দিল্লি যেন মৃত্যুনগরী, পার্ক-খোলা মাঠ-পার্কিং লট সর্বত্র শ্মশান

ভারতে ১৮৫৭ সালে অনুষ্ঠিত সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে মহামারি কবলিত দিল্লিকে ‘মৃত্যুর শহর’ আখ্যা দিয়েছিলেন উর্দু কবি মির্জা গালিব। এক রোজনামচায় সে সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন-কবরস্থানে গোর খোঁড়ার লোক নেই। চিতা জ্বালানোরও লোক নেই। পাল্কি চলছে না শহরে। রাস্তায় লাশের পাহাড়। এ যেন এক মৃত্যু-নগরী। আড়াইশ বছরেরও বেশি সময় পর কোভিডে আক্রান্ত দিল্লিতে যেন সেই ছবিটি ফিরে এসেছে।

কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ। ফলে  এখন এক আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে দিল্লি। সোমবারও সেখানে সরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩৮০। শহরের হাসপাতালগুলোতে জায়গা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইসিইউ বেড সব ভর্তি। চরম সংকট চলছে অক্সিজেন এবং প্রাণরক্ষাকারী ওষুধের।

এর মধ্যে দেশজুড়ে ধাই ধাই করে বাড়ছে সংক্রমণ এবং মৃত্যু। গত মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) ভারতে নতুন কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার ৪৩৫। তার আগের দিনে অর্থাৎ সোমবার নতুন সংক্রামিত হয়েছিলেন ৩ লাখ ২৩ হাজার ১৪৪। এর আগের দিনও আক্রান্ত হয়েছিলেন সাড়ে ৩ লাখের বেশি মানুষ। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, প্রকৃত সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি।

মৃত্যু ধামাচাপা

অভিযোগ উঠেছে যে দেশটির সরকার কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করছে। ভারত এবং ভারতের বাইরে নির্ভরযোগ্য বহু পত্র-পত্রিকায় মৃতের সংখ্যা ধামাচাপা দেওয়ার কথা প্রমাণসহ প্রকাশ করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ভোপাল শহরে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ১৩ দিনে কোভিডে মৃত্যুর সরকারি সংখ্যা মাত্র ৪১ হলেও তাদের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে ঐ একই সময়ে ভোপালে এক হাজারেরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে।

মৃত্যুপুরী দিল্লি, ঠাঁই নেই শ্মশানে, লোকালয়েই পুড়ছে শব

শহরের একজন চিকিৎসক ডা. জিসি গৌতমকে উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ‘অনেক মৃত্যু সরকারি রেকর্ডে তোলা হচ্ছেনা। সরকার চাইছেনা জনমনে ভীতি তৈরি হোক।’ গুজরাটের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক সন্দেস তাদের সংবাদদাতাদের রাজ্যের বিভিন্ন শ্মশান এবং গোরস্থানে পাঠিয়ে দেখেছে সরকার মৃত্যুর যে সংখ্যা দিচ্ছে প্রকৃত মৃত্যু তার কয়েকগুণ বেশি। পত্রিকাটি লিখছে গুজরাটে প্রতিদিন গড়ে ৬১০ জন মারা যাচ্ছে। একই অভিযোগ আসছে উত্তর প্রদেশ এবং দিল্লির বেলাতেও।

এক অনুসন্ধানে ভারতের টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এনডিটিভি দেখতে পেয়েছে, এক গত সপ্তাহে দিল্লিতে সরকারের দেয়া হিসাবের চেয়ে ১১৫০ জন বেশি রোগী মারা গেছে। পুরো দেশ জুড়ে এমন অনেক অনুসন্ধানে মৃত্যু গোপন করার একই ধরণের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

জ্বলছে সারি সারি চিতা

অনেক শহরে শ্মশানগুলো শব দাহ করার নজিরবিহীন চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শ্মশান কর্মীদের দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে। ফলে দাহ করার জন্য কাঠের জোগাড়, সেগুলো সাজানোর ভার মৃতের স্বজনদের ঘাড়ে এসে পড়ছে। অসুস্থ স্বজনকে নিয়ে হাসপাতালের দরজায় দরজায়  ঘুরছেন বিপন্ন মানুষ।

রাজধানী দিল্লির অবস্থা এতটাই সঙ্গিন যে খোলা মাঠ, পার্ক এমনকি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাতেও অস্থায়ী শ্মশান তৈরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কারণ যেসব সরকারি শশ্মান দিল্লিতে রয়েছে তারা আর চাপ নিতে পারছে না। মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে দাহ করার জন্য তীব্র গরম আর চিতার আগুণের হলকার মধ্যে পিপিইতে মোড়া স্বজনদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

আহা অক্সিজেন! স্বামীকে বাঁচানোর কী আপ্রাণ চেষ্টা স্ত্রীর

দিল্লির সারাই কালে খান শ্মশানের ভেতর খালি জায়গায় গত কদিনে নতুন ২৭টি দাহ করার বেদি তৈরি করা হয়েছে। শ্মশানটির লাগোয়া পার্কে আরো ৮০টি বেদি তৈরি হয়েছে। যমুনা নদীর তীর ঘেঁষা এলাকাগুলোতে অস্থায়ী শ্মশান তৈরির জন্য জায়গা খুঁজছে দিল্লি পৌর কর্তৃপক্ষ। সরাই কালে খান শ্মশানের একজন কর্মী ইংরেজি দৈনিক দি হিন্দুকে বলেছেন, শবদেহের চাপে তাদের ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সমানে কাজ করতে হচ্ছে। পূর্ব দিল্লির গাজিপুর শ্মশানের পার্কিং লটে গত ক'দিনে বাড়তি ২০টি বেদি তৈরি করা হয়েছে।

ঐ শ্মশানের একজন ব্যবস্থাপক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে বলেছেন, শবদেহের চাপ এত বেড়ে গেছে যে নতুন বেদি তৈরি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিলনা। তারপরও শবদেহ নিয়ে আসার পর স্বজনদের তিন থেকে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

নগরীর প্রায় সব শ্মশানের চিত্র কম-বেশি একই। কোভিডের চিকিৎসা এবং মৃতদের দাহ করতে সাহায্য করছে এমন একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা সুনীল কুমার আলেদিয়া বিবিসিকে বলেন, অনেক শ্মশানে অতিরিক্ত বেদি তৈরির কোনো জায়গা নেই।

শ্মশানে বিবিসির সংবাদদাতা

দিল্লিতে বিবিসি হিন্দি ভাষা বিভাগের সংবাদদাতা জুবায়ের আহমেদ সোমবার দিল্লির তিনটি শশ্মান ঘুরে এসে বলছেন, জীবনে একসাথে এত চিতা জ্বলতে তিনি কখনো দেখেননি। ‘শ্মশানগুলোতে শোকার্ত স্বজনদের হাহাকার। শবদেহগুলো সবই কোভিড রোগীদের।’

‘দেখলাম বৃদ্ধ, জোয়ান এবং শিশুরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। মৃত স্বজনের শবদেহ চিতায় তোলার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন বহু মানুষ … শ্মশানের মধ্যে খোলা জায়গায় চিতা চড়ানোর জন্য নতুন নতুন বেদি তৈরি করা হচ্ছে।’

সরকারি হিসাবে দিল্লিতে গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০ মানুষ কোভিডে মারা যাচ্ছেন, কিন্তু সোমবার মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য নগরীর তিনটি শ্মশানে গিয়ে কমপক্ষে ১০০ চিতা জ্বলতে দেখেছেন বিবিসির ওই সংবাদদাতা।

তিনি জানান, ‘প্রতিটি শ্মশানে একসাথে ১০ থেকে ১২টি চিতা একসাথে জ্বলছে।’ শ্মশান চত্বরে এত গরম যে মোবাইল ফোন ঠিকমত কাজ করছিল না।

সরাই কালে খান শ্মশানে গিয়ে জুবায়ের আহমেদ দেখেন, একজন মাত্র পণ্ডিত সেখানে সৎকারের ধর্মীয় আচারের কাজ করছেন। তার কথা বলারও সময়ও নেই।

‘আমি এক ফাঁকে ঐ পণ্ডিতের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম প্রতি ঘণ্টায় কতগুলো চিতায় আগুন জ্বালানো হচ্ছে। আমার দিকে না তাকিয়ে তিনি জবাব দিলেন – ‘২৪ ঘণ্টা শবদেহ আসছে, হিসাব মনে রাখার মত পরিস্থিতি তার এখন নেই।’

সংবাদদাতা বলছেন, ‘আমি সন্ত্রাসী হামলা দেখেছি। হত্যাকাণ্ড দেখেছি, কিন্তু এরকম গণহারে শবদেহ দাহ করার দৃশ্য এর আগে কখনও দেখিনি।’

এমনিতেই প্রচণ্ড গরম এখন দিল্লিতে। তারমধ্যে ক্রমাগত জ্বলন্ত চিতা আগুন থেকে তাপ আসছে। তারমধ্যে মাথা থেকে পিপিইতে ঢাকা কর্মী এবং স্বজনরা শবদাহের কাজ করছেন।

ঐ শ্মশান থেকে বেরিয়ে সংবাদদাতা দেখেন বাইরে খোলা মাঠে দাহের জন্য ২০ থেকে ২৫টি বেদি তৈরির কাজ চলছে। কর্মীরা জানালেন আগামী দিনগুলোতে শবদাহের চাপ আরো বাড়বে এই আশংকা থেকে বাড়তি এই বেদি তৈরি করা হচ্ছে।

‘দিল্লিতে একজন মানুষ শান্তিতে মরতে পর্যন্ত পারছেন না’

লোধি রোড শ্মশানে গিয়ে বিবিসির ঐ সংবাদদাতা দেখেন একসাথে ২০ থেকে ২৫টি চিতা জ্বলছে। সিমাপুরি শ্মশানে গিয়েও সংবাদদাতা দেখতে পান খোলা জায়গায় বাড়তি বেদি তৈরির কাজ চলছে। সেখানে শবদাহে সাহায্য করছে শিখদের একটি দাতব্য সংস্থা। ঐ সংস্থার একজন কর্মী বললেন, সিমাপুরিতে এখন প্রতিদিন একশরও বেশি শবদেহ দাহ করা হচ্ছে।

দিল্লি এবং আশপাশে কয়েক ডজন ছোট -বড় শ্মশান রয়েছে। সেগুলোতে গেলেই পরিষ্কার বোঝা যায় কোভিডের ভয়াবহ তাণ্ডব কীভাবে গ্রাস করেছে ভারতের রাজধানীকে।

সূত্র-বিবিসি বাংলা

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/