ঈদের বিশেষ প্রবন্ধ: হামলোগকা বাকরিদ

হোমায়রা খাতুন

হোমায়রা হুমা
আমরা ঢাকাইয়ারা কোরবানীর ঈদকে বাকরিদ বলি,আমাদের পূর্বপুরুষদের ডাক আমরা সাদরে লালন-পালনে গৌরবাণ্বিত। এখনো আমরা পরষ্পর এইভাবেই উচ্চস্বরে বলি, 'আজ বাদ কাল বাকরিদ, চালো কোরবানি কে লিয়ে গরু আর বাকরি লেকে আতে।' বাকরি অর্থাৎ ছাগল, আর গরু তো গরুই। সবাই জানেন যে, আমরা ঢাকাইয়ারা এমনিতেই সর্বদিকে এস্পেশিয়াল; চলায়, বলায়, হাঁটায়, খাওয়ায়, স্টাইলে, রান্নায়, রুচিতে, ভদ্রতায়, সাম্যে, মিলনে, দান-খয়রাতে; আমরা ঢাকাইয়ারা অনেক মিলনসার, মানে মিলেমিশে থাকতে, আনন্দ-উৎসবে 'দেল খুশিসে গোলজার' হয়ে পালন করি। এটাই আমাদের ট্রেন্ড, ট্রডিশনাল।এই ট্রেন্ডকে আমরা সমিহ করি। মান্য করি।

ঈদ আর বাকরিদ আমাদের জন্য সমান আনন্দের বাহক। ঢাকাইয়াদের মধ্যে আত্মত্যাগের মহিমাণ্বিত নির্দশন ও আহবান ধর্ম পালনকে করেছে মসৃণ ও তেজোদৃপ্ত । প্রকৃতপক্ষে পুরান ঢাকায় ধর্মপালনের অবিমিশ্র স্রোত সকল স্তর ও শ্রেণীর মানুষের মনকে আবেগকে বিপুলভাবে আন্দলিত করে, যা বৃহৎ ঢাকার সকল আনন্দকে  ম্লান করে দেয়। ইসলামের মূল বার চান্দের খরচ ,শবেমেরাজ,শবেবরাত, রোজা, ঈদ, বাকরিদ, মোহাররম মহিমাণ্বিতরুপ পূর্ণ পালনে সবদিকে এককাঠি সরস জৌলুশপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক, ধারাবাহিক,আস্হা,অনুরাগ, পূর্ণবিশ্বাসী আমরা পুরানো ঢাকার অধিবাসীরা।

ঈদ মানেই ঢাকাইয়ারা রংবেরঙ মার্কেটিংএ এগিয়ে। সম্ভ্রান্ত পরিবার বা ধনী পরিবারগুলো রোজার ঈদের মতই বকরিদেও আনন্দে মশগুল। নতুন জামাকাপড় কেনা,বানানো, স্ট্যাইলে ফ্যাশানে কেউ কারো চেয়ে কম নয়। পরিবারের পুরুষরাও একই রকম। কেনাকাটায় হাতেমতাই।

গরু বা বকরি (ছাগল) কেনার বেলায়ও একই ট্রেন্ড। ধনী পরিবারে বাবা, ব্যবসায়ী ছেলের আলাদা গরু, ছাগলও আসে ছোট বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্য। ফলে একবাড়িতে ২/৩/৪টা গরুরও কেনা হয় বৈকি। সাতজনের নামে কোরবানি করা হয়। এই সাতজনের নাম আগে থেকেই লিখে রাখে হয়। যাতে কোরবানি দেয়ার সময় কারো নাম বাদ না পড়ে। হুজুর,কসাই যেমন নির্ধারণ করা হয় তেমনি কোরবানিতে ব্যবহৃত ছুড়িগুলোও ধার করা হয়। এককথায় সবকাজ থরে থরে গুছিয়ে রাখা হয় আগে থেকেই। সঠিক উপায়ে দায় ও দায়িত্ব পালনে ঢাকাইয়ারা পাকাপোক্ত।

জিলহজ্ব মাসের চাঁদ উঠবার সাথে সাথে ময়মুরুব্বিরা নামাজ-রোজায় মশগুল হয়ে যান।প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো বাসায় বৌ মুরুব্বীরা রোজা রাখেন এবং ইফতারের আয়োজন হয়ই হয়। ভাবগাম্ভীর্যের এই রীতি রেওয়াজ পরিবারের সন্তানদেরকে ধর্ম পালনের প্রতি বিশেষভাবে আর্কষণে অবদান রাখে। যারা হজ্বে যাবেন তাদের সাথে আত্মীয়স্বজনদের দেখা করতে আসা, আল্লাহ ঘরে গিয়ে দোআ করার আর্জিও কম নয়। সকলের সাথে বিদায় পর্ব সেরে হজ্বে চলে যাওয়ার পর কোরবানির জন্য প্রস্তুতি শুরু হয় ঢাকাইয়া পুরুষদের হিসেবের খাতায় ও মনেপ্রাণে।

হজ্বের আগেরদিন থেকে মহল্লায়,বাসাবাড়িতে গরু/বকরি সাধ্যানুযায়ী আসা শুরু হয়ে যায়। যাদের উঠোন আছে তাদের উঠোনে ২/৩টা সাদা কালো লাল, মিশ্র গরুর হাকডাক শুরু হয়ে যায়। যাদের উঠোন নেই তাদেরটা নিকটস্থ গলি, গলির মুখ ও রাস্তায় গরু বাধা হয়। গরু মানেই অনেক লোকজনের উপস্থিতি। গরুকে দেখে রাখতে হয় কোরবানি হওয়া পর্যন্ত। পরিবারের পূর্ব পরিচিত বিশ্বাসী পুরানো দারোয়ান, কাজের লোক, ড্রাইভার সম্পর্কীতরাই গরু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। এদের তিনবেলা খাওয়ার জন্য রান্নাবান্নার ব্যস্ততাও বেড়ে যায় বাবুর্চিখানায়। সারা বাড়ি শুধু নয় পুরো মহল্লা হৈহৈরৈরৈ আনন্দ উৎসবের ঢেউএ মেতে ওঠে। রাস্তায় গরু এলেই দাম কত দাম কত, জিজ্ঞেস করাও যেন খুশির অন্তর্ভুক্ত মনে হতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে সম্প্রীতি ও সংহতি যেন একেই বলে যা আমাদের ঢাকাইয়ারা ভাল মত জেনেবুঝে মেনে চলি।

বাড়িতে কোরবানীর উর্দ্দেশে গরু বা বকরি/ছাগল আসার পর শুরু হয় কাচা বাজার করার ধুম। চক বাজার মৌলভীবাজার, ঠাটারী বাজার, মহল্লার মুদি দোকান, আধুনিক যুগের স্বপ্ন, আড়ংএর দোকানগুলোতে গায়ে গায়ে মানুষ। আদারসুন,পেয়াজ, জাফরান, সেমাই, কেওড়া,  টকদই, গরমমসলা, জিরা, ধনে, জায়ফল,জায়ত্রী, দারচিনি, এলাচ, মেথি, গোলমরিচ, সরিষা, তেজপাতা, সিরকা, টমেটো সস, ওস্টার সস, মাওয়া, পোস্তারদানা, দারচিনি, এলাচ, লং, ওরিগেনো, হলুদ রং,বাদাম,ঘি, তেল, লবঙ্গ, হলুদ, শুকনা মরিচ গুড়া, লবন, পোলাওর চাল, এছাড়া থাকে মেহদি পাতা, সোন্দা, সরিষার সুগন্ধি তেল, সুগন্ধি পারফিউম, কাঁচের চুড়ি, নেইলপলিশ, চুলের ব্যান্ড এবং অবশ্যই পাথরখচিত ভ্যানিটি ব্যাগ। মিন্তির মাথায় বাজার দিয়ে ভিজে চপচপে পান্জাবি আর লুঙ্গি হাতে গুটিয়ে মুখে মিষ্টি জর্দাপান আঙ্গুলে চুন, পান চিবিয়ে চিবিয়ে রাস্তা দিয়ে বাসায় ফেরার স্ট্যাইল বা ঢংএ ঢাকাইয়া পোলা আর বয়স্ক ময়মুরুব্বিদের জন্য অহংকার ও গর্বের শেষ নেই। বাসায় প্রবেশ করেই 'এই কই গেলা সব্বাই' মিন্তির টুকরি উপচে পড়া বাজার আনার যে স্বস্থির স্বার্থকতা, আহ্ দেখার মত। –বাজার আনছেন? যেন পৃথিবীর সকল চাওয়া পাওয়ার মধ্যে এরচেয়ে বেশি পাওয়া আর কিছু হতে পারে না! পাক্কা গৃহিনী থরে থরে সব বাজারের সুবন্দোবস্ত করেন কাজের সহকারীকে নিয়ে। নতুন একটা রঙ্গিন শাড়ি, কিছু টাকা আর আন্দাজ করে বাটা মসলাগুলো বুয়াকে দিয়ে বলেন, এটা তোমার ঈদের শাড়ি, টাকাটা রাখো বাজার কইরো কালকে। আরো বলেন, 'এইসব মসলাগুলো মিহিন কইরে বাইটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে ফ্রিজে রাইখো। কামের সময় যেন ফটাফট হাতের কাছে পাই, ঠিক আছে? এহন মেন্দিটা বাটো,সোন্দা মিলাইয়া আমার ঘরে নিয়ে আসো।'

এরপর পরিবারের বউবেটিরা যার যার কর্তব্য তা করতে থাকেন,কেউ ঘর গুছায়,কেউ মেহদী দেয়, কেউবা কালকে কি পড়বে তা ঠিক করে গুছিয়ে নেয়। কিশোরী কন্যারা হাতের মেহদি গরুর কপালে ঘসে ঘসে কপালটা লাল করে দেয়ার জন্য মেহদি নিয়ে লোকগুলোকে দিতো গরুকে 'মেন্দি লাগিয়ে দেন তো!' গরুর লোকগুলো কথার ব্যত্যয় না করে তাই করে দিতো। মেয়েদের দু'হাতের পাতাও লাল, গরুর কপালও লাল, এযেন ভূবন জুড়ানো অন্যরকম আনন্দ।

ঢাকাইয়াদের মধ্যে কোরবানির ঈদ দু' দিন পালন করা হয়। দুদিনই কোরবানি দেয়ার রেওয়াজ আছে। দুইদিনই দিনভর আনন্দ। আমাদের বাসায় আব্বা প্রথমদিন ঈদের আনন্দ আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে যাপন করতেন। রান্না নিয়ে আম্মি সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটাতেন। মুরগীর রোষ্ট, খাসির কালিয়া, কোপ্তা পোলাও, ঠান্ডা জিহ্বা,জড়দা,সেমাই, ফিরনি। মধ্যবিত্ত আত্মিয়রা  এলে আব্বা নিরবে লুকিয়ে কিছু টাকা তাদেরকে দিতেন আর বলতেন 'আজ থাকুন, কাল কোরবানি দেখে মাংস নিয়ে যাবেন।'

ঈদের দিন সকালে খোরমা, সেমাই, জরদা টেবিলে দেয়া হতো। বউবেটিরা পবিত্র হয়ে গরু কোরবানির অপেক্ষায় থাকতেন। যারা আসতো ঈদের সেমাই, পোলাও, জরদা খেয়ে গরুর সামনে গিয়ে ভিড় করতেন। আব্বা এ দৃশ্য খুব উপভোগ করতেন। উঠানে তিনটা বড় আলিশান গরু। 'কাসাই (কসাই) আগিয়া', ঈদের নামাজে যাওয়ার আগেই গরুকে গুসল করিয়ে সব প্রস্তত করে রাখা হয়। আব্বা নামাজ পড়ে এসে নিজের বচ্চাকাচ্চাকে নিয়ে বারান্দায় হাজির গরু জবাইয়ের জন্য। আম্মিকে ডাকতেন, 'তোম কাহা হো,সামনে আও'। আম্মি পর্দার আড়ালে দাঁড়াতেন। কসাই ডাকে–'আহেন সাহেব'  আব্বা একে একে গরু জবাই দিতেন। ‘আল্লাহ ওয়াক বার’। গরুর চামড়া মসজিদে দান করে মাংসের সমতার বণ্টন। একটা গরুর কলিজা, মাথার মগজ, বুকের ও পাসলির মাংস বাসায় দেয়া হতো। তাড়াতাড়ি রান্না হতো। দুপুরে বাসায় যারা আসতো মাংস নিতে সবাইকে নিয়ে দুপুরের খাবার খেতেন আব্বা। কথিত আছে সকালের নাস্তা না করে কোরবানির মাংস দিয়ে দুপুর খেলে নাকি একটা রোজার নেকি পাওয়া যায়।

কোরবানির পর প্রথম মাংস পাঠানো হতো মেয়ের বাড়িতে। নতুন বিয়ে হওয়া মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে খুড়সমেত রান পাঠানোর তোড়জোড় চলে মাংস বিলি বণ্টন শুরু হওয়ার আগেই। এও এক অভিজাত্যের পেহচান বা পরিচয় বহন করে। আগেই ঠিক করে রাখা লোকের মাধ্যমে বিকেলের আগেই গরুর আস্ত রান পাঠানো হতো জামাই বাড়িতে। যে রান নিয়ে যেত তাকে জামাই বাড়ি থেকে সালামিও দেয়া হতো।

অন্যদিকে ঈদের সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসায় টিকিয়া, গরুর হামের রোষ্ট,কালিয়া, কোপ্তা, টিকিয়া, ঝাল মাংস, শাহী রেজালা, নেহারী, ভুনা চাপ, জিহ্বাঝাল, চালের সাদা রুটি, খাস্তা ঘি পরাটা, পরাটা, বাখরখানি, মিষ্টি বকরখানি, সাদা মাংস প্রস্তুত। বিকাল থেকে গভীর রাত অব্দী চলে খানাপিনার লঙ্গরখানা। কেউ যেন বাদ না পড়ে,মনিব থেকে দারোয়ান,ড্রাইভার সবার হক যেন পুরণ হয়। গরুবদুখীর মধ্যে একটুকরা মাংস নয়, একপোয়া ওজনের ভাগ করে সমবন্টনের মাধ্যমে সুশৃঙ্খলভাবে মাংস বিলি করা হয়। মাংস বিলানের জন্য বাড়ির বড় ছেলে অথবা তরুণ নাতিকে দায়িত্ব দেয়া হয়,যাতে আয়ন্দা পিড়ি অর্থাৎ আগামী বংশধর এই রীতিরেওয়াজা সম্পর্কে জানে বুঝে-দায়িত্ব পালনে অভিজ্ঞতা নিতে পারে।

এই আমাদের দুইদিনের ঈদ ও ঈদের খুশি । আনন্দ উৎসব মানে এ এক পরম সমতা সম্প্রীতির বন্ধন এবং 'সকলে আমরা সকলের তরে'— এই দান-দাক্ষিণায় অভ্যস্থ হওয়া এবং নবী করিম হযরতে মোস্তফা (সা:) এর দৈহিত্রের আত্মত্যগের মহিমায় উদ্ভাসিত বকরিদ আমাদের শিক্ষা দেয়, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তার হুকুম পালন করাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য। ঢাকাইয়া পরিবারের পরবর্তী ঈদের শেষ সময়গুলো অতিবাহিত হয় দাওয়াত দেয়া আর নেয়া, খাওয়া আর আনন্দের আবগাহনে উড়ে বেড়ানো।পরিবার পরিজনকে নিয়ে গরিবদুঃখী, অসচ্ছল, মধ্যবিত্ত আত্মীয়দের খোঁজ নেয়া এবং নিজ উদ্যোগে নিজ হাতে মাংস পৌছে দিয়ে অশেষ নেকি হাসিল করার লক্ষ্য থেকে ঢাকাইয়ারা কখনো পিছপা হয় না।

ঢাকাইয়া ভিন্ন কোনো মত ও পথের মানুষ নয়। ধর্ম পালনে ও মানবসেবায় সর্বদাই সজাগ,সতেজ এবং নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে ওঠা এক বিকল্প ঐতিত্য, যা কেবল সম্মাণিত অভিজাত অভিযাত্রাকেই নির্দেশ করে। এই ঐতিহ্যের ধারক উজ্জ্বল পূর্বপুরুষদের জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
ঈদ মোবারক,বাকরিদ মোবারক…।

হোমায়রা হুমা: কবি, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/