আবু সাইদ কামালের গল্প ‘ঈদের রাতে নীরব জংশনে’

Abu shayed Kamal

ঈদের রাতে নীরব জংশনে
জংশনে একটি ট্রেনও নেই। ঈদ-উল-আজহার রাত। অনুমান ন’টা বাজে। রেল ইঞ্জিনের পিলে চমকানো চিৎকার নেই। নীরব জংশন। অন্য রাতে এসময়ে বিভিন্ন প্লাটফর্মের কোনো না কোনো লাইনে ট্রেনের বগি প্লেসমেন্ট করার জন্য একটা ইঞ্জিন ছোটাছুটি করে। ঈদের রাত বলে সে ইঞ্জিনটাও অবসর নিয়েছে। হাসানের একান্ত ইচ্ছা ঈদের রাতে রেল-জংশন বা স্টেশনটা ঘুরে-ফিরে দেখেবে। এমন একটা ইচ্ছা নিয়ে ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুসহ স্টেশনের এক নম্বর গেট দিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্মে ঢুকে। এক নম্বর লাইনের পুবপাশে তখন ইঞ্জিনবিহীন কিছু বগি স্বামী পরিত্যক্তা নারীর মতো অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে। হাসান তার বন্ধুকে নিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্ম থেকে হেঁটে হেঁটে দু’নম্বর প্লাটফর্মে যায়। দু’নম্বর প্লাটফর্ম ধরে হেঁটে কিছুটা পুবদিকে এগোলে একটা বিশ্রি ধোঁয়ার দুর্গন্ধে নাক কুঁচকে আসে। ধোঁয়ার উৎসের দিকে তাকায় হাসান। দেখতে পায় ধোঁয়ার ভিতর জবুথবু এক বৃদ্ধা রিকশা কিংবা সাইকেলের টায়ারের টুকরো জ্বালিয়ে মাটির একটা ছোট্ট হাঁড়িতে রান্না করছে। রান্না বলতে মানুষের বাসা-বাড়ি থেকে ভিক্ষা করে আনা কোরবানির গোশত এবং চাল একসাথে সেদ্ধ করা। ছোট ছোট দুটি চটের বস্তায় বন্দি তার সংসার। বস্তা দু’টি প্রায় সবসময় বাঁধা আবস্থাতেই থাকে। বলা তো যায় না-কখন বেরসিক পুলিশ লাঠি হাতে নিয়ে তাড়াতে আসে। পুলিশের তাড়া খেয়ে মাছে-মধ্যেই ছোট দু’টি বস্তায় মোড়ানো তার সংসার নিয়ে ছুটতে হয় কোনো নিরাপদ স্থানে। নিরাপদ স্থান বলতে দু’নম্বর প্লাটফর্ম ছেড়ে পাঁচ বা ছ’নম্বর প্লাটফর্মের কোনো এক নোংরা প্রান্তে। কিংবা ঠাঁই নেয় হয়তো বা কোনো ভাঙা ওয়াগনে। টর্নেডোর মতো ছুটে আসা পুলিশের রাগ পড়ে এলে কিংবা পুলিশ চলে গেলে ওরা আবার আগের স্থানে ফিরে যায়।
হাসান বেশ আগ্রহী হয়ে ঐ বৃদ্ধাকে দেখে। জীবন নদীর শেষ প্রান্তে এসে বৃদ্ধার ঠাঁই হলো রেলস্টেশনের খোলা প্লাটফর্মে। কে জানে, তার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি’র মতো কোনো নিকটাত্মীয় পৃথিবীতে বেঁচে আছে কিনা। থাকলে কি আর ঈদ-পরবের দিনে এমন অসহায়ভাবে স্টেশনে রাত কাটাতো! হয়তো বা এ বৃদ্ধার কোনো পিছুটান নেই। এ জন্যই বোধ হয় শেষ অধ্যায়ে অলৌকিক ট্রেনের অপেক্ষায় স্টেশনে তার এমনি করুণ জীবনযাপন। এসব ভাবতে ভাবতে একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে হাসান সামনে হাঁটে। সাথী বন্ধুটি তাকে অনুসরণ করে। দু’নম্বর প্লাটফর্মের পশ্চিমপ্রান্তে কী যেনো কোপাকুপির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হাসান বন্ধুসহ সেদিকে এগোয়।
বেশ দূরে দূরে স্টেশনের ছাদে যে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে, তা বিস্তৃত স্টেশনের অন্ধকার তাড়ানোর জন্য যথেষ্ঠ নয়। তাই আলো-আঁধারির দোলাচলে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে দু’বন্ধু। প্লাটফর্মের পশ্চিমপ্রান্তে যেখানে ছাদে ¤্রয়িমান আলো জ্বলে তার নিচে বৃত্তাকারে বসে আছে কিছু যাত্রী। মাংস কুটার দা কিংবা কুড়াল, চাপাতি দিয়ে ওদের কেউ কোপাচ্ছে কোরবানি পশুর পা কিংবা পরিত্যক্ত হাড়। ওরা দূরের গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। শহরবাসির কোরবানির পশুর মাংস কাটার জন্য কিছু লোকের প্রয়োজন হয়। শহরে যে হারে কোরবানি হয়, সে হারে মাংস কাটার লোক থাকে না। সে জন্যই শহরে মাংস কাটার মতো দক্ষ লোকের বেশ চাহিদা। কোরবানির ঈদের দিন ওরা গ্রাম থেকে এসে মাংস কেটে নগদ অর্থ এবং দুস্থ মানুষ হিসাবে মাংসের ভাগ দুই-ই পায়। কতটুকু হত দরিদ্র হলে গ্রামের বাড়ির পারিবারিক পরিবেশে ঈদের আনন্দ ভুলে ওরা শহরে চলে আসে, একটু ভাবলে সহজেই তা অনুমান করা যায়।
ঈদ এদের কাছে বাড়তি কোনো আনন্দ নিয়ে আসে না। এরা গ্রামীণ সমাজের সাধারণ মানুষের মূল স্রোতের প্রতিনিধিত্ব করে না। এরা ভিন্ন স্রোতের  মানুষ। এ শ্রেণির পুরুষ মানুষ ঈদের দিন শহরে এসে টাকার বিনিময়ে কোরবানির পশুর ছামড়া ছাড়িয়ে মাংস কেটে দেয়। বোনাস হিসাবে পশুর হাঁটুর নিচে পাসহ অন্যান্য পরিত্যক্ত হাড়-মাংস নিয়ে আসে। সংগ্রহকৃত ওসব হাড় মাংসগুলোই কাঠ-খণ্ডের ওপর রেখে ক্রমাগত কুপিয়ে যাচ্ছে ওরা। হাড়-মাংস কাটার এসব যন্ত্রপাতি ও কাঠখণ্ড ওরা বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছে। ওদের প্রতিজনের সাথে একটি করে প্লাস্টিকের কিংবা চটের থলে ভরা ওসব হাড়-মাংস। আবার কিছু কিছু পুরুষ ভিক্ষুক শহরের বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাংস ভিক্ষা করে এনেছে। রাতের ট্রেনেই ওরা বাড়ি ফিরবে। হাসান তার সাথী বন্ধুকে নিয়ে ক্রমশ পশ্চিম দিকে এগোয়। যতই ওরা সামনে যায়, ততই দেখতে পায় হতদরিদ্র শ্রেণির মেয়ে মানুষের ভীড়। ওরাও শহর থেকে মাংস ভিক্ষা করে থলে ভরেছে। রাতের ট্রেনের অপেক্ষায় ওরা দুই নম্বর প্লাটফর্মের পশ্চিমাংশ জুড়ে বসে আছে। ট্রেন আসবে গভীর রাতে।
পাশপাশি বসে ওরা গল্প করছে। নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্পে বিভোর হয়ে করছে হাসাহাসিও। ঈদের রাতে নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে আসা এসব গরীব ও অসহায় মানুষের মুখে এমন অকৃত্রিম হাসি দেখে বিস্মিত হয় হাসান। মনে মনে বলে, ওরা আসলে অন্য জগতের মানুষ। ঈদের আনন্দের আবহে গ্রাম কিংবা শহরের মানুষ একে অন্য স্বজনের বাড়িতে গিয়ে দাওয়াতে যাচ্ছে, উৎসবে মেতে উঠছে। উৎকৃষ্টমানের খাবার খেয়ে যখন উদরপূর্তি করছে, তখন এসব মানুষ আছে ট্রেনের অপেক্ষায়। ওরা তাদের সমস্ত গ্লানি ভুলে হাসি-ঠাট্টায় বিভোর হচ্ছে। ঈদের স্বাভাবিক আনন্দ তাদের সাথে প্রহসন করে চলে যায়, এতে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অথচ শহরের প্রাচীর ঘেরা সুরম্য প্রাসাদে বাস করা অনেক মানুষের মুখেও এমন প্রাণোচ্ছ্বল হাসি খুঁজে পাওয়া দায়। শহরের এসব লোকদের কারো হয়তো বা ছেলে-মেয়ে থাকে বিদেশে। ঈদে বাড়ি ফিরতে পারেনি। এ জন্য মা-বাবার মনে সুখ নেই। কোনো পরিবারে হয়তো নিকটাত্মীয়ের ঘটে গেছে কোনো বিয়োগান্ত ঘটনা। কিংবা তাদের মাঝে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর বিভেদ-বঞ্চনাজাত অশান্তি। এমন কতো রকম সমস্যা মানুষের মন গুমোট করে রাখে!
হাসান ওসব ভাবে আর মনে মনে বলে, সে তুলনায় তো প্লাফর্মের এসব মানুষই অনেক সুখি। এসব ভাবতে ভাবতে বন্ধুকে নিয়ে হাসান প্লাটফর্মের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে ডানপাশে মোড় নিয়ে ফের পুবদিকে হাঁটতে থাকে। হাতের বামপাশে প্লাটফর্মের মেঝেতে কোথাও ছেঁড়া নোংরা কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে আছে ছিন্নমূল কিছু মানুষ। ওদের মাঝে একটা শ্যামলা যুবতী মেয়ে হাসানের দৃষ্টি কাড়ে। মাথার ঘনকালো চুলে লাল ফিতায় বেঁধেছে খোপা। সস্তা প্রসাধনী মেখে উগ্র সাজে সেজে আছে নিশিকন্যা। তার পাশেই কাঁথার বিছানায় শুয়ে আছে একটি শিশু। হাসান বন্ধুকে নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার পাশ ঘেঁষে হেঁটে চলে যায়। মেয়েটা তখন উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর একটু সামনে দু’কদম হেঁটে গিয়ে পানের পিক ফেলে। তারপর ফের নিজের বিছানায় এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা হঠাৎ মুখ বাঁকিয়ে কেমন যেনো অন্তর্গত যন্ত্রণা প্রকাশ করে। এসময় সাথী বন্ধুটি বলে, জানো! ও হলো একজন বিনোদনকর্মী।
-তাই!
-হ্যাঁ। দেখতেছো না কেমন ভঙ্গিমায় দাঁড়াইছে।
-আমার তো মনে হয় পুরুষ আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ ভঙ্গিমায় দাঁড়ানোর কৌশল এটা না। তার শারীরিক কষ্ট লাঘবের একটা প্রয়াসও তো হতে পারে।
-মানে?
-মানে খুব সহজ। মেয়েটির তল পেটের দিকে তাকিয়ে দেখো। মনে হয় গর্ভে ছয়-সাত মাসের সন্তান। অনাগত সন্তানটি মনে হয় পেটে যন্ত্রণা দিয়ে থাকতে পারে।
-তাই তো। আমি তো এমন করে ভাবি নাই।
-দেখো, আমরা মানে তথাকথিত পুরুষদের কেউ কেউ অনেক সময় সমাজ চোখের আড়ালে যৌনকর্মে লিপ্ত হয়ে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য নারীদেহে উদগত হই। উল্লাসে যৌনকর্মটি সম্পন্ন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়ি। অথচ শ্রাবণধারায় সিক্ত যে উর্বর ভূমিতে চাষাবাদ করে বীজ বুনে গেলাম, সে জমিতে উপ্ত বীজ প্রাকৃতিক নিয়মে অঙ্কুরিত হবে, ফসল জন্মাবে- এটাই স্বাভাবিক। বিনাদন কর্মীটি অনেক সময় অপারগ হয়ে সেই অঙ্কুরিত ফসলের অনাকাক্সিক্ষত যন্ত্রণা লালন করতে বাধ্য হয়। বলতে পারো, এ যুগে তো জন্ম নিরোধের অনেক উপায় রয়েছে, তাহলে এসব বিনোদনকর্মী ওসব নিচ্ছে না কেনো?
-হ্যাঁ, যদি তাই বলি!
-এর জবাব হলো-ওরা এতটাই হতদরিদ্র এবং অসহায় যে, ওসব জন্মনিরোধক উপকরণ সংগ্রহ করার সামান্য টাকা পর্যন্ত ওদের হাতে থাকে না। আর অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ হয়ে গেলে, গর্ভপাত ঘটানোর মতো মোটা টাকাও ওদের হাতে থাকবে না-এটাই স্বাভাবিক। তাই ছিন্নমূল এসব বিনোদন কর্মীর ঘনঘন সন্তান জন্ম দেওয়ার এটাও একটা বড় কারণ।
-তাই।
-হ্যাঁ। ঠিক যেনো বারোয়ারি কুকুরের মতো। প্রসবের পর কুকুরের বাচ্চাগুলো যেমন অনাদরে বেড়ে উঠে, তেমনি স্টেশনের ছিন্নমূল বিনোদনকর্মীদের সন্তানের অবস্থা। ঈদের রাতে মেয়েটির ব্যক্তিগত কোনো আনন্দ-উল্লাস হয়তো বা নেই। বরং এ রাতে বাড়তি আয়ের উপায় খোঁজার প্রয়াস। পেটের বাচ্চার যন্ত্রণা নিয়েই খদ্দেরের আশায় আছে। গভীর রাতের জন্য অপেক্ষা করছে। গভীর রাতের পরিবেশ নির্জন না হলে কিংবা স্বল্প দূরে পরিত্যক্ত ওয়াগনগুলোর চারপাশে অন্ধকার একটু ঘনীভূত না হলে ছদ্মবেশী পুরুষগুলো বিনোদনকর্মীর কাছে ঘেঁষতে স্বচ্ছন্দবোধ করে না।
হাসান একটানা বলে যায়। কিন্তু সাথী বন্ধু সাড়া দেয় না। তাতে হাসান বুঝতে পারে সাথী বন্ধুটি তার এসব কথা শুনতে আগ্রহবোধ করছে না। তাই সেই এ প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। ওরা দু’নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ক্রমে তিন নম্বর-চার-পাঁচ-ছ’নম্বর প্লাটফর্ম পর্যন্ত হেঁটে যায়।
ঈদের রাতে মানুষ যখন আত্মীয়-স্বজন নিয়ে পারিবারিক পরিবেশে আনন্দ-উল্লাস করছে, হাসানেরা তখন ভিন্ন রকম বৈচিত্রের খোঁজে এসেছে জংশনে । কিন্তু এ রেল-স্টেশনের বিভিন্ন প্লাটফর্মের ছিন্নমূল অধিবাসী কিংবা রাতের ট্রেনের হতদরিদ্র যাত্রীদের রূঢ়বাস্তব অবস্থা দেখে যতটুকু তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে, তারচে বেশি মনোকষ্ট পেয়েছে যুবতী যৌন কর্মীটির করুণ অবস্থা দেখে। মেয়েটিকে দেখার পর হাসান আর বেশিক্ষণ স্টেশনে অবস্থানের আগ্রহ দেখায়নি। আস্তে আস্তে স্টেশন থেকে বের হতে থাকে। স্টেশন ত্যাগ করতে করতেই অন্যমনস্ক হয়। কেমন যেনো অকথ্য বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়। সাথী বন্ধুটি হাসানের মনের আবস্থা আঁচ করে বলে, কী ব্যাপার! হঠাৎ এমন চুপসে গেলে যে হাসান ভাই?
-রাত বাড়তেছে তো। বাসায় চলে যাবো।
-ও আচ্ছা।
তারপর বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নেয় হাসান। রেলস্টেশনের আঙিনা ছাড়তে না ছাড়তেই বিনোদনকর্মী মেয়েটি হাসানকে সুদূর অতীতে নিয়ে যায়। অবচেতনভাবেই সে ঢুকে পড়ে অতীতের হৃদয়স্পর্শী একটি গল্পে।

দুই

প্রায় দুই যুগ আগের কথা। একটি উচ্ছল কিশোরী। হাসানের মামার বাড়ির পাশে মেয়েটি তারা চাচার বাড়িতে থাকতো। মা-বাবা কেউ ছিল না। চাচার আশ্রয়ে থাকতো গ্রামে। মেয়েটির চাচা হাসানের মামার দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাই। তাই হাসান লোকটিকে মামা বলেই ডাকতো। হাসানের মামার বাড়ির আঙিনায় বেণী দুলিয়ে ছুটে বেড়াতো মেয়েটি। হাসান তখন মামার বাড়িতে থেকে উপজেলা সদরের কলেজে পড়ে। মেয়েটি দুপুরে মামার বাড়ির পুকুরে ¯œান করতে আসতো। ছুটির দিনে বৈঠক ঘর থেকে মূলী বাঁশের বেড়ার ফাঁকে হাসান সম্মোহন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো স্নানরত মেয়েটির দিকে। উজ্জ্বল শ্যামলা মেয়েটির গায়ে তখন কাঁচা রং। উঠন্ত-ফুটন্ত মেয়েটি বর্ষার পাহাড়ি নদীর মতোই যেনো দিন দিন উছলে উঠছে। তার ঐ কৈশোর সুলভ চপলতা হাসানকে যেনো অদৃশ্য এক সূতোয় বেঁধে ক্রমাগত তার দিকে টেনে নিচ্ছিল। মেয়েটি যদি পড়ালেখা করতো, তাহলে হাসান হয়তো বা সত্যি সত্যিই তার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতো। সাড়া দিতো অদৃশ্য সেই সূতোর টানে। উভয়ের সামাজিক অসঙ্গতির কারণেই হয়তোবা হাসান তার অবস্থানে অনঢ় থেকেছে। তবু মেয়েটির বয়সানুগ সৌন্দর্য কিংবা তার বিকাশোন্মুখ দৈহিক উচ্চারণের আকর্ষণে বেড়ার ফাঁকে চোরা চাহনিতে হাসান তাকিয়ে থেকেছে অনেকদিন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে যৌন আকর্ষণে বিদ্যুৎ তাড়িতও হয়েছে। আহা! দৃশ্যগুলো দেখে কী অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হতো তার মাঝে। সেসব সম্মোহন দৃশ্য দেখে কতবার দৃশ্যকল্পে বিভোর হয়েছে হাসান। কিন্তু মেয়েটির স্বাভাবিক উচ্ছলতা মাঝে মাঝে ম্লান হয়ে যেতো তার চাচির নিপীড়মূলক আচরণে। পাশের বাড়ি থেকে কখনো তার কান্নার সুর ভেসে আসতো। হাসান তখন জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছে চাচির শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনে অসহায় হালিমা কাঁদছে।

হালিমার বাবা ছিল কৃষি শ্রমিক। ভাটি এলাকায় বোরো ধান কাটতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা যায় তার বাবা। কিছুদিন পরে মা দু’টি কন্যা সন্তান রেখে অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে যায়। ফের পাতে সংসার। অনন্যোপায় হয়ে হালিমা এবং তার ছোটবোন খুদেজা প্রান্তিক চাষী চাচার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বিকাশমান হালিমাকে কৈশোরোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে দেয় উপজেলা সদরের এ নির্মাণ শ্রমিকের কাছে। স্বামীর ঘরে তিন বছরের মাথায় এক ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। স্বামী-সন্তানকে ঘিরে গড়ে তুলে স্বপ্নের ভুবন। ছেলের বয়স যখন দু’বছর তখন তার স্বামী ঢাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছিল। হালিমার স্বপ্নের ভুবনের অধীশ্বর স্বামীটি সেখানে কক্ষচ্যুত হয়ে ভিন্নগ্রহের মোহে পড়ে। তার স্বপ্নের সংসার ভেঙে চুরমার করে দিয়ে স্বামী নামের খল চরিত্রের লোকটি সেখানে আর একটি বিয়ে করে ফেলে। হালিমা ঐ সংবাদ জানার আগেই স্বামী বাড়ি এসে দাম্পত্যকলহ বাঁধায়। এক রাতে মেথর পট্টি থেকে মাদকাসক্ত হয়ে বাড়ি এসে স্ত্রীকে বধেড়ক মারধোর করে। ঐ রাতেই এক ছুতোয় হালিমাকে তালাক দেয়। হালিমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তালাক দিয়েই স্বামীটি ক্ষান্ত থাকেনি। ফুলের মতো পবিত্র স্ত্রী’র চরিত্রের ওপর অপবাদ দেয়। রাতে তালাক দিয়েই স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। বিধ্বস্ত হালিমার দু’চোখে তখন মরা মাছের দৃষ্টি। আত্মখেদে মনে মনে সে বলে, দীর্ঘ পাঁচ-ছয় বছরে তিল তিল কইরা সংসারটা গইড়া তুললাম, আর তা কিনা স্বামী নামের দুরাচার পুরুষটার মাত্র তিনটা কথায় মিসমার অইয়া গেলো?
এই বলে সে কেবল কাঁদে আর কাঁদে। হঠাৎ অথৈ সাগরে পড়ে সে হাবুডুবু খায়। চারদিক থেকে হালিমাকে ঘিরে ধরে ঘন অন্ধকার। কোনোভাবেই নিজেকে প্রবোধ দিতে পারে না। কী থেকে কী যে হয়ে গেলো তা ভেবে কোনো কূল-কিনারা পায় না। ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে স্বামীর আত্মীয়-স্বজদের বাড়িতে প্রথম রাত কাটায়। ওসব আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে বিষয়টা মীমাংসা করার চেষ্টা চালায়। হালিমা ভেবেছে, রাগের মাথায় স্বামী হয়তোবা ঐ তিনটি কথা উচ্চারণ করে ফেলেছে। তাই তার মনের ভুবন থেকে আশার আলো তখনো নিভে যায় যায়নি। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনদের মীমাংসা-প্রচেষ্টায় স্বামী যে জবাব দিয়েছে, তাতে হালিমা শুধু হতাশই হয়নি, হয়েছে বিস্মিতও। স্বামী সুরত আলী বলেছে, যে থু থু মুখ থাইক্যা একবার ফ্যালাইয়া দিছি, তা কি আর মুখে তোলা সম্ভব? তাছাড়া তালাক তো অইয়াই গেছে।
টানা তিন-চারদিন স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে ক্রমাগত মীমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হবার পর হালিমা নিজে মহল্লার মসজিদের ইমামের কাছে যায়। ভাঙা বুকে বেসামাল বিলাপকে কষ্ট করে সামলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে সে ইমাম সাহেবকে ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে ইমাম সাহেব বলে, আমার মতে তালাক হয়ে গেছে।
হালিমা তখন তার প্রত্যাশার শেষ মশাল ধরে বলে, পেটে যদি সন্তান থাকে…?
-তবু তালাক হয়ে গেছে। তবে এ ক্ষেত্রে যতদিন পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব না হবে-ততদিন আপনার স্বামী ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
ইমামের একথা শুনে হালিমা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। সে ভবেছিল, শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলে হয়তোবা স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু ইমামের কথায় হতাশার সাগরে আবার হাবুডুব খেয়ে অসহায়ভাবে কাঁদতেই থাকে।
অবশেষে তার প্রতি সহানুভূতিশীল কিছু মানুষের পরামর্শে সে চেয়ারম্যানের কাছে যায়। উপজেলা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বাড়িতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতো হালিমার স্বামী। সে হিসাবে চোরম্যানের সাথে তার সুসম্পর্ক। তাই চেয়ারম্যান ততদিনে তার ভণ্ড স্বামীর পক্ষাবলম্বন করে। ফলে হালিমাকে পাত্তাই দেয়নি। হালিমা শেষে ইনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে চেয়ারাম্যানকে তার গর্ভধারণের কথা জানায়। এ কথা শুনে ক্ষমতাধর চেয়ারম্যান তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে তড়পাতে তড়পাতে বলে, তোমার স্বামী তো কইছে অন্য কথা।
-কী কতা কইছে হে…?
-কইছে-এই বাচ্ছা নাকি ওর না। অন্য কারে দিয়া পেট বাজাইছো তুমি, হ্যাঁ…!
জবাবে অন্তর্ভেদী দুঃখে হালিমা বলে, হায়-আল্লাহ, তুমি শুইন্যা রাহ আল্লাহ!
এই বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে আসহায়ভাবে ডুকরে কাঁদে হালিমা। চেয়ারম্যানের মুখ থেকে ওসব বিটকেলে কথা আর শোনার রুচি হয়নি। কাল বিলম্ব না করে ফিরে আসে সে। সিদ্ধান্ত নেয় চাচার বাড়ি চলে যাবে। তাই স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের কাছে বিদায় নিতে যায় সে। তখন প্রশ্ন দাঁড়ায় দু’বছরের শিশুসন্তানকে নিয়ে। এ শিশু ছেলে থাকবে কার কাছে?
হালিমাও কি পারবে ছেলেটাকে রেখে যেতে? তাই ছেলেকে সাথে নিয়ে যেতে বলে হালিমা। তাতে স্বামী সহজেই সম্মতি দেয়। তার ভণ্ড স্বামী যেনো এমনটিই চেয়েছিল। নিষ্কণ্টক করতে চেয়েছিল তার ঘর। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধে ছেলের ফুফুরা। শেষে ছেলেটাকে ওরাই রেখে দেয়।

অল্প বয়সে তালাকপ্রাপ্তা হালিমা ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনন্যোপায় হয়ে চাচার বাড়ি উঠে। কিন্তু এক দিকে চাচির খোঁচা দেওয়া সূচালো কথার আঘাত, অন্যদিকে শিশু ছেলেটির অনিরুদ্ধ টানে শেষে পনের দিনের বেশি টিকতে পারেনি চাচার বাড়িতে। আবার চলে যায় সে স্বামীর বাড়ির স্বজনদের বাড়িতে। কিন্তু ততদিনে নরাধম স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রীকে ঘরে তুলে। হালিমা তার স্বামীর এমন অমানবিক আচরণ সহ্য করতে পারেনি। আবার পেটের অনাগত সন্তান এবং দু’বছরের শিশু ছেলের মায়ায় হতে পারেনি আত্মঘাতীও। ইউপি চেয়ারম্যান যেখানে স্বামীর পক্ষ নিয়েছে, সেখানে স্থানীয় পর্যায়ে তো সুবিচার পাবে না। আর কোর্টে যাওযার মতো আর্থিক যোগ্যতাও তার নেই। তাই একদিকে যেমন স্বামীর প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়, অন্যদিকে জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাধ্য হয়ে বেছে নেয় অন্ধকার পথ। বিপথে নেমে সে থানা সদেরর রেল স্টেশনে ছিন্নমূল হিসাবে ঠাঁই নেয়।

অন্যমনস্ক হয়ে হাসান স্মৃতিচারণ করতে করতে স্বগতোক্তি করে বলে, হায়রে মানুষ। কী করে মানুষের প্রতি দায়ামায়া ত্যাগ করে এভাবে এতটা নির্মম হয়। এ অবিচার কি মহান স্রষ্টা কিংবা প্রকৃতি সইবে?

রিকশা ছুটে চলে। ঈদের রাতে ফাঁকা রাস্তা। হাসানের বিষণ্ণ মন থেকে কিছুতেই মেয়েটির ছবি মুছে যায়নি। সে ভাবে, রেল স্টেশনের এই বিনোদন কর্মীটি কি সেই অতীতের হালিমা? নাকি বিপন্ন এই যৌনকর্মীটির মাঝে ঐ চেনা মেয়েটির প্রতিরূপ দেখতে পেয়েছে? রিকশা ছুটছে আর হাসান ভাবছে। ততক্ষণে স্টেশনে ট্রেন আসার শব্দ শোনা যায়। হাসান ভাবে, রেল স্টেশনে কোরবানির মাংস নিয়ে প্রতীক্ষারত গরীব ও অসহায় মানুষগুলো গভীর রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরবে। পরিত্যক্ত স্টেশনে জেগে থাকবে কেবল হালিমার মতো অসহায় নিশিকন্যারা।

লেখক পরিচিতি: কথাসাহিত্যিক আবু সাইদ কামাল (জন্ম  ৫ জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহ জেলায়) লিখছেন প্রায় তিন যুগ ধরে। সত্তর দশকে কবিতা দিয়ে শুরু করলেও লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ নব্বইয়ের দশকে। নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন গল্প, উপন্যাস,  প্রবন্ধ, কবিতা, শিশুতোষ গল্প ও ছড়া। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৩০ টি। সম্পাদনা করছেন ‘পাদদেশ’, ‘ছোটদের সাহিত্য’ ও ‘ছড়াপাতা’ ও ‘বাকবাকুম’ নামে চারটি ছোট কাগজ। এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, একজন নিষ্ঠাবান এবং নিরলস সাহিত্যকর্মী ও সাহিত্যসেবী হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি নিজস্ব স্থান করে নিয়েছেন। এ লেখকের বিশেষ পরিচিতি কথাসাহিত্যিক ও ছড়াকার হিসেবে। গত তিন যুগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিল্পোত্তীর্ণ ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাহিত্যের ম্যাগাজিন ও ছোট কাগজে। বিশেষ করে গারো পাহাড়ের পাদদেশ এলাকার সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী নিয়ে তার ছোট গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ সুধীমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এ ছাড়াও ‘মাতৃকুলভিত্তিক গারো সমাজ’ ও ‘হাজংদের অতীত বর্তমান’নামে প্রকাশিত তার গবেষণাধর্মী দুটি প্রবন্ধগ্রন্থ বেশ তথ্যসমৃদ্ধ।

ওমেন্স নিউজ/