সামাজিক মাধ্যমের বার্তা, শুনতে কি পাই

নিয়ন মতিয়ুল

নিয়ন মতিয়ুল
 
গণমাধ্যমের মূলধারার চেয়ে প্রসারতা, সক্রিয়তা, জনপ্রিয়তায় এখন অনেকটাই এগিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- এমন ধারণাকে এখন ‘বিতর্কিত সত্য’ হিসেবে ধরা যায়। যে কোনো ঘটনার সত্য জানার আগেই নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দিতে অতিউৎসাহী হয়ে পড়ছেন সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় অংশটি। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনো ভুক্তভোগীর দিকে আঙ্গুল বা অভিযোগ তোলার (ভিকটিম ব্লেমিং) ক্ষেত্রে আগ্রাসী ভূমিকাও পালন করছেন। বিশেষত কোনো নারী যদি হয় ভুক্তভোগী তাহলে অভিযোগের আঙ্গুল শাখা-প্রশাখাসহ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।

 সাম্প্রতিক কিছু আলোচিত ঘটনায় সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের বৃহৎ একটি অংশের এমন দৃষ্টিভঙ্গির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ অনেকের কাছে দাবানলের মতোই মনে হচ্ছে। বৃহৎ এই অংশকে প্রথাগত মূল্যবোধে বিশ্বাসী ‘মধ্যযুগীয় বয়ানকারীদের’ মুখপাত্র হিসেবেই ভাবছেন অনেকে। যদিও এক্ষেত্রে বিপরীত পক্ষের অভিযোগ, গণমাধ্যমের মূলধারা সর্বজনীন সত্য প্রকাশে অনেক সময়ই নীরব ভূমিকা পালন করছে। ক্ষমতাসীন কিংবা সমাজের প্রভাবশালীদের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালনেই বেশি আগ্রহী তারা। যে কারণে কেবল নির্বাচিত (সিলেক্টিভ) ইস্যুতেই তাদের সরব হতে দেখা যাচ্ছে।

 পরস্পরবিরোধী এমন আলোচনা-সমালোচনা-বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগের সবচেয়ে বড় আঙ্গুল এখন সামাজিক মাধ্যমের দিকে। অনেক দেশেই এ মাধ্যমটিকে কাঠগড়ায় নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে; যেন কোনো নাগরিক ‘যাচ্ছেতাই’ লিখে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি না করতে পারেন। বাংলাদেশেও এ মাধ্যমের সীমাহীন স্বাধীনতার নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। গণমাধ্যমের মূলধারার ঐতিহ্যকে সমুন্নত কিংবা বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে সামাজিক মাধ্যমে ‘যা খুশি তাই লেখা’র বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন অনেক সংবাদকর্মীই।

তবে সামাজিক মাধ্যমের ওপর খবরদারি কিংবা নিয়ন্ত্রণ আরোপের আগে এর অন্তর্নিহিত বার্তা পড়ে নেয়া এখন সময়েরই দাবি। তার আগে দেশে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের পরিসংখ্যান জানা প্রয়োজন। গবেষণা বলছে, গেল বছরের (২০২০) এপ্রিলে দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার। চলতি বছরের (২০২১) মে পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে চার কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরেই ব্যবহারকারী বেড়েছে প্রায় এক কোটি। একই সময়ে ম্যাসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম ও লিংকডইনের মতো প্লাটফর্মগুলোর ব্যবহারও বেড়েছে। করোনা মহামারীকে সঙ্গী করে সভ্যতা গতিশীল থাকলে এই পরিসংখ্যান বাড়তেই থাকবে।

 এবার সামাজিক মাধ্যম কারা ব্যবহার করছে সেটা দেখে নেয়া যেতে পারে। গবেষণার তথ্যমতে, চার কোটি ৮২ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে দুই কোটি ১২ লাখের বয়সই ১৮-২৪ বছরের মধ্যে। যারা একেবারেই তরুণ জনগোষ্ঠী। এক্ষেত্রে মোট ব্যবহারীর ৬৯ দশমিক ১ শতাংশই পুরুষ আর নারীর সংখ্যা ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় অংশটিই শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষাজীবনে ইতিটানা টগবগে তরুণরা।  

 তবে সামাজিক মাধ্যম শুধু যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীভিত্তিক উন্মুক্ত মতামত প্রকাশের প্লাটফর্ম হিসেবেই ব্যবহার হচ্ছে তা-ই নয়। বরং অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করে বহুমুখী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি ব্যবহারকারী বা ভোক্তার কাছে সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য বাহন হিসেবেও কাজ করছে। যেখানে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের পারস্পরিক ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অনেক দেশে ইতোমধ্যে কনটেন্ট বা খবর ভাগাভাগির জন্য অর্থ দিতেও শুরু করেছে এই মাধ্যম। বাংলাদেশেও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সফলভাবে টিকে থাকার ক্ষেত্রে এই মাধ্যম সম্ভাবনার বড় দুয়ার খুলে দিতে পারে।

সামাজিক মাধ্যমের এই অপরিহার্যতা দিন দিন বেড়েই চলছে। একই সঙ্গে তরুণ থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষের মতামত প্রকাশের অবারিত সুযোগও তৈরি হয়েছে। যা রাজনীতিক বা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে গণমাধ্যমের মূলধারা। জনপ্রিয় হয়ে টিকতে থাকতে একমুখী দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে বহুপক্ষের মতামত প্রকাশ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।

 অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণমাধ্যমের মূলধারা যখন সত্য প্রকাশে দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা অসহায় হয়ে পড়ে কেবল তখনই সামাজিক মাধ্যমে আগ্রাসী মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কিংবা ব্রাত্যজনের কণ্ঠস্বর না হয়ে অভিজাত মহলের মুখপাত্র হয়ে উঠলেই কেবল মূলধারার ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। নির্বাচিত সাংবাদিকতার বিপরীতে ব্যক্তিক সাংবাদিকতার ভয়াবহ উন্মেষ ঘটে। আর এসব ঘটনায় মূলধারায় উপেক্ষিত অংশের যে চেহারা দেখতে পাওয়া যায় তা আঁতকে ওঠার মতোই।

সামাজিক মাধ্যমে তরুণ জনগোষ্ঠীর একাংশের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটাই বোধগম্য হয় যে, আকাশচুম্বী অবকাঠামো আর সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে আত্মতুষ্টির যে মহামারি জাতিকে আক্রান্ত করছে তাতে শুধুই সমৃদ্ধ শূন্যতার হাহাকার। বুদ্ধি ও জ্ঞানভিত্তিক উদার অসাম্প্রদায়িক আর যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির সমাজ বিনির্মাণে ভয়াবহ ব্যর্থতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একই সঙ্গে মাথা ব্যথায় মাথা কেটে ফেলার বিপদ সম্পর্কেও সতর্কবার্তা দেয়।

তবে বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, ‘ভিকটিম ব্লেমিংকাণ্ডে’ প্রথাগত মূল্যবোধে বিশ্বাসী ও ‘মধ্যযুগীয় বয়ানকারীদের’ সঙ্গে অগ্রসরধারার অসাম্প্রদায়িক চেতনার সমর্থকদের একটি অংশের দৃষ্টিভঙ্গিগত মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। প্রগতিশীলদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যযুগীয় ধারায় এই বদল কীসের ইঙ্গিত- তা নিয়ে কৌতুহল বাড়ছে। সেই সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার দেয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওর বিকল্প চাওয়ার ঘটনা সরকারের মন্ত্রী-এমপি আর ক্ষমতাসীন দলের দৃষ্টিভঙ্গি বা নীতি-আদর্শের সংস্কারের ইঙ্গিত কিনা সে প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজছেন অনেকে। অবশ্য এসব জরুরি প্রশ্ন গণমাধ্যমের মূলধারার চেয়ে বেশি আলোচিত এখন সেই ‘বিপজ্জনক’ সামাজিক মাধ্যমেই।

 বলা বাহুল্য, ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বেশি ভোট পেয়েও ইলেক্টোরাল ভোটের মারপ্যাঁচে ট্রাম্পের কাছে হেরে গিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। ফেসবুকে সক্রিয় তিন কোটি তরুণ ভোটারের তথ্য ব্যবহার করে এই মারপ্যাঁচের কাণ্ড ঘটিয়েছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা’। অবিশ্বাস্য এই কাণ্ডে শেষ অবধি ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গকে হাজির হতে হয়েছিল কংগ্রেসে। সামাজিক মাধ্যমের তথ্য যে শুধু তথ্যই নয়, রাষ্ট্র-রাজনীতি বা সমাজ বদলে দেয়ার বড় হাতিয়ার এটাই প্রমাণিত হয় সেই ঘটনায়। সামাজিক মাধ্যম বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এই দৃষ্টান্তের ইতিবাচক দিক আমলে নেয়া প্রয়োজন।

দেশে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা অপ্রতিরোধভাবে বেড়েই চলছে। যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় তারুণ্যে ভরপুর জনগোষ্ঠী। তাদের মতামত আর মন্তব্যের মধ্যেই ফুটে উঠে দেশ, জাতি, সমাজ নিয়ে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব, স্বপ্ন-সম্ভাবনা। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গিই মূলত আমাদের সমাজের প্রকৃত চেহারা। সময়ের দাবির সঙ্গে সঙ্গে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচকধারায় পাল্টে দিলেই বদলে যেতে পারে সমাজ। এক্ষেত্রে সঠিক ও ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার বদলে অন্ধ হয়ে থাকলে প্রলয় বন্ধ হবে না কিছুতেই।

নিয়ন মতিয়ুল: লেখক ও সাংবাদিক।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/