শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি

হুমায়ুন ফরীদি

আজ ২৯ মে, দেশের অন্যতম অভিনেতা  হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিন। একসময় মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্র এই তিন মাধ্যমেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই অভিনেতা। আশির দশকের মাঝামাঝিতে অভিনয়ে আসা হুমায়ুন ফরীদি কয়েক দশক ধরে দর্শককে মাতিয়ে রেখেছিলেন নিজের অভিনয় দিয়ে। অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। অভিনয়ের গুণে নিজেকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এই অভিনেতা।

প্রাথমিক জীবন

১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন ফরীদি। তার বাবার নাম এটিএম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৬৫ সালে বাবার চাকরির সুবাদে মাদারীপুরের ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ সময় মাদারীপুর থেকেই নাট্য জগতে প্রবেশ করেন। তার নাট্যঙ্গনের গুরু বাশার মাহমুদ। তখন নাট্যকার বাশার মাহমুদের শিল্পী নাট্যগোষ্ঠী নামের একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কল্যাণ মিত্রের 'ত্রিরত্ন' নাটকে 'রত্ন' চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি সর্বপ্রথম দর্শকদের সামনে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর এই সংগঠনের সদস্য হয়ে 'টাকা আনা পাই', 'দায়ী কে', 'সমাপ্তি', 'অবিচার'সহ ৬টি মঞ্চ নাটকে অংশ নেন।

১৯৬৮ সালে মাধ্যমিক পাস করার পরভর্তি হন চাঁদপুর সরকারি কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব-রসায়ন বিভাগে। এরপর ১৯৭১ সালে লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ের মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধের পর ফের ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তবে অর্থনীতি বিভাগে। এখান থেকেই  স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি আল-বেরুনী হলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল-দীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।

অভিনয়ে অবদান

হুমায়ূন ফরীদি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ অভিনেতা। অভিনয় ছাড়া জীবনে বলার মতো তেমন কিছুই করেননি তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই অভিনয়ে নিয়মিত হয়ে উঠেন হুমায়ূন ফরীদি। সখ্যতা গড়ে ওঠে দেশের বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল-দীনের সঙ্গে। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নাট্য উৎসবে তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মূলতঃ এ উৎসবের মাধ্যমেই তিনি নাট্যাঙ্গনে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন। সেখানে ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখে নির্দেশনা দেন এবং অভিনয়ও করেন। ছাত্রাবস্থায়ই ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হন এবং জড়িয়ে যান মঞ্চের সঙ্গে।

বেশ কিছু মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন এই অভিনেতা। তার অভিনীত মঞ্চ নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শকুন্তলা, কির্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, মুন্তাসীর ফ্যান্টাসি এবং ফণীমনসা, ধূর্ত উইঁ। মঞ্চনাটককে প্রসারিত করার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন নাটক কেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠন। এগুলোর মধ্যে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও গ্রাম থিয়েটার অন্যতম।

টেলিভিশন নাটকে হুমায়ুন ফরীদির অভিষেক ঘটে নিখোঁজ সংবাদ নাটকের মধ্যদিয়ে। এরপর তিনি অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেন। তার অভিনীত নাটক মানেই ছিলো বিশেষ কিছু। তখন বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব আতিকুল হক চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মামুন ও মামুনুর রশীদের বহু নাটকে অভিনয় করেছেন হুমায়ুন ফরীদি। এগুলোর মধ্যে দূরবীন দিয়ে দেখুন (১৯৮২), বাবার কলম কোথায়, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি (১৯৮৩), বকুলপুর কত দূর (১৯৮৫), দু’ভুবনের দুই বাসিন্দা, একটি লাল শাড়ি, মহূয়ার মন (১৯৮৬), সাত আসমানের সিঁড়ি (১৯৮৬), একদিন হঠাৎ (১৯৮৬), চান মিয়ার নেগিটিভ-পজেটিভ (১৯৮৬),  সংসপ্তক (১৯৮৭-৮৮), পথের সময় (১৯৮৯), দুই ভাই (১৯৯০), শীতের পাখি (১৯৯১), কোথাও কেউ নেই (১৯৯০), সমুদ্রের গাঙচিল (১৯৯৩), তিনি একজন (২০০৫), চন্দ্রগ্রস্ত (২০০৬), কাছের মানুষ (২০০৬),  মোহনা (২০০৬), ভবের হাট (২০০৭), প্রিয়জন নিবাস (২০১১), আরমান ভাই দি জেন্টলম্যান (২০১১) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তিনি টেলিভিশন নাট্যাভিনয়ের প্রথাগত ধ্যান ধারণা ভেঙ্গে সৃষ্টি করেন এক নতুন অভিনয় ধারা।

হুমায়ুন ফরীদি কিছু বাংলা চলচ্চিত্রে খলনায়কের অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি একাধারে আর্ট ফিল্ম এবং বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। বাণিজ্যিক আর বিকল্প ধারা মিলিয়ে প্রায় ২৫০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন হুমায়ুন ফরীদি। তার অভিনীত বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হুলিয়া, ব্যাচেলর, আহা, মাতৃত্ব, বহুব্রীহী, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া ও একাত্তরের যিশু।

তার অভিনীত বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের মধ্যে দহন, সন্ত্রাস, বিশ্বপ্রেমিক, ত্যাগ, মায়ের মর্যাদা, অধিকার চায়, মায়ের অধিকার, ভণ্ড, রিটার্ন টিকেট, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, দূরত্ব, পদ্মানদীর মাঝি  ইত্যাদি  উল্লেখযোগ্য। ঢাকাই চলচ্চিত্রে তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, তার অভিনীত ছবিতে নায়কের চেয়ে খলনায়কের চরিত্রই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তখন তার অভিনীত অনেক চরিত্রের সংলাপ দর্শকদের মুখে মুখে ফিরতো। চলচ্চিত্রে এতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন এই অভিনেতা।

কেবল অভিনয় নয়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে অতিথি শিক্ষক হিসেবেও কিছুদিন পাঠ দান করেন হুমায়ুন ফরীদি।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

অভিনয়ে দক্ষতার স্বীকৃতি হিসাবে বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন হুমায়ুন  ফরীদি। এগেুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০০৪ সালে ‘মাতৃত্ব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কার পান। ২০১৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন এই অভিনেতা।

ব্যক্তিগত জীবন

হুমায়ুন  ফরীদি প্রেমিকা মিনুকে বিয়ে করেন ৮০’র দশকে। জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর আহ্ববানে সাড়া দিয়ে কেবল বেলি ফুল দিয়ে তারা বিয়ে করেছিলেন। তখন এ বিয়ে সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। কিন্তু ভালোবাসার এই বিয়ে খুব বেশিদিন টেকেনি। এই সংসারে শারারাত ইসলাম দেবযানী নামের তার এক মেয়ে আছে। মিনুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর তিনি ঘর বাঁধেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফার সঙ্গে, ১৯৮৪ সালে। কিন্তু এই বিয়েও স্থায়ীত্ব পায়নি। ২০০৮ সালে তাদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকে একাই ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি।

মৃত্যু

২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ধানমন্ডিতে তার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তি অভিনেতা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।

আজ এই অভিনেতার ৬৮তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি।

সুবর্ণা মোস্তফার সঙ্গে হুমায়ুন ফরীদি

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/