শুভ জন্মদিন জনপ্রিয় গোয়েন্দা লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত

জনপ্রিয় লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত

সাম্প্রতিক সময়ে গোয়েন্দা বা রহস্য গল্পের কদর বেড়েছে আমাদের দেশে। পাঠকের বিপুল আগ্রহের কারণে অনেক সাহিত্যিকই আজকাল রহস্য উপন্যাস লিখছেন। বিদেশি ভাষা থেকে এ ধরনের সাহিত্য অনুবাদও হচ্ছে বিস্তর। কিন্তু বহু বছর আগে গোয়েন্দা কাহিনী লিখে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন আমাদের পদ্মাপাড়ের বাঙালি লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত। আজ ৬ জুন, জনপ্রিয় এই উপন্যাসিকের জন্মদিন।

বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটী রায়ের স্রষ্টা হিসেবে উপমহাদেশে স্মরণীয় হয়ে আছেন এই লেখক। তার উপন্যাস অবলম্বনে ভারত ও বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে বহু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

প্রাথমিক ও কর্মজীবন
নীহাররঞ্জন গুপ্তের জন্ম ১৯১১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইটনা গ্রামে। তার পরিবার ছিল বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয়। তার বাবা সত্যরঞ্জন গুপ্ত এবং মায়ের নাম লবঙ্গলতা দেবী। বাবার বদলির চাকুরির কারণে একাধিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এই লেখক। লেখাপড়া করার জন্য মাত্র ১৪ বছর বয়সেই কলকাতায় পাড়ি জমান নীহাররঞ্জন। ১৯৩০ সালে কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে আই.এসসি পাস করেন। পরবর্তীতে  ডাক্তারি পাস করেন কলকাতায় কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে। পরে লন্ডন থেকে চর্মরোগ বিষয়ে অর্জন করেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। যুক্তরাজ্য থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর দেশে ফিরে যোগ দেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নীহাররঞ্জন গুপ্ত। পরে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। সেনাবাহিনীতে থাকার সময় চট্টগ্রাম, মিয়ানমার থেকে মিশর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন রণাঙ্গনে ঘুরে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এই লেখক। তার এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে সমৃদ্ধ করেছে তার লেখালেখিকে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর সপরিবারে কলকাতায় স্থায়ী হন লেখক।

লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত
শৈশব থেকেই লেখক হবার স্বপ্ন দেখতেন নীহাররঞ্জন। আর লেখালেখির শুরু করেন অল্প বয়সেই। লেখক হওয়ার ব্যাপারে তাকে সবসময় উৎসাহ দিতেন মা লবঙ্গলতা দেবী। কলকাতায় আসার সময় তিনি ছেলেকে ডাক্তারি পড়ার পাশাপাশি লেখা চোলিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। তিনি নাকি বলেন, ‘খোকা, ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছিস যা, তবে লেখা ছাড়িস না।’

আইএসসি পড়ার কলকাতার ছোটদের ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। ওই গল্পের জন্য সেসময় পাঁচ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন তরুণ লেখক, যা তাকে উপন্যাস রচনায় আগ্রহী করে তুলে। পরবর্তীতে ওই পত্রিকাতেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তারপ্রথম উপন্যাস ‘রাজকুমার’। তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর। পরবর্তীতে বিলেতে পড়তে গেলে তার লেখালেখিতে সাময়িক ছেদ পড়ে।

লেখালেখির শুরু থেকেই গোয়েন্দা গল্প লেখার দিকে ঝোঁক ছিল। প্রিয় লেখক ছিলেন বিখ্যাতগোয়েন্দা লেখক আগাথা ক্রিস্টি। যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সময় প্রিয় লেখকের সঙ্গে সরাসরি দেখাও করেন তিনি। পরবর্তীতে ভারতে ফিরে এসে প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস ‘কালোভ্রমর’রচনা করেন নীহাররঞ্জন গুপ্ত। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই গোয়েন্দা চরিত্র হিসেবে কিরীটী রায়কে সংযোজন করেন যা বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে এক অনবদ্য সৃষ্টি। তার সৃষ্ট গোয়েন্দা উপন্যাস ও  চরিত্র কিরীটী রায় ব্যপক জনপ্রিয়তা পায় বাঙালি পাঠকমহলে। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কাহিনী রচনায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত। তার উপন্যাস হাতে নিলে শেষ না করে উঠা মুশকিল।

রহস্য উপন্যাসের পাশপাশি বেশ কিছু আবেগঘন সামাজিক উপন্যাস রচনা করেছেন এই লেখক। তার রচিত উপন্যাসের সংখ্যা দুই শতাধিক  এগুলো কালোভ্রম, মৃত্যুবাণ, কালনাগ, উল্কা, উত্তরফাল্গুনী, হাসপাতাল, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, লালুভুলু, রাতের রজনীগন্ধা, কিরীটী অমনিবাস,অপারেশন, রাতের রজনীগন্ধা, তোমাকে নমস্কার, ‘ছিন্নপত্র’, ‘কালোহাত’, ‘বাদশা’, ‘নূপুর’ ‘অস্থি ভাগীরথী তীরে’, ‘কন্যাকুমারী’, ‘সূর্য তপস্যা’, ‘মায়ামৃগ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তার লেখা বিভিন্ন উপন্যাস অবলম্বনে বহু টালিগঞ্জ ও বলিউডে বহু ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এ পর্যন্ত তার প্রায় পঁয়তাল্লিশটি উপন্যাসকে  চলচ্চিত্রে রূপ দেয়া হয়েছে। লেখালেখির পাশপাশি শিশুতোষ সাহিত্য পত্রিকা সবুজ সাহিত্যের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

বাংলাদেশ ও নীহাররঞ্জন গুপ্ত
কলকাতায় বসবাস করলেও জন্মস্থান বাংলাদেশের প্রতি ছিলো তার নাড়ির টান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতেন। শ্রদ্ধা করতেন বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার আদর্শকে। পছন্দ ছিলো নানা ধরনের বাংলাদেশি খাবার, বিশেষ করে সর্ষে ইলিশ।

নীহাররঞ্জন গুপ্তআশির দশকের গোড়ার দিকে সপরিবারে বাংলাদেশে আসেন একবার। তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা তার সঙ্গে দেখা করেন। এ সম্পর্কে তার মেয়ে আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেয়া এক স্মৃতিকথায় বলেন, ‘আমরা গেলাম বাংলাদেশ। এর কিছু কাল আগে মারা গিয়েছেন মুজিবর। দেখতাম বাবা যেখানেই যাচ্ছেন, মুজিবরের স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন। একদিন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা বাবার কাছে এলেন …। কথায় কথায় হাসিনা গভীর শোকের সঙ্গে দেখালেন, ঠিক কোথায় বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা হয়। আমি দেখলাম, হাসিনার মুখে তাঁর পিতৃহত্যার নৃশংস কাহিনি শুনতে শুনতে বাবার দু’চোখের কোণ চিকচিক করে উঠছে বাধ-না-মানা জলে। বিড়বিড় করে বাবাকে আওড়াতে শুনলাম, ‘‘জয় বাংলা।’’। আদ্যন্ত বাঙালি এই মানুষটিই কিন্তু আমার বাবা। লোকে যাঁকে শুধুই কিরীটী-জনক বলে চেনে! (কিরীটী-জনক নীহাররঞ্জন গুপ্ত সম্পর্কে কিছু জানা অজানা কথা,আনন্দবাজার পত্রিকা, প্রকাশকাল-০৬ মে ২০১৭)

নীহাররঞ্জন গুপ্তের পরিবার ইটনা ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমালেও তার পৈত্রিক ভিটায় দোতলা বাড়ি, পুকুর ও নানা গাছপালা এখনও বিদ্যমান। এই বাড়ির নাম ছিল ‘‌আনন্দ অন্নদা কুটির’‌। নড়াইলের এই বাড়িতেই ১৯৮৮ সালে শিশুস্বর্গ-২ প্রতিষ্ঠা করেন আমাদের বিখ্যাত চিত্রকর এস এম সুলতান। ২৪ নভেম্বর, ১৯৯৩ সালে নড়াইলের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলী হোসেন এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ২০০৩ সালেনীহাররঞ্জন গুপ্তের বাসভবন অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগী  প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এবং ২০১৭ সালে এটি সংস্কার করা হয়েছে।

এলাকার কিছু সাহিত্যপ্রেমী মানুষ প্রতি বছর  নীহাররঞ্জন গুপ্তের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে থাকেন। যদিও করোনা কারণে গত বছর থেকে বন্ধ রয়েছে এই উদযাপন।

পারিবারিক জীবন
নীহাররঞ্জনের স্ত্রীর নাম কনক। তাদের চার মেয়ে। নিজেরই এক উপন্যাসের নামে বাসভবনের নাম রাখেন উল্কা। কলকাতার শ্যামবাজার স্ট্রিটের (পরে ধর্মতলা স্ট্রিটে) ছিলো তার চেম্বার। লেখালেখি ও রুগী দেখার বাইরে পোষা প্রাণীর যত্ন নেওয়া বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন এই লেখক। তার লেখালেখি সময় ছিল দুপুরবেলা।

১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নীহার রঞ্জন গুপ্ত।

আজ তার ১১১তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন প্রিয় লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত। আমরা আপনার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/