স্বাধীনতার গল্প ‘ও আমার দেশের মাটি’

আঞ্জুম রুহী

প্রতিদিনের মতো সোহাগ মিয়া তার রিক্সা নিয়ে রাজপথে বেরিয়েছে। রিক্সার পেসেঞ্জার, তার ৭-৮ বছরে ছেলেকে নিয়ে স্কুলের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। রিক্সার তিন চাকা ঘুরছে, রিক্সার হাতলে লাগানো ছোট্ট  বাংলাদেশের পতাকাটা পতপত করে উড়ছে। আজ স্বাধীনতা দিবস, চারদিকে একটা উৎসব মুখর আমেজ। মানুষ লাল সবুজ কাপড় পরে হাতে ফুল নিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছে। স্কুলে স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান চলছে।

সোহাগ মিয়ার বয়স এখন প্রায় ৫০ কি ৫৫ হবে। একাত্তরের যুদ্ধের সময় তিনি ৮ কি ১০ বছরের ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কথা তার আজো মনে আছে। সোহাগ মিয়ার বাবা কবির মিয়া ঢাকা শহরে একটা কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। সোহাগ মিয়া তখন ক্লাশ টু'তে পড়ে। প্রতিদিন রাতের খাবারের পর বাবার সাথে রেডিওতে খবর শুনে, চারদিকে পরিস্থিতি গরম। আজ বাবার সাথে রেডিও খবরে শুনেছে, পাকিস্তান জেনারেল টিক্কা খান বলেছেন, ২৩ তারিখ তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন। আসলে এটা ছিলো একটা মিথ্যা প্রচারনা মাত্র। বাঙ্গালীদের ধোঁকা দেয়া হয়েছিলো।

২৩ তারিখ  চলে যাওয়ার কথা বলে তিনি ঢাকাতেই অবস্থান করেন এবং 'অপারেশন সার্চলাইটের' প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আসলে ২৫শে মার্চ রাতে টিক্কা খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেই রাতেই বাঙ্গালিদের উপর চালানো হয় এক নির্মম হত্যাকান্ড। যা ছিলো 'অপারেশন সার্চলাইট'। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ৩১ জন সহকর্মী সহ মিথ্যা 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার' দায়ে গ্রেফতার করা হয়। সেদিন রাতে ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষনা করেন, ‘হয়ত এটাই আমার শেষ বার্তা, কিন্তু আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন..।’

২৫শে মার্চের সেই নির্মম কালো রাতের কথা সোহাগ মিয়ার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। খাওয়ার পর বাবার সাথে শুয়েছিলো, পাশের রুমে মা কাঁদছেন। বাবাকে জিজ্ঞাস করলে বাবা বললেন, তোমার মায়ের শরীরটা একটু খারাপ। তখন দাদি এসে বাবাকে বললেন, বাবারে, দাই সব রকম চেষ্টা করেছে কিন্তু বাসায় সম্ভব হচ্ছে না, সোহাগের মাকে হাসপাতালে নিতে হবে। বাবা শার্ট গায়ে দিচ্ছেন, মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।
হঠাৎ চারিদিকে গুলির শব্দ, চিৎকার।
-দারওয়াজা খোল, দারওয়াজা খোল। দরজায় মিলিটারির লাথির শব্দ।
বাবা দরজা খুলতে গেলে, দাদি নিষেধ করেন। -খুলিস না বাবা, খুলিসনা।
মিলিটারিরা দরজায় লাথি দিয়েই যাচ্ছে। একপর্যায়ে বাবা দরজা খুলে দিলেন। তারা ঘরে ঢুকেই বাবাকে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে  ফেললো, দাদি এসে চিৎকার করে বলছেন-বাবারা দোহাই তোমাদের, আমার ছেলেকে ছাইড়া দাও। আমার ছেলে তো কিছু করেনি, সে তো নির্দোষ।
তখন একজন মিলিটারি বললো, বুড়িয়াকো বাহার ফেকো।
সাথে সাথেই একজন এসে দাদিকে এমন ধাক্কা দিলেন, দাদি পড়ে গিয়ে তার মাথা ফেটে রক্তে ঘরের মেঝে ভেসে যাচ্ছে। তারা মায়ের রুমের দিকে যাচ্ছে আর বলছে, তেরা বিবি-বেটি কাহা হে?
বাবা বলছেন, আমার কোনো বেটি নাই, আমার বিবি অসুস্থ, তার ব্যাথা উঠেছে। আমাকে যেতে দিন, আমার যে ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।
বাবার কথা তাদের বিশ্বাস হলো না, মায়ের রুমে ঢুকে মাকে দেখে তাদের মাথায় যেনো রক্ত উঠে গেলো। মায়ের চিৎকারে সোহাগের কলিজা শুকিয়ে গেলো, তারা নির্মমভাবে বেয়োনেট দিয়ে মায়ের পেট ফেঁড়ে দিয়েছে!
এক মিলিটারি এসে বাবাকে বললো, তেরি বিবিকো হাসপাতাল নাহি লেনা পারেগা, হাম তেরি খুবসুরাত বিবিকা ডেলিভারি কারা দিয়েহে।
আরেকজন মিলিটারি বললো, চালো, আব ইস ঘরমে হামলোগ কা কাম কা কুছ নাহি রাহা।
তারা চলে যাচ্ছিলো হঠাৎ একজন ঘুরে বাবাকে ব্রাশফায়ার করলো। একের পর এক ঘটনা সোহাগের চোখের সামনে ঘটে গেলো, সে যেন খাটের নিচে পাথর হয়েই লুকিয়ে রইলো। তার আর কিছু মনে নেই, কখন যেনো কে এসে তাকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করলো।

সোহাগ মিয়া তার দূর সম্পর্কের এক চাচার কাছে বড় হয়েছে। আব্বা-আম্মা বেঁচে থাকলে তার জীবনটা হয়তো আজ অন্য রকম হতো, পড়াশুনা করে হয়ত ভালো কিছু করতে পারতো। রিক্সা চালালেও সোহাগ মিয়ার দেশের জন্য গভীর মায়া। এই দেশ স্বাধীন করতে তার মা-বাবা, দাদি ও তার মায়ের গর্ভের অনাগত সন্তানও জীবন দিয়েছে। কয়জন মনে রেখেছে তাদের এই বলিদান!

সেইদিন সোহাগ মিয়ার ছোট্ট মনে প্রশ্ন জেগেছিলো, সেদিন তারা তার অসুস্থ মাকে কেনো মারলো? আজ বুঝতে পারছে, সেদিন তার অন্তসত্ত্বা মা তাদের যৌনক্ষুধা মিটানোর অবস্থায় ছিলো না। সেই জন্য তার সুন্দরী মাকে দেখে জানোয়ারদের মাথায় রক্ত উঠেছিলো, মায়ের অনাগত বাচ্চাটাকেও দুনিয়াতে আসতে দিলো না। সোহাগ মিয়া তার মা-বাবাকে যেমন ভালবাসতো, তেমনি ভালবাসে এই স্বাধীন বাংলাদেশকে। এই দেশের মাটিতে মিশে আছে তার মা-বাবা আর দাদির রক্ত।

‘এই রিক্সা থামাও’পেসেঞ্জারের ডাকে সোহাগ মিয়ার সম্বিৎ ফিরে এলো।  রিক্সার তিন চাকা স্কুলের গেটের সামনে থেমে গেলো। স্কুলের অনুষ্ঠান থেকে ভেসে আসছে,
‘ও আমার দেশের মাটি,
তোমার পরে ঠেকাই মাথা,
তোমাতে বিশ্বময়ী,
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।
ও আমার দেশের মাটি…।’

ওমেন্স ডেস্ক/