বাবা হলেন বটবৃক্ষ

আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

বাবা তুমি লক্ষী, বাবা আমার প্রাণের মেলা          
বাবা তুমি ভরসা আমার, না যেন করি হেলা               

বাবা বন্দনা করেই শুরু করছি বাবা এবং বাবা দিবসের কথা।  এই পৃথিবী-প্রকৃতির ধারাবাহিকতা মেনে চলে; ধারাবাহিকতা আছে বাবা দিবসেরও। আমরা জানি মা দিবসের মতো অতো জৌলুসপূর্ণ না হলেও বিংশ শতাব্দির প্রথম দিক থেকে বাবা দিবস পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে ১১১টির বেশি দেশে বাবা দিবস বা ফাদার’স ডে পালিত হয়। বাবা দিবসের প্রতীক গোলাপ। রঙিন গোলাপ জীবিত এবং সাদা গোলাপ মৃত বাবাদের  শ্রদ্ধা-সম্মান-শুভেচ্ছার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাবা দিবস সম্পর্কে নানা রকম কথা বা গল্প চালু আছে। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কথা-গল্প হলো যুক্তরাষ্ট্রে সেনোরা নামে একজন নারী বাবা দিবসের প্রচলন করেন। তিনি দেখেছেন তাঁর মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃতুবরণ করার পর তাঁদের বাবা সংসার এবং সন্তানদের আগলে রেখেছেন। বাবাকে খুব ভালোবাসতেন সেনোরা। সেনোরা  ১৯০৯ সালে একদিন গির্জাতে গিয়ে একটি বক্তব্য থেকে মায়ের সন্তান ধারণ-লালন-পালন করার কষ্ট থেকে মা দিবস উদযাপনের কথা জানতে পেরে তাঁর বাবার কষ্টের কথা অনুভব করেন। সেই ভাবনা থেকেই বাবার জন্য একটি দিবস থাকা উচিত মনে করে ১৯১০ সালের ১৯ জুন অনানুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস উদযাপন করেন। এরপর ১৯১৩ সালে মার্কিন সংসদে ফাদার’স ডে নামে একটি বিল উত্থাপিত হয় এবং ১৯২৪ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ক্যালভিন কুলিজ এই বিলের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডস  জনসন জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবসের ছুটি হিসেবে ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে রিচার্ড নিক্সন ‘বাবা দিবস’কে আইনে পরিণত করেন এবং প্রতিবছর জাতীয়ভাবে পালন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে দিনটি জাতীয়ভাবে পালিত হলেও বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দিনে বিভিন্নভাবে এই দিবসটি পালন করে। তবে এই দিবস পালনের আগে মধ্যযুগে ইউরোপের ক্যাথলিক দেশগুলোতে ‘সেন্ট জোসেফ দিবস’ পালিত হতো।

এবারে আমার স্মৃতিতে বাবা অর্থাৎ আমার/ আমাদের বাবার কথা বলি। বাবা ছিলেন কৃষকনেতা এবং মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারী। দেশ ছিল তাঁর প্রিয় বিষয় এবং প্রিয় ছিল দেশ আর মেহনতি জনগণের জন্য কাজ। তিনি শুধু কৃষক নেতাই ছিলেন না;  তিনি ছিলেন কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, নাট্যকার। তাই বলে আমরা-সন্তানেরা ফেলনা ছিলাম না তাঁর কাছে। আমরাও ছিলাম তাঁর কাছে এই স্বদেশের মতোই প্রিয়। বাবা, তাঁর রাজনৈতিক কর্মের অবসরে আমাদের লেখাপড়ার খোঁজখবর করতেন, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়াও করতেন। মাঝেমধ্যে দুষ্টুমিও করতেন আমাদের সঙ্গে; আমাদের জন্য তাঁর স্নেহ ফল্গুধারার মতো বইতো আমাদের ঘিরে। আমাদের সময়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক খুব বন্ধুত্বের না হলেও  বাবা ছিলেন বন্ধুর মতো স্নেহশীল, কর্তব্যপরায়ন, স্বাধীনতাকামী। তিনি নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সেইসময়ে গ্রামে এখনকার মতো শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত না থাকায় আমাকে শিক্ষার জন্য গ্রাম থেকে শহরে পাঠিয়েছিলেন। সাইকেল-মোটরসাইকেল চালানো শিখিয়েছিলেন। আমার ছোটোবেলাতে ‘কারবাংকল’ হয়েছিল, পায়ে ব্যথা, ফুলে যাওয়া, পূঁজ হয়েছিল, বিছানায় ছিলাম কয়েকমাস; হাঁটতে পারতাম না। ছোটোবেলার মতো বাবা হাত ধরে হাঁটিয়েছেন; প্রায় ছয়/সাত মাস হেঁটে হেঁটে তবে হাঁটতে পেরেছি।

বাবা ফুটবল খেলতেন; গ্রামের বাইরে খেলতে যেতেন। ছোটোবেলাতে বাবা বাইরে যেতে নিলেই আমিও বাবার সঙ্গে যেতে চাইতাম আর কাঁদতাম! খুব ছিঁচকাঁদুনে ছিলাম। বাবাকে খুব ঝামেলা পোহাতে হতো আমার জন্য। আদর করে ভুলিয়েভালিয়ে তবে যেতে হতো তাঁকে। আমাদের গ্রামে উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় আমাকে শিক্ষার জন্য শহরে যেতে হয়েছিল। পাবনা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি তখন। পাবনাতে খানবাহাদুর ওয়াসিমউদ্দিন খান সাহেবের বাসায় থেকে লেখাপড়া করি। স্কুল ছুটির পর এবং ছুটি শেষে পাবনাতে আনা-নেওয়ার কাজ আমার মা-ই সাধারণত করতেন। মাঝেমধ্যে মায়ের কাজ থাকলে কিংবা পাবনাতে বাবা এবং মতিন (ভাষা মতিন) চাচার কাজ থাকলে বাবা আর মতিন চাচা নিয়ে এসেছেন আমাকে। একবার কোন কাজে বাবা এবং মতিন চাচা দুজনে পাবনা গিয়েছিলেন, ফেরার পথে আমাকে সঙ্গে নিয়ে এসে ঈশ্বরদী বাজারে তাঁদের কাজ থাকাতে স্বচিহ্নিত বটতলাতে (বাস থামতো) বাস থেকে নামিয়ে দিয়ে মামাবাড়ি যেতে বললেন। ওটা ঈশ্বরদীর পূর্বটেংরির রাস্তা। কিছুদূর গেলেই মামাবাড়ি। ওখানে বাস বা রিকশা যেতো না, হেঁটে যেতে হতো। বাবা বললেন, ‘মামার বাড়ি যাও, আমরা কাজ সেরে বাড়ি যাওয়ার পথে নিয়ে যাবো  তোমাকে।’ এই কথা বলে ঈশ্বরদী বাজারে চলে গেলেন তাঁরা। আমি রাস্তা চিনতে পারি না কখনও। চেনা রাস্তাও ভুল হয়ে যায়। সেদিনও হলো। বটতলার চারপাশে পানের দোকান বসেছিল সেদিন। পানের দোকান দেখে ভেবেছি এ পথ সে পথ নয়, অন্য পথে যেতে হবে! আমিও  ভুল করে চলে গেলাম অন্য পথে। বটতলা যাওয়ার আগে একটি ছোট ব্রিজ, নিচে ছিল বহতা নদীর শাখা। আমি উল্টা পথে সেই ব্রিজে গিয়েছিলাম তারপর ব্রিজের রেলিং-এ হেলান দিয়ে কান্না শুরু করেছিলাম। ছিঁচকাঁদুনে তো! আমাকে কাঁদতে দেখে একজন (আমি না চিনলেও তিনি চিনেছিলেন) এসে বললেন,‘চল মামার বাড়ি দিয়ে আসি।’ আমি আসতে চাইনি, তিনি জোর করে নিয়ে এলেন। মামা বাড়িতে এসে আমার মামীকে বলেন, ‘ভাবী, দিয়ে গেলাম আপনাদের মেয়েকে।’ মামী অবাক। ‘আপনাদের মেয়ে তো আমাকে চিনে নাই।’ বলে হাসতে শুরু করলেন। আমি অবশ্য আজও পরিচিতজনদের নাম মনে রাখতে পারি না, আবার সবার চেনা মুখটাও অচেনা মনে হয় কখনও কখনও। যাহোক, আমি না চিনলেও কৃষক নেতা আলাউদ্দিন আহমেদের মেয়ে বলে নিজ গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের অনেকেই চিনে আমাকে। পরে বাবা আর মতিন চাচা কাজ সেরে মামা বাড়িতে এসে আমাকে নিয়ে আসে বাড়ি; শাহপুরে।  

আমার বাবা সবসময় চাইতেন আমি সর্বেসর্বা হই, সবকিছুতেই প্রথম হই (হতে পারিনি)। আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরের রাস্তা পার  হয়ে বড়ো সড়ক (এখন পীচঢালা), সেই সড়কের গা ঘেঁষে বয়ে যেতো দুটি নদী। ওই সড়কটি বর্ষার সময় নদীতে ডুবে যেতো; ঐ সড়ক উঁচু করার সময় শ্রমিকদের সঙ্গে মাটি কেটেছেন তখনকার ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট (চেয়ারম্যান) আমার বাবা। এখন আর সে নদী নেই। তখন কানায় কানায় পূর্ণ থাকতো সে নদী। বাবা ঐ নদী থেকে মসজিদের মুসুল্লিদের ওজুর জন্য পানি তুলে ড্রাম ভরে রেখে দিতেন। বাবার সকল চাওয়ার মধ্যে একটি চাওয়া ছিল সাঁতার শিখি, একদিন আমার চাচা (বাবার চাচাতো ভাই) নদীতে নিয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। অতি ভীতু প্রকৃতির হওয়ায় খুব ভয় পেয়েছিলাম। চিৎকার করে উঠেছিলাম। বাবা তীরে বসেছিলেন; চিৎকার শুনে হেসে বলেছিলেন, ওর দ্বারা সাঁতার শেখা হবে না। আসলেই আমার সাঁতার শেখা হয়নি। এবার বলি অন্য কথা; বাংলাতে একটি প্রবাদ আছে, “প্রত্যেক অসাধারণ মেয়ের পেছনেই একজন অসাধারণ বাবা রয়েছেন।” পরিবারে একটি মেয়ে তাঁর বাবার ছত্রছায়াতেই বেড়ে ওঠে এবং পরিপূর্ণতা পেয়ে বেঁচে থাকে। কথায় আছে মায়ের নির্ভরতা হলো পুত্র আর বাবার ভালোবাসা হলো কন্যা। কিন্তু ইদানিং কাগজে কিছু খবর দেখে নিজেরই খুব খারাপ লাগছে। লজ্জায়-ঘৃণায় এসব কথা বলতে ইচ্ছা করে না তবুও বলি, খবরে প্রকাশ কোন কোন বাবা নিজের মেয়েকে বিক্রি করছে, মেরে ফেলছে, রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে; এমন কি অনৈতিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করছে মেয়েকে! এসব বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়! যে বাবা হবে তার কন্যার আশ্রয়-ভালোবাসা, উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেওয়ার অবলম্বন হবে সেই বাবার ব্যবহার যদি এমন হয় তাহলে প্রকৃতি তো রুষ্ট হবেই!

আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব আমার বাবা। তাঁর সরলতা, তাঁর কর্মনিষ্ঠা, তাঁর সত্যনিষ্ঠা শুধু আমি নই আমরা অনুসরণ করতে চেষ্টা করি। শুধু বাবা দিবসে নয় সবসময় প্রার্থনা একজন সন্তানের আদর্শ হয়ে উঠতে পারেন তাঁর বাবা। সেই রকম কাজ যেন করেন সকল সন্তানের পিতা। সন্তানের কাছে বাবা হয়ে উঠুক বটবৃক্ষ; ঐ বৃক্ষের ছায়ায় সন্তান থাকবে হাসিখুশি, বড়ো হয়ে মানুষের মতো মানুষ হবে এবং রাষ্ট্র পাবে সুস্থ সুন্দর সু-নাগরিক। আরও একটি প্রার্থনা কোন বাবা যেন সন্তানের কাছে অবহেলার পাত্র না হন।  

কিছু কথা যেমন বাবার জন্য তেমনই সন্তানের জন্য :
ক. এই সমাজ প্রতিবন্ধী হতে পারে কিন্তু বাবা তাঁর চিন্তা চেতনায় কখনও প্রতিবন্ধী নন
খ. পুত্র-কন্যা  উভয়েই বাবার আত্মার আত্মীয়
গ. ঈশ্বরের পরেই যেমন মায়ের স্থান তেমনি বাবারও
ঘ. জন্মের ঋণ যেমন আছে মায়ের কাছে, তেমনি আছে বাবার কাছেও
ঙ. বাবা, তাঁর সন্তানের কাছে বটবৃক্ষের মতো  
চ. বাবা হলেন প্রথম শিক্ষাগুরু

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া

আফরোজা অদিতি: কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫৫টি। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার যার মধ্যে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, কবি কামিনী রায় সাহিত্য পুরস্কার, কবি জীবনানন্দ দাশ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ নারী লেখক সোসাইটির পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/