। ডা. লতিফা সামসুদ্দিন বাংলাদেশের অবসটেট্রিক্স অ্যান্ড গাইনোকলজির একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। এক্লাম্পশিয়া, প্রিএক্লামপশিয়া চিকিৎসায়ে তিনি অনন্যা। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত ম্যাগনেশিয়াম সালফেট, মিসোপ্রোটিল তিনিই প্রথম বাংলাদেশে পরিচিত করান। জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয় ও নিররাময়েও তিনি পরবর্তী প্রজন্মের আইকন। ভায়া টেস্ট, কল্পোস্কপি তার হাত ধরেই বাংলাদেশে শুরু। ছিলেন অবস্টেট্রিক্স অ্যান্ড গ্ইানোকলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহনের পর তিনি দীর্ঘদিন এনাম মেডিকেল কলেজের গাইনি ও অবস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি মিরপুরে নিজ বাড়িতে বর্নালী নাসিং হোম নামক সেবাদান কেন্দ্রে অগণিত প্রসূতি মায়েদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। গবেষণা, স্বাস্থ্য শিক্ষার উন্নয়ন থেকে শুরু করে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে এখনো নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন এই চিকিৎসক।

ওমেন্স নিউজ/