মায়ের জন্য ভালোবাসা-৪ ‘ও মা’

জিল্লুর রহমান প্রামানিকের স্মৃতিচারণমূলক গদ্য ‘ ও মা’

গভীর বনে পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট্ট একটা ঝরনা মানুষের অগোচরে মৃদুস্বরে এগিয়ে যায়, স্বচ্ছতোয়া জল শিশির বা অশ্রুর মতো টলমল করে। তার বুকে উড়ে-আসা হলদে বা বাদামি পাতা, নানাবর্ণ ফুল বা রেণু নিয়ে কোথায় সে যায়, মৃত্যুমোহনায়?

বা সেই ঝরনাটার কাছাকাছি কোমল ঘাসের সবুজ চাদর সরিয়ে নিশ্বাস নেয় কোনো একটি খুদে বেগুনি ফুল। পাখি ডাকে, দূরের আকাশে মেঘ চলাচল করে, আহ্লাদে গলেও পড়ে হয়তোবা। সবই নেপথ্যবর্তী, সবই ধূসর সুদূর। কেউ দেখে না, কেউ জানে না, কেউ মনে রাখে না। তবু তার অস্তিত্ব, তার বাস্তবতা তো অর্থহীন নয়!

বা আশ্বিনের বৃষ্টিভেজা ধলপহরে ছটিঘরে অস্থিরতা। মানবজন্মদানের আনন্দ ও আতঙ্ক মিলেমিশে একাকার। নিশ্চিত মৃত্যুর প্রস্তুতি, ‘আম্মা, বাঁচবো না, মাফ করে দ্যান।’ কিন্তু মৃত্যু তো মুক্তিও বটে। ফলে তুমি শুনতে পেলে একটি মানবশিশুর প্রথম চিৎকার।

ছেলে। ফজরের আজানের আগেই তাই ধ্বনিত হয়, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার!’

তারপরে কতদিন, কত রাত। কত আনন্দ, কত আঘাত। জীবনের যৌগ জটিলতা, প্রশান্তির ঈষদুষ্ণ প্রস্রবণ। ঘর থেকে ঘর কত দূর! একটা রান্নাঘর, একটা কান্নাঘর। তাতেই চাঁদ-সূর্যের সঙ্গে মেঘেদের লুকোচুরি। জীবন কী সহজে ফুরায়। মধ্য-মে বাইরে রোদ্দুর, শুক্রবার, তোমাকে দেখার জন্য গ্রামে ছুটলাম, বুকের ভেতরে মা-মা শব্দ, তুমি নির্বাক হয়ে বিছানায় বসে আছো, মা ডাক দিতেই তাকিয়ে দেখলে,ফলের জুস মুখে দিলাম, জুম্মার নামাজ পড়ে বড়ভাইসহ এসে দেখি তুমি বিরবিরিয়ে কি যেনো বলছো, দুভাই তোমাকে শুইয়ে দিলাম। তুমি চোখ মেললে, আমি ঝুঁকে পড়লাম, মা! যেভাবে সন্ধ্যা নামে পার্বত্য অঞ্চলে, তেমনভাবে নেমে এলো তোমার চোখের পাতা।

মনে আছে আসার আগে আমি তোমার মাথা স্পশ করলাম। তুমি কি টের পেয়েছিলে? তারপর তো তুমি আর চোখই মেলোনি! আমি ফিরে এলাম। নির্ঘুম রাত কাটছে। আমি উৎকণ্ঠ। রমজান মাস,শুক্রবার সেহরি খাওয়া শেষ, অপর প্রান্ত থেকে ফোন ভাই-ভাবিদের কান্নার শব্দ!ফজরের আজান হচ্ছে চারদিকে।

…কবরে নামলাম তোমাকে চিরদিনের মতো শুইয়ে দিলাম। হাত তুলে বললাম- ”রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানির সাগিরা”! আজও বাতাসের ওপাড় থেকে তোমার গন্ধ ছুটে আসে! ২০১৯ সালের ১৮ মে, খুব বেশি দূরেও নয়, খুব বেশি কাছেও নয়। সামনে কদিন পরে সেই দিনটি আবার কড়া নাড়বে মনে- ও মা! তুমি ভালো আছো তো!

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/