বাবা দিবসের বিশেষ গল্প ‘বাবা’

বাবা দিবসের বিশেষ গল্প ‘বাবা”

মাহমুদা আকতার

তার সঙ্গে আমার দেখা ঢাকা মেডিকেলের গেইটে। উস্কো খুস্কো চুল, উদভ্রান্ত দৃষ্টি। দেখেই বোঝা যায়, বিরাট ঝামেলায় আছে মানুষটা। আমার তার সঙ্গে আলাপ জমানোর ইচ্ছা হলো। তাই ডাক দিয়া বললাম-ভাই, ম্যাচ আছে?
-আমি কি আপনার লাইগা মেচ নিয়া ঘুইরা বেড়াইতাছি?
-ভাই, মেজাজ এত খাট্টা কেন? কোনো সমস্যা থাকলে আমারে বলতে পারেন।
-আমার সমস্যা একটা না, বহু। আর আপনারে বলে কি লাভ? আপনি কি সমাধান দিতে পারবেন?
-আরে ভাই, কষ্টের কথা কইলে মানুষের দিলে একটু আরাম হয়। যাক সমস্যা না কইতে চাইলে না কন। এইটা তো চলে, নাকি!
আমার হাতে সিগারেটের প্যাকেট দেখে তার দৃষ্টি খানিকটা নরম হলো মনে হয়। আমরা মেডিকেলের সামনে একটা টং হোটেলে গিয়ে বসলাম। লোকটাকে দেখেই মনে হয় সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। তাই দুইটা পরোটা, ভাজি আর দুজনের জন্য দুই কাপ চা অর্ডার করলাম। লোকটার খাওয়া শেষ হলে সিগেরেট ধরাই। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে বলে
-মেয়েটার ডেঙ্গু হইছে। নাক মুখ দিয়া রক্ত পরতেছে দেইখা তিন দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করছি। কিন্তু সমস্যা হইলো ওর সাথে থাকার কেউ নাই।
হঠাৎ করে কাউকে তো আর স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করা যায় না। তাই ঘুরিয়ে বলি
-বাসায় আর কেউ নাই?
-আছে আমার মা। সে বুড়া মানুষ, হাসপাতালে কি থাকতে পারে? চাকরি বাকরি বাদ দিয়া কয়টা দিন ধইরা মেয়ের সাথে বইসা আছি।
-আর মেয়ের মা?
-ওই মাগীর কথা কইয়েন না, তিন দিন ধইরা তার খোঁজ নাই।
-ঝগড়া করছিলেন নাকি?
-আরে বিয়ার আগে তার একজনের লগে পিরিত আছিলো। হের লাইগা কান্দে, দুইদিন পরপর লাঙের লগে দেখা করতে যায়।
-হুম, পিটাপিডিও করছিলেন মনে হয়।
-ওইরকম মহিলারে পিডামু না তো কি করুম!
-ভাই, কিছু মনে কইরেন না, একটা কথা কই মনোযোগ দিয়া শুনেন। আপনার বউ চুরিও করে নাই, ডাকাতিও না। একটা প্রেমই তো করছে, কাউরে তো খুন করে নাই। আর ভালোবাসার প্রতিশোধ কেবল ভালোবাসা দিয়েই সম্ভব। আপনি যদি তারে অনেক বেশি ভালোবাসতেন, তার প্রেমিকের চেয়েও বেশি আদর করতেন, তাইলে সে এতদিনে ওই লোকরে ভুইলা আপনারে ভালোবাসতে শুরু করতো।
-ধুর মিয়া কি যে কন! পরেরে এমন উপদেশ খুব দেয়া যায়, নিজের হইলে বুঝতেন। আমি এখন যাই। পাশের বেডের একজনরে মেয়ের পাশে বসাইয়া আসছি। এতক্ষণে মনে হয় কান্নাকাটি শুরু করছে।
-দাঁড়ান ভাই। আপনার কোনো সমস্যার সমাধান তো দিতে পারলাম না। তয় আপনের অসুস্থ মেয়েটাওে একবার দেখে যেতে চাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
-আপত্তি আর কি, আসেন।
সত্যি সত্যি বাবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল মেয়েটি। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, আমারে রেখে কোথায় চলে গেলে। সেই কখন থেকে তোমারে খুঁজতেসি। ডাক্তার আঙ্কেলও কয়েকবার খুঁজে গেলো।
আমি দূরে দাঁড়িয়ে বাবা আর মেয়ের সোহাগ দেখতে থাকি। মেয়েটা দেখতে ভারি মিষ্টি। আর কথাও বলে কত সুন্দর করে। বুঝলাম, তার মা তাকে এভাবে কথা বলা শিখিয়েছে।
-ও বাবা, মা কখন আসবে? মা কি আমাকে দেখতে আসবে না?
– দেখ মা কারে নিয়া আসছি। তোমার একটা আঙ্কেল।
-নতুন আঙ্কেল বুঝি, এর আগে কোনোদিন তো দেখি নাই।
মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতি। অসুস্থতা তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য কেড়ে নিতে পারেনি। আমি এবার ওর বেডের দিকে এগিয়ে যাই।
-জ্বি মা, আমি তোমার নতুন আঙ্কেল। তুমি আমাকে এই নামেই ডাকতে পার।
এই সময় ডাক্তার এসে বললেন, সানোয়ার সাহেব, আপনার জন্য একটা সুখবর আছে। একটু আগে রিপোর্ট আসছে, আপনার মেয়ের ডেঙ্গু হয়নি। আপনি চাইলে আজই ওকে রিলিজ করিয়ে নিতে পারেন।
-অনেক ধন্যবাদ স্যার। আমিই আজই মেয়েকে বাসায় নিযে যেতে চাই। আমাকে কি করতে হবে?
-আপনি অফিসে যোগাযোগ করেন। তারাই সব বলে দিবে।
সানোয়ার সাহেব গেলেন মেয়ের রিলিজ নিতে। আর এই ফাঁকে আমি ভাব জমিয়ে ফেললাম টুকটুকির সঙ্গে। হুম, সানোয়ার সাহেবের মেয়ের নাম ওটাই। টুকটুকি আমাকে বেশ কয়েকটা রাইম শোনালো। আর আমিও জেনে নিলাম ওর পছন্দ সম্পর্কে। ওর সবচেয়ে প্রিয় চকলেট, ক্যাটবেরি চকলেট আর চিপসের মধ্যে পছন্দ প্রিঙ্গেলস। যদিও এগুলো সবসময় মেলে না। জন্মদিনের সময় মা কিনে দেন। তবে ওর সবচেয়ে পছন্দ জন্মদিনে কেক কাটা। তাই শুধু নিজের নয়, যে কারো জন্মদিনের পার্টিই ও এনজয় করে। স্কুলে ওর প্রিয় বন্ধু তিনজন, রুমকি, মেহজাবিন আর পলিন। তবে চারজন একসঙ্গে বসতে পাওে না। ওদেও স্কুলের ছোট বেঞ্চে কেবল দুজন করে বসা যায়। ও বসে রুমকির সঙ্গে। আর ভালো লাগে পুতুল খেলতে। মা ওকে বেশ কয়েকটা কাপড়ের পুতুল বানিয়ে দিয়েছে। ওর কিছু কেনা পুতুলও আছে। তবে কোনো দামি পুতুল নাই, যেমনটা ওর বন্ধুদের আছে। ওদের কোনো আত্মীয় তো বাইওে থাকে না। কে ওকে এনে দিবে এত সুন্দর পুতুল! আমরা গল্প করতে করতেই হাসপাতালের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলেন সানোয়ার সাহেব।
টুকটুকি রিলিজ পাওয়ার পর আমি জানতে চাইলাম, ‘আপনারা বাসায় যাবেন কীভাবে?
-সেটাই তো ভাবছি যেই রোদ। একটা সিএনজি ফিএনজি তো নিতেই হইবো।
-এই সময় সিএনজিতেও গরম লাগবে। আপনি চাইলে আমি একটা ব্যবস্থা করতে পারি। কোথায় যাবেন বলেন?
উনি বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন,‘আপনার সাথে কি গাড়ি আছে?
-না ভাই, আমি কোনো ধনী মানুষ নই। আমার গাড়ি নেই। তবে মোবাইলে উবার অ্যাপস ডাউন লোড করা আছে। আপনি ঠিকানাটা বলেন, আমি উবার ডাকছি।
গড়ি দেখে টুকটুকি তো মহাখুশি। সে গিয়ে সামনে বসতে চাইলে।া দুর্বল শরীরে মেয়েকে ড্রাইভারের পাশে বসতে দিতে আপত্তি ছিলো সানোয়ার সাহেবের।
-আপত্তি করবেন না, ওর ভালো লাগবে। আর আনন্দে থাকলে ওরই ভালো। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। ও বসুক ওখানে।
পিছনে বসলাম আমি আর উনি। গাড়িতে এসির ঠাণ্ডায় ওর বোধহয় খুব আরাম হচ্ছিল। তিনি সিটে মাথা দিয়ে চোখ বুঁজে ফেললেন। বেচারা, সারারাত মেয়েকে নিয়ে কত ধকল করেছে। থাক, খানিকটা ঘুমিয়ে নিক।
এসময় মোবাইলের শব্দে তিনি জেগে উঠলেন। আমি কেবল এপাশের কথা শুনছিলাম। কথা শুনে বুঝতে পারি তার মা ফোন করেছে।
-হ্যালো, কে ফোন করসিলো? হুম ভালো বলছো। আচ্ছা আমরা এখন গাড়িতে। টুকটুকিকে নিয়ে বাসায় আসতাছি। হ, ওর ডেঙ্গু হয় নাই। আচ্ছা এখন ফোন রাখ।
-কে ফোন করছিলেন, আমার মা বুঝি। কি বললেন?
– হ্যা, আমার মা। ওই বাসা থেকে ফোন করেছিলো টুকটুকির নানি। হয়তো ওর মাই ফোন করাইসে। টুকটুকি কোন হাসপাতালে জানতে চাইসিলো। মা তো ওয়ার্ড বা বেড নাম্বার জানে না, খালি বলছে ঢাকা মেডিকেল। এখন হাসপাতালে আইসা খুঁজতে থাকুক।
-আপনি তাহলে শ্বশুড়বাড়িতে ফোন করুন। নইলে তারা খামোখা হাসপাতালে এসে খোঁজাখুজি করে হয়রান হবেন।
-না, আমি কেন ফোন করবো। কখনই করবো না। কাল যখন ফোন করে নিলুফারকে চাইলাম, তখন ওর নানী কয়, নীলুফার নাকি বাড়ি যায় নাই। কত বড় মিথ্যাবাদী!
-না, সানোয়ার সাহেব, আপনার এই জেদটা যৌক্তিক নয়। খামোখাই আপনি রাগ করছেন। হয়তো আপনার স্ত্রী তাকে এমনটা বলতে বলেছিলো।
-মেয়ে অসুস্থ জানার পরও কোনও মা এমন করে?
-হয়তো তখন তার রাগ বেশি ছিলো। কিংবা সে আসলেই বাড়িতে ছিলো না। এখন শোনার পর ছুটে আসতে চাইছেন। আপনি উনাকে এভাবে হয়রানি করতে পারেন না।
তারপরও গো ধরে বসে থাকেন সানোয়ার। আমি তাকে অন্যভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি।
–তাছাড়া মেয়ে বাড়ি ফিরছে শুনলে আপনার ওয়াইফ বাড়িতে ছুটে আসবে। আর মাকে দেখলে মেয়ের অসুস্থতা এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। আপনি কি একা একা মেয়ের দেখভাল করতে পারবেন? এমনিতেই তো তিন দিন ধরে অফিসে যান না। আর আপনার বুড়ো মা কি ওকে ঠিকমত ওষুধপত্র খাওয়াতে পারবেন?
-ঠিক আছে, আপনার আত্মসম্মানে লাগলে আমিই ফোন করছি।
হয়তো এতক্ষণে আমার সঙ্গে থাকার কারণে কিংবা আমার আচরণে খানিকটা কৃতজ্ঞতা হয়েছে তার। তাই আর আপত্তি করলেন না।
-নিন নাম্বার বলুন।
আমি ফোন করলাম। একজন বয়স্কমত মহিলা ফোন ধরলেন।
-আপনার সঙ্গে সানোয়ার সাহেব কথা বলবে। এই বলে আমি টুকটুকির বাবাকে ফোন দিয়ে দিলাম।
-হ্যালো, স্লামালেকুম। হাসপাতালে আইসা কি করবেন, টুকটুকিরে তো রিলিজ দিয়া দিসে। আমরা এখন বাসায় যাইতেছি।
-না, টুকটুকির ডেঙ্গু হয় নাই। ঠাণ্ডা বেশি লাগছিলো, তাই নাক দিয়া রক্ত পড়ছে। আচ্ছা এখন রাখি, খোদা হাফেজ।
আমি ড্রাইভারকে একটা সুপার মলের সামনে গাড়ি রাখতে বলি। এরপর টুকটুকিকে নিয়ে নেমে আসি। সানোয়ার সাহেব অবশ্য প্রথমে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু আমি আর টুকটুকি তাকে পাত্তাই দেইনি। আমি টুকটুকিকে নিয়ে দোকানের চকলেট র‌্যাকের সামনে যাই। এখানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা সব বিদেশি চকলেট।
-নাও, যে কয়টা লাগবে তুমি নাও।
টুকটুকি বেছে বেছে মাত্র দুটো চকলেট নেয়। আমি বুঝলাম মেয়েটা লোভী নয়। আর ওর বিবেচনা বোধও চমৎকার। একটা বাচ্চার মধ্যে এই সামাজিক জিনিসগুলো তৈরি করে একজন মা। ওর মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। আমি র‌্যাক থেকে ক্যাটবেরির সবচেয়ে বড় বারটা তুলে নিলাম, ওর কোনো আপত্তি না শুনেই।
-না, আঙ্কেল, অত বড় চকলেট আমি খেতে পারবো না। মা খুব বকবে।
-আমি তোমার আঙ্কেল না, মা কেন বকবে?
এরপর আমি টুকটুকিকে আরো কয়েকটা চকলেট, দুটো প্রিঙ্গেল বক্স, একটা চিকি মাঙ্কি বক্স, একটা দুই পাউন্ডের কেক কিনে দিলাম। এর ওপর লিখে নিলাম, হ্রাপি বার্থডে টু টুকটুকি।
-আঙ্কেল, আমার তো আজ জন্মদিন নয়। আমার জন্মদিন ২৩ অক্টোবর।
-মাঝে মাঝে এমনি এমনি জন্মদিন করা যায়। আজ আমরা জন্মদিন জন্মদিন খেলবো। এরপর আর আপত্তি করলো না মেয়েটা।
এরপর গেলাম খেলনা কর্ণারে। একসঙ্গে এত পুতুল দেখে টুকটুকির চোখ ছানাবড়া।
-তুমি এখান থেকে সবচেয়ে সুন্দর আর বড় পুতুলটা নাও।
-আঙ্কেল এই পুতুল তো অনেক দামী। মা-বাবা বকবেন।
-আরে আমি আছি না, কে টুকটুকি সোনাকে বকে দেখি।
বাসায় ফিরে দেখি টুকটুকির মা এসে হাজির। মেয়েকে দু হাতে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর মেয়ের হাতে এতকিছু দেখে আমাকে নিয়ে পড়লেন।
-ভাই, আপনি এটা কি করেছেন? এতকিছু কেন কিনে দিয়েছেন। আর আজ তো টুকটুকির জন্মদিনও না।
-আজ টুকটুকিকে কিছু বলা যাবে না। আমি আছি ওর সঙ্গে সারাদিন। এরপর সানোয়ার সাহেবকে ডেকে বললাম, -ভাই, ভাবিকে কিন্তু কিছু বলা যাবে না। না আপনি বা আপনার মা। উনার সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করবেন।
আমার কথায় কি বুঝলেন জানিনা। উনি ভিতরে চলে গেলেন। আমি গেলাম টুকটুকির ঘরে। ওর বিছানার পাশে বসে গল্প করতে লাগলাম। মেয়েটার চোখে মুখে আনন্দেও ঝলকানি। যেন ওর কোনো অসুখই হয়নি। ও আমকে যত রাজ্যের বই, খেলনাপাতি আর নিজের আঁকা ছবি দেখাতে শুরু করলো। কে বলবে একটু আগেই মেয়েটা হাসপাতাল থেকে এসেছে। একটু পর স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে এসে হাজির। কথা বললেন টুকটুকির মা-ই।
-ভাই, দুপুরে কিন্তু না খেয়ে যাওয়া চলবে না। আমি রান্না বসিয়েছি। আর দুপুর তো হয়েই গেছে। ডাল ভাত চারটা খেয়ে যাবেন।
-ভাবি, আপনি না বললেও আমি খেয়েই যেতাম। সকাল থেকে যেভাবে জোঁকের মতো সানোয়ার সাহেবের সঙ্গে লেগে রয়েছি। আপনার রান্না খাওয়ার জন্যই তো।
-ভাই, আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। আপনি আমার জন্য যা করেছেন, সারা জীবনেও এই ঋণ শোধ করতে পারবো না।
আমি জানি এরপর সানোয়ার সাহেব বাজারে যাবেন। মেয়েরা যাকে পছন্দ করে তাকে কলিজাটা খুলে দিতে চায়। আজ আমি তার মেয়ের জন্য এত কিছু করেছি সে কি আর ফ্রিজের মুরগী বের করে খাওয়াতে পারবে? বাজার থেকে তাজা মুরগী কিনে আনাবেন। আর মুরগী না কিনলেও শশা, লেবু এসব হাবিজাবি তো আনাবেনই। যা ভেবেছিলাম তা-ই। একটু পর সানোয়ার সাহেব এসে হাজির।
-কিছু মনে করবেন না ভাই, আমাকে একটু নিচে যেতে হবে। আর টুকটুকি আঙ্কেলকে বেশি বিরক্ত কইরো না। ওনারে রেস্ট নিতে দাও।
-আরে ও আমকে বিরক্ত করছি নাকি, বিরক্ত তো করছি আমি। তবে এতে টুকটুকির কোনো ক্ষতি হবে না। বরং জ্বর মাগো বাবাগো বলে পালাবে। টুকটুকি আমার কথা শুনে খিলখিল কওে হাসে। আর ওর ফোঁকলা দাঁতগুলো বেরিয়ে আসে।
-আমি তোমার দাঁত দেখে ফেলেছি। লজ্জা পেয়ে দ্রুত দু হাতে মুখ ডাাকে মেয়েটা।
-তোমার কয়টা দাঁত পড়েছে টুকটুকি?
-মাত্র তিনটা।
-ওই দাঁত তিনটা ইঁদুরের গর্তে ফেলেছিলো তো। নইলে কিন্তু তোমার দাঁত আঁকাবাঁকা হবে।
এ কথা শুনে মেয়ে তো চিন্তায় অস্থির।
-আঙ্কেল আমি তো ইঁদুরের গর্ত চিনিনা। আমার দাঁতগুলো কি খুব বিশ্রী হবে।
-আরে না, আমি তো ইঁদুরদের বলে দেব। ওরা এসে যাতে তোমার দাঁতগুলো খুঁজে নিয়ে যায়।
কিছুটা অবাক হলেও সে আমার কথায় বিশ্বাস করে। ওর চোখে আমি তো এখন মহামানবের পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। আমি এখন যা বলি তাই বিশ্বাস করবে। শুধু ও কেন, ওর বাবা-মায়েরও তো একই অবস্থা। কিন্তু আমাকে যে এখন পালাতে হবে। আমি টুকটুকির খাতায় দ্রুত কলম চালাই।
-টুকটুকি, অনেক গল্প হয়েছে। তুমি এখন একটু বিশ্রাম নাও। আমি ড্রইংরুমে আছি। আর এই চিঠিটা তোমার খাতার ভিতর থাকলো। বাবা ফিরলে দিও। তোমার বুক সেলফে একটা বক্স রেখে যাচ্ছি, সেটাও দিন, ক্যামন।
টুকটুকি লক্ষ্মী মেয়ের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ে। আমি ওর গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে আস্তে করে দরজাটা ভিড়িয়ে বেরিয়ে আসি।

সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমার চোখ ভিজে আসতে থাকে। প্রতিবারই আমার এমন হয়, যখন কারো কাছ থেকে এভাবে পালিয়ে আসতে থাকি। তখন অল্প সময়ের সম্পর্কটার জন্য খুব মায়া হয় আমার। সেই মায়ার সীমানা বাড়াতে চাই না বলেই টুক করে বেরিয়ে আসি, আবার হয়ে যাই অজানা মানুষ। জানি টুকটুকির বাবা সানোয়ার সাহেব বাজার থেকে এসে আমার খোঁজ করবেন। আমি নাই দেখে হয়তো রাস্তায় বেরিয়ে আসবেন, কিছুক্ষণ খুঁজবেন। তারপর আস্তে আস্তে ঘরে ফিরে যাবেন। টুকটুকির মা বিষণ্ণ মনে টেবিল সাজাবেন। হয়তো মনের অজান্তে দু এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলবেন। কারণ মেয়েদের মন তো মোমের মতো, সামান্য আবেগের তাপেই গলতে শুরু করে। টুকটুকিও কি আমার জন্য কষ্ট পাবে! ওরা সবাই মিলে আমার সম্পর্কে আজেবাজে কিছু ভাববে কি! ভাবুক, তাতে কি যায় আসে, আর কোনওদিন তো ওদের সাথে আমার দেখাই হচ্ছে না। আমি তো জানি এভাবে চোরের মতো পালিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না।  কিন্তু আমার তো কিছু করারও নেই। আমার নিয়তিই যে এমন।

আজ আমার মেয়ে লোপার জন্মদিন, একই সঙ্গে মৃত্যুদিনও। শুধু ওর না, ওর মায়েরও। মেয়েটা বেঁচে থাকলে তের বছরে পড়তো। কী সুন্দর সাজানো গোছানো একটা পরিবার ছিল আমার। কিন্তু নিজের অহং আর খামখেয়ালিপনায় চোখের নিমিষে সব শেষ হয়ে গেছে। না, আমিই সেটা ধ্বংস করেছি নিজের হাতে। সেদিন যদি লোপার মায়ের কথা বিশ্বাস করতাম, ওদের যদি এভাবে চলে যেতে না দিতাম! আমার মেয়েটা তো আমাকে ছেড়ে যেতে চায়নি। বারবার বলছিলো- ‘বাবা, তুমিও চল না আমাদের সাথে। আমরা একসাথে নানু বাড়িতে বেড়াতে যাব। খুব মজা হবে।’ও আমার আঙ্গুল ধরে টানতে টানতে বলছিলো এসব কথা। আর আমি তখন কি করেছিলাম জানেন? নিষ্ঠুরভাবে ওর কচি আঙ্গুলগুলো ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম। কারণ আমার ভিতরে তো তখন বাবার সামান্যতম মমতা অবশিষ্ট ছিল না, আমি তখন কেবলই এক সন্দেহপরায়ন দানব স্বামী। যে তার স্ত্রীর ওপর কঠিন প্রতিশোধ নিয়ার জন্য মনে মনে কঠিন কোনও ফন্দি আাঁটার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। লোপার হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো  ওর মা। যেতে যেতে পুতুল মেয়েটা তখনও তার বাবার দিকে তাকিয়েছিলো সজল চোখে। ওর চোখ দুটি দিয়ে ঝড়ে পড়ছিলো কাকুতি- ‘বাবা চল না, আমাদের সাথে। বাবা চল। বাবা চল’। আমি ওর চোখের ভাষা বুঝতে পারার পরও একগুয়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওকে এড়াতে কেবল নিজের মুখটা দরজা থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম জানালার কাছে। আমার ড্রইংরুমের জানালা দিয়ে তো বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। কেবল খয়েরি পর্দাটা দুলছিলো অস্থিরভাবে। বাইরে কি তখন ঝড় হচ্ছিলো, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো নাকি বৃষ্টি পড়ছিলো মুষলধারে? আমি তা জানার চেষ্টা করিনি।  কেবল ঠায় দাঁড়িয়েই ছিলাম ঘরের মধ্যখানে এবং এরপর থেকে দাঁড়িয়েই আছি। জানি, আর কখনও দু দণ্ড জিরিয়ে নেবার মতো মানসিক প্রশান্তি হবে না আমার। আমি যে এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই আমার মেয়েটার সেই মায়াবি চোখের কাতর দৃষ্টি। যা আমাকে শোক তাপ আর অনুশোচনায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দেয়। বছরের এই বিশেষ দিনটাতে আমি ঘরে থাকতে পারি না। সাত সকালে বেরিয়ে আসি। এরপর একজন বিধ্বস্ত আর দুঃখী মানুষকে খুঁজে বের করি। তার কিছুটা দুখের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেই। এরপর চোরের মতো পালিয়ে আসি, যেভাবে আজ টুকটুকিদের কাছ থেকে পালিয়ে এলাম। বলতে পারেন এটাই আমার প্রায়শ্চিত। এভাবে আমি নিজের অপরাধ হালকা করার চেষ্টা করি। যত দিন এই পৃথিবীতে বেঁচে আছি ততদিন এভাবেই প্রায়শ্চিত করে যাব। একজন হতভাগ্য বাবার এটাই শাস্তি। আর এই শাস্তি আমি নিজেই দিয়েছি নিজেকে।

মাহমুদা আকতার: লেখক ও সাংবাদিক

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/