মাহমুদা আকতারের উপন্যাস ‘বালামখানা’

মাহমুদা আকতার

বালামখানা

মেঘলা দিন। ঝিরঝির বৃষ্টি। গুরু শিষ্য ঘরের মধ্যে বসে জ্ঞানের কথা আলোচনা করছেন। তাদের কথা মানে তো সব গুরু গম্ভীর আধ্যাত্মিক আলোচনা। শরিয়তি আর মারাফতির নানা প্যাচালের মধ্যে শিষ্য আলীম হোসেন বলেন, ‘তাইলে একটা গল্প শোনেন ফরাজ সাহেব। এই গল্পটা শোনলে আপনি বুঝতে পারবেন নালায়েক আলেমরা কীভাবে ফালতু জিনিস নিয়া তর্ক করে।’
গুরু ফরাজউদ্দীন তার নতুন শিষ্যের প্রতি আশকারামুলক হাসি দিয়ে বলে, ‘তুমি তো মিয়া গল্পের জাহাজ। প্রতিটি ঘটনার জন্য তোমার গল্প রেডি। এইটা কিন্তু খুব ভালো জিনিস। আচ্ছা, তুমার মনে হয় ম্যালা পড়াশোনা। কদ্দুর পড়ছ, কওতো দেখি, শুনি।’
-ফরাজ সাহেব, আগে তো গল্পটা শোনেন। গল্পের মধ্যে আজইরা প্যাচাল ভাল্লাগে না।
আলীম তখন গল্প বলতে শুরু করল। গুরু ফরাজ সাহেবের কন্যা অপলা কাছেই বসেছিল। সে গল্প শুনে মিটিমিটি হাসতে লাগল। তার হাসি উপেক্ষা করে গল্প অব্যাহত রাখে আলীম। গল্প বলতে বলতে সে ভাবে- ‘এ্যাই মাইয়াটার কোনো কাজকর্ম নাই। হুদা খায় আর ঘুইরা বেড়ায়। ফরাজ সাহেব এত কিছু জানেন অথচ মাইয়াটারে কিছুই শেখান নাই।’ আসলে সে ভেবেই পাচ্ছে না এই গল্পের মধ্যে হাসির জিনিস কোনটা।
আসলেই অপলার তখন কোনো কাজ ছিল না। এমনিতেও তার তেমন কোনো কাজ নেই কেবল রান্নাবান্না ছাড়া। সাধক মানুষজনের রান্নাবান্নাই বা তেমন কি! সেই তো কেবল ভাত আর সব্জি সেদ্ধ। কদাচিৎ ডাল বা খানিক দুধ এই তো ঢের। এই রান্নায় অপলার কতই বা সময় লাগে। দিব্যি রান্না শেষ করে, ছোট্ট ঘর দু’খানা ঝাট ফাট দিয়ে গুছিয়ে গাছিয়ে গোসল ফোসল সেরে ফিটফাট হয়ে বসে থাকে। বৈঠকখানা আর উঠোন ঝাড়– দেয়ার  আলাদা মানুষ আছে। তার বাবা ফরাজউদ্দীন কোনো আমীষ খান না। তবে মেয়ের জন্য কখনও কখনও ডিম আনেন। কিন্তু ডিম অপলার অত পছন্দ নয়। তার পছন্দ মাংস। কিন্তু সে কখনও নিজের পছন্দ অপছন্দের কথা মুখ ফুটে বলে না। কিন্তু ফরাজউদ্দীন জানে মেয়ের বিভিন্ন পছন্দ অপছন্দের কথা। এই যে তিনি ফকির জীবনযাপন করছেন এটাও তো অপলার অপছন্দ। সে চায় সুস্থ স্বাভাবিক সামাজিক জীবন যে জীবন ছেড়ে স্বেচ্ছায় একদিন পথে নেমে এসেছিলেন ফরাজউদ্দীন। পথেই তার অপলার মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তারা একসঙ্গে ছিল বেশ কিছুদিন। অন্তত যতদিন দু’ জনার মধ্যে ভাব ভালোবাসা ছিল। একদিন ফরাজ আর তিন বছরের কন্যাকে ফেলে চলে গেল সেই নারী। একবার বলেও যায়নি। কিন্তু মেয়েটা তার মায়ের মত ভবঘুরে স্বভাবের নয়। সে হচ্ছে পাখির মত। আদর ভালোবাসায় বাবাকে জড়িয়ে রেখেছে। মায়ের মত কোনোদিন তাকে ফেলে যাবে না। এজন্যই মেয়েটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে ফরাজ। এই ফকিরি জীবনে ভাব ভালোবাসার কি কোনো দাম আছে। বরং অপলা যদি তার মায়ের মত উড়নচ-ী হত তাহলে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারতেন ফরাজ। আলীমের গল্প যত গভীর হতে থাকে অপলার হাসির পরিমাণ তত বাড়তে থাকে। গল্প বলার উত্তেজনায় আলীম ওঠে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং হাত পা নাড়িয়ে শ্্েরাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকে। এইসময় অপলা শব্দ করে হেসে ফেললে আলীম বিরক্ত হয়। সে গল্প বলা থামিয়ে অপলার দিকে তাকিয়ে বলে-
-এখানে হাসির কথা কোনটা, অপলা? আমি কি গোপাল ভাঁড়ের গল্প বলছি?
অপলা তখন মুখে কাপড় গুজে হাসি থামানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু থামার বদলে তার হাসিটা বেড়েই যাচ্ছিল। ফলে সে দমকে দমকে হাসছিল। মেয়ের এই কা-ে খানিকটা বিব্রত ফরাজউদ্দীনও। তিনি জানেন তার মেয়ের একটা বেখাপ্পা স্বভাব আছে। হঠাৎ হঠাৎ তার খুব হাসি পায় উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো কারণ ছাড়াই। সে তখন হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। অনেকখন হাসার পর সে যখন কারণটা বলে তখন ফরাজউদ্দীনও অনেক সময় ভেবে পান না, এই তুচ্ছ কারণে এত হাসির কি হল। কিন্তু তিনি কখনই মেয়েকে এ নিয়ে কিছু বলেননি। কেননা শাসন করা তার স্বভাব নয়। কিন্তু আলীমের সঙ্গে তার নতুন পরিচয়। সে তো আর অপলা সম্পর্কে এত কিছু জানে না। তাই আজ মেয়ের এই আচরণে খানিকটা লজ্জিত হন এবং শাসনের ভঙিতে বলেন, ‘মা অপলা, তোমার হাসা উচিত হয়নি। সে একটা অসাধারণ গল্প বলতেছিল। তুমি তাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছ। অপলা তখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে থাকলে আলীম তাকে বাধা দেয়।
-তার আগে আপনি বলুন আমার গল্পে হাসির কি ছিল?
অপলা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। সে জানায়, আলীমের গল্পে হাসির কিছু ছিল না। এই কথায় আলীমের রাগ আরো বেড়ে যায়।
-তাহলে আপনি তখন থেকে অত হাসছিলেন কেন?
-ডুরি আপনার ডুরি।
-মানে?
-মানে আপনার পায়জামার লম্বা ডুরিটা বেরিয়ে আছে। আর সাপের মত দুলছে। এই বলে সে এবার হাসতে হাসতে লুটয়ে পড়ে। আলীম তখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ফরাজ তাকে ফেরানোর চেষ্টা করে।
-দুপুর হয়ে গেছে। বাবা, চারটে মুখে দিয়ে যাও।
-না, গুরুজি। আর একদিন খাব।
অপলাও তাকে পিছন থেকে ডাকতে ডাকতে উঠোনে নেমে আসে।
-এই যে, আজ কিন্তু খিচুরি রেঁধেছি। না খেলে পরে কিন্তু খুব আফসোস হবে।
আলীম ওকে গ্রাহ্য করে না। সে পেছন ফিরে একবার তাকায় না পর্যন্ত। সোজা বেরিয়ে যায়। অপলা তার বাবাকে খেতে দেয়। চাল, ডাল আর আলু দিয়ে রান্না করা খিচুরি বেশ লাগে খেতে। রোজকার সিদ্ধ ভাত আর সব্জির মুখে এই তো অমৃত। কিন্ত আজ ফরাজের খেতে ভাল্লাগছে না মোটেও। ছেলেটাকে তিনি নিজে ডেকে নিয়ে আসছিলেন ফরিদের চ্যালা থেকে। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়ার কথা ছিল। আজ রাতে একটা গানের আসর আছে শহরে। সেখানে একসঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেয়েটা সব প- করে দিল। ছেলেটা এখন এই অসময়ে কোথায় খাবার পাবে!
-মা, তুমি কি কাজটা ঠিক করলে? একজন মেহমান রাগ করে না খেয়ে চলে গেল। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কি জবাব দেব বলো তো! তুমি আমাকে পাপের ভাগি করলে।
-আমার হাসি পেলে আমি কি করব?
-আমরা হলাম ফকির মানুষ। আমাদের কি পোশাক টোশাক নিয়ে ভাবলে চলে! তুমি তার ডুরি নিয়ে কেন হাসলে?
-ফকির মানুষের অত রাগ থাকতে হয়! ও কিসের ফকির, ও কোনোদিন তোমার মত সাধক হতে পারবে না। আমি বললাম তুমি দেখে নিও।
-চাইলেই কি সবাই সব হতে পারে রে মা। এই সব তো ওপরআলার ইচ্ছে। তিনি যদি তাকে সাধক হওয়ার জন্য কবুল করেন তাহলে সে হবে।
-সবকিছুতে ওপরওয়ালার দোষ দিলে কি হয়, নিজের ইচ্ছাশক্তির জোর থাকা চাই। শখে শখে কত মানুষই তো কত কিছু করে।
-কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ।
-তুমি দেখে নিও, ও একদিন ঠিক ঘরে ফিরে যাবে।
-তোর তো সবই ভালো রে মা, শুধু হাসির রোগটা। আমারই ভুল হয়েছে। ওকে আগেই বলা উচিত ছিল। তোর মায়েরও এই রোগ ছিল।
অপলার খুব অভিমান হয়। মায়ের সঙ্গে তুলনাটা তার একটুও পছন্দ নয়। আসলে মাকেই তার পছন্দ নয়। হয়ত বা ছোটবেলায় ফেলে রেখে যাওয়ার কষ্টটা এখনও ভুলতে পারেনি। তাকে তার বাবা লালন পালন করেছে। ঠিক বাবাও নয়, অনেকটা নিজে নিজেই বড় হয়েছে সে। তার বাবা এজন্যই তাকে মাঝে মাঝে বলে, ‘প্রকৃতির সন্তান’।

দুই
ফরাজ বেশ চিন্তায় পড়ে যান। গানের আড্ডাতেও আলীম আসেনি। গানটা তার বেশ পছন্দ। সে কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে না। মাঝে মধ্যে তার দোতরাটা বাজানোর চেষ্টা করে। তবলায় দু একটা চাটি মারে। তবে তার গানের গলা খারাপ না। কিন্তু বড় লাজুক। লোকজনের সামনে গান গাইতে তার বড় লজ্জা। তার মেয়ে অপলার গলাটাও খুব ফাইন। সেও গান শেখেনি এবং গাইতেও চায় না। মেজাজ মর্জি ভালো থাকলে গুন গুন করে খানিক গায়। ফরাজের মনটা বড় চঞ্চল হয়। কোথায় গেল ছেলেটা তাকে না বলে কয়ে। তিনদিন পর খবর পান তিনি। আলীম জ্বরে বেহুঁস হয়ে পরে আছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গতরে ফতোয়াটা পরে আলীমের কাছে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেন। অপলা বলে, ‘দাঁড়াও বাবা, তোমার সঙ্গে আমিও যাব।’
-ফিরতে ফিরতে ম্যালা রাত হয়ে যাবে যে মা।
-সমস্যা কি? তুমি তো সঙ্গে রয়েছ।
-তাহলি চল।
আলীম থাকে নয়নডাঙ্গা বাজারে, তাদের বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দূর। বয়াতি একা হলে হেঁটে হেঁটেই চলে যেতেন। হাঁটাটা তার কাছে নেশার মত। কোনো একটা গন্তব্য লক্ষ্য করে ছুটতে থাকার মধ্যে অন্য রকম গতি আর আবেগ থাকে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর পর সেই নেশা ছুটে যায়। ব্যর্থ হয় আবেগ। তখন ক্যামন ছেলেমানুষের মত মনে হয়, দূর না আসলেই ভালো হতো। তারপরও হাঁটার নেশা কাটে না তার। কোথাও যাওয়ার কথা হলে নিজের মনেই হাঁটতে থাকেন। হাতে দোতরা বা ডুগডুগি থাকলে টুং টাং করে বাজাতে থাকেন। তখন নেশাটা জমে ভালো। কিন্তু আজকের কথা ভিন্ন। সঙ্গে অপলা থাকায় তিনি একটা রিকশা ভাড়া করেন। বাসা খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। বাজার সংলগ্ন এলাকাটা আসলে একটা বস্তিমতো। ছোট ছোট টিনসেট কয়েকটা ঘর গায়ে গায়ে লাগানো। এরই একটা ঘরে থাকে আলীম। ফরাজ বয়াতি বাইরে থেকে অনেক ডাকাডাকি করার পরও সাড়া মেলে না। তখন পাশের ঘর থেকে একজন বেরিয়ে এসে বলে, ‘দরজা বোধহয় খোলাই আছে। আপনারা ঢুকে যান।’
ঘরে ঢুকে অবাক হন ফরাজি। ছোট্ট একটা কৈতরের খোপের মত ঘর। লম্বায় বড় জোর সাত আট হাত হবে। তাতে একখানা চৌকি পাতা। তার ওপর অচেতন হয়ে পড়ে আছে আলীম। মাথার বালিশখানা কখন যে নিচে পড়ে গেছে তাও খেয়াল নেই। মশারির মাথার দিকের একখানা দড়ি খোলা। সেটি জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে কাতড়াচ্ছে। মশার ভনভন শব্দ দূর থেকেও টের পাওয়া যাচ্ছে।
-বাবা, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তুমি দোকান থেকে দেয়াশলাই আর মোম নিয়ে আস।
-আর একখানা মোরগ মার্কা কয়েল নিয়ে এস। এখানে বড্ড মশা।
অপলা দ্রুত হাতে মশারির বাকি দড়িগুলো খুলে নিয়ে সেটি ভাজ করে রাখে। মেঝে থেকে বালিশটা কুড়িয়ে আলীমের মাথার নিচে দেয়। মাথাটা উঁচু করতে গিয়ে সে টের পায় মানুষটার গায়ে কী প্রচ- জ্বর! মাথায় পানি ঢালতে পারলে ভালো হত। কিন্তু বালতি ফালতি কোথায় আছে কে জানে! সে বেশ খানিকটা খোঁজাখুঁজির পর গামছার মত একখানা কাপড় পায়। সে বাইরে নেমে দেখে একটা বৌ উঠোন ঝাড় দিচ্ছে।
-এখানে পানি নেব কোত্থেকে?
-ওই যে ওইখানে কল আছে। সে মাথা দিয়ে ইশারা করে একটু দূরে পশ্চিম পাশের জায়গাটা দেখিয়ে দেয়।
খোলা মত একটা জায়গার মাঝামাঝিতে টিউবওয়েল। টিউবয়েলের চারপাশের খানিকটা জায়গা পাকা করা। তবে সিমেন্টের আস্তর ওঠে গিয়ে লাল ইটগুলো বেরিয়ে এসেছে জায়গা জায়গায়। এটার ডান পাশে টিনসেড ছোট্ট ছোট্ট তিনখানা ঘর। সম্ভবত এগুলো গোসলখানা ও পায়খানা। টিউবওয়েলের উত্তর পাশে খানিকটা জায়গা চট দিয়ে ঘেরা। এতে দুইটা ইট বেছানো। এটা বোধহয় প্র¯্রাবের জায়গা। চটের একটা কোনা খোলা থাকায় অপলা চট করে সব দেখে নেয়। একটা গোসলখানার দরজা খোলা। বাকি দুটো বন্ধু। সম্ভবত সেগুলোতে লোক আছে। অথাৎ তারা মল ত্যাগ করছে। তার কেমন ঘেন্না লাগে। সে কলের তলায় থাকা বালতিটায় পানি ভরতে থাকে। কল চাপতে চাপতে সে দেখে পশ্চিমের আকাশটা এখনও লাল। একটু আগেই সূর্য ডুবেছে। তার শেষ চিহ্ণটা রয়ে গেছে এখনো। আহারে কেউই মায়া ছাড়তে চায় না। সব কিছু নিজের করে আঁকড়ে রাখতে চায়। তার বাবা বলেন, ‘এই মায়াটাই হল সংসার। যতক্ষণ পর্যন্ত মায়া ছাড়তে না পারবে ততক্ষণ হাজার চেষ্টা করলেও ফকির হওয়া যাবে না।’ তাহলে তার বাবা ফরাজউদ্দীনও কি আসলেও বৈরাগী বা ফকির হতে পেরেছেন। তারও তো মায়া আছে, একমাত্র মেয়ে অপলার জন্য কি তার কম মায়া!

অপলা  উঠোন পেরিয়ে আসার সময় দেখে বৌটা উঠোনের দড়ি থেকে কাপড় তুলছে। তাকে দেখে বলে, ‘এ্যাই এইটা কিন্তু আমাদের বালতি। কাজ শেষ হলি দিয়ে যেও।’
অপলা মাথা নাড়ে। কিন্তু সে এত সহজে ওকে রেহাই দেয় না। পিছন থেকে বলে, ‘তুমি ওর কে হও গো?’ অপলা বালতিটা রেখে বৌটার দিকে তাকায়। হেসে হেসে বলে, ‘ক্যান, বোঝা যায় না।’
-ওহ, কিন্তু উনি যে বলেন এই সংসারে তার কেউ নেই।
অপলা এবার হাতটা মাথার কাছে নিয়ে নাড়াতে থাকে।
-সত্যিই পাগল। নইলে অত সুন্দর বৌ রেখে কেউ এভাবে থাকে? আরে জানো, একটা বালতি নেই, মগ নেই। গোসল ফোসল করে না ঠিকমত। খায় কি না খায় আল্লাই জানে!
অপলা দ্রুত ঘরে ঢুকে যায়। মাথার নিচে কাপড়টা দিয়ে জল ঢালতে থাকে। একটা রেকসিন থাকলে ভালো হত। ইস, বাবাকে বলে দিলেই হত। অপলা মাথাটা আর একটু বাইরের দিকে নামিয়ে নেয়। মানুষটা কিচ্ছু বলে না। কেমন বেঘোরে পড়ে আছে দেখ।
ফরাজউদ্দীন মোম নিয়ে আসে এবং দুটো মোম ধরিয়ে দেয়।
-বাবা, কয়েলটাও জ্বালিয়ে দাও। এইখানে মাথার কাছে চৌকির নিচে রেখে দাও। কী যে মশা! পারলে এরা আস্ত মানুষটাকেই তুলে নিয়ে যেত।
ফরাজউদ্দীন চৌকির এক পাশে বসে মেয়ের সেবা দেখতে থাাকেন। ভাগ্যিস মেয়েটা সঙ্গে এসেছিল। নইলে তিনি একা এখানে কি করতেন। এই দেয়াশলাই বা মোম আনা বা আলীমের মাথায় পানি ঢালার কথা তো তার মনেই হত না। আসলে ভাব দিয়ে সব না। সংসারী মানুষেরও দরকার আছে। নইলে এই জগত সংসার টিকত না। তার মেয়েটা কী মন দিয়েই না একজন পরপুরুষের সেবা করছে। বাইরের কেউ দেখলে আলীমকে তার একান্ত কাছের মানুষ বলেই মনে করবে। অথচ মাত্র ক’দিন আগেই সে আলীমের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। তার নিজের মেয়েটাকে তিনি এখনও ঠিক বুঝে ওঠতে পারেন না। সত্যি বলতে কি, নারীরা তার উপলব্ধির বাইরে। নিজের স্ত্রী যার সঙ্গে দীর্ঘ সাতটি বছর একত্রে থেকেছেন তাকেও তো বুঝতে পারেননি। তাকে ঘুমে রেখে সে চলে গেল। অথচ তিনি এক ফোঁটাও টের পাননি। কী আজব! এই যে তিনি নারীদের বোঝেন না অথচ লোকজন তাকে বাউল বলে, এটা কি ঠিক? নারীদের না বুঝলে কি সাধক হওয়া যায়!
-বাবা, শুধু পানি ঢেলে এই জ্বর নামানো যাবে না। তুমি বাজারে যাও। দেখো একটা ডাক্তার পাও নাকি।
এই সময় তিনি অপলার চোখে এক ধরনের আকুলতা লক্ষ্য করেন। একজন বাইরের লোকের জন্য এই আকুলতা কতটা যুক্তিযুক্তি! অথচ কদিন আগেই না মেয়েটা এই লোকটাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। পথে যেতে যেতে এইসব ভাবেন ফরাজউদ্দীন।

অপলার সেই হাসাহাসির ঘটনার তিনদিন পর আলীমের সঙ্গে তার দেখা। তিনি গিয়েছিলেন জগন্নাথপুরে একটা ওরসে গানের বায়নায়। সেইখানে তার কয়েকজন ভক্ত আর সাগরিদদের দলে ছিল আলীমও। যদিও ওইদিনের পর আলীম আর তার কাছে যায়নি। তাকে দেখে নীরবে এসে কদমবুসি করে। তিনি মাথায় হাত রেখে স্নেহের সঙ্গে শুধান
-কি আলীম, খবরাখবর ভালো?
-জ্বী ফরাজ সাহেব। আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
-বল।
-এইখানে না। অন্তরালের কথা।
অন্তরালের কথা বলতে আলীম কি বোঝাতে চাইছে তিনি প্রথমে ধরতে পারেননি। ভেবেছিলেন মারফতি কথা বলতে চাইছে। তাই তিনি বলেন, ‘অন্তর ভিতর সবই তার জানা। তুমি নির্ভয়ে বলতে পার।’ কিন্তু আলীমের জড়তা দেখে তিনি বুঝতে পারেন সে আসলে একান্তে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। তিনি বাড়ি ফেরার পথে আলীমকে ডেকে নেন। অন্ধকারে মেঠোপথ ধরে চলতে চলতে তারা কথা বলেন। আলীমের এক হাতে টর্চ লাইট। অন্য হাতে ফরাজুদ্দীনের দোতরাটা ধরা। বাড়ির কাছাকাছি আসার পর আলীম বলে, ‘আমি আর যাব না। আজ ডেরায় ফিরতে হবে।’
-ঠিক আছে কাল দেখা হবে। সকাল সকাল চলে আইসো।
-একটা কথা ছিল।
ফরাজুদ্দীনের মনে পড়ে সেই কথাটার কথা যা অনেকক্ষণ ধরে বলতে চাইছে ছেলেটা কিন্তু বলতে পারছে না। কৌতুহলী হয়ে ওঠে ফরাজুদ্দীন।
-কি কথা, বল।
-থাক, কালকে বলব। আপনার দেরি হয়ে যাবে।
-না, আজই বল। আমি শুনতে চাই।
এরপর লাজুক মুখে আলীম বলে, ‘আমি অপলাকে বিয়ে করতে চাই।’ ফরাজুদ্দীন কিছু বলার আগে সে আবার কৈফিয়তের ভঙ্গীতে বলে, না মানে, ফকির হওয়ার আগে তো একজন সঙ্গী খোঁজা চাই। একজন সাধকসঙ্গী। তাই বলছিলাম ওকে আমি সাধকসঙ্গিনী হিসেবে পেতে চাই।
-কিন্তু আমি তো তোমাকে কথা দিতে পারছি নে বাবা।
-ক্যান, আর কারো সঙ্গে কি আপনি ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন?
-সেইসব কিছু না। আসলে অপলার সঙ্গে কথা না বলে আমি তোমাকে কথা দিতে পারছিনে। ওর মতের বাইরে আমি যেতে চাইনে। তাছাড়া সাধকসঙ্গিনী হওয়ার ব্যাপারে ওর তো তেমন আগ্রহ দেখিনে। সে তো এ নিয়ে আমার সঙ্গে কখনো কথা বলেনি। ওর সঙ্গে কথা বলে আমি দু দিন পর তোমাকে জানাই?
ফরাজুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার পর খুব মন খারাপ হয়েছিল আলীমের। নিজেকে খুব নির্লজ্জ লাগছিল। আসলে এসব কথা তো কোনো তৃতীয় পক্ষেরই বলার কথা। পাত্র কি কখনও সরাসরি প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এখানে বিদেশ বিভূঁইয়ে সে পরিচিত কাউকে কোথায় খুঁজবে। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে নিজেই কথাটা পেরেছিল। এই প্রস্তাবটা না দিয়ে সে আসলে শান্তি পাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল বুকের গলার মধ্যে যেন ধারালো একটা কিছু আটকে আছে। না বের করা পর্যন্ত শান্তি নেই। কিন্তু তার মত লাজুক একটা ছেলের পক্ষে এ ধরনের কা- করা কতটা অস্বাভাবিক কেবল বলে ফেলার পরই তার বোধগম্য হয়। সে জানে এখন সে বাড়িতে থাকলে বাড়ির লোকজন তাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করত। বিশেষ করে বড় ভাবি যিনি ওকে নিয়ে খুব মজা করতেন। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, ‘কিরে খুব তো লজ্জা লজ্জা করিস। বিয়ের পর লজ্জা কোথায় যায় দেখব। এই লজ্জা নিয়ে ছেলের বাপ কীভাবে হবি? আর বৌয়ের সঙ্গে থাকবিই বা কী করে?’

তিন
আজ আর বাড়ি ফেরা হচ্ছে না বাপ বেটির। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর অপলা বার্লি আর ওষুধ খাইয়ে দেয় আলীমকে। একটা ঘোরের মধ্যে পথ্য আর ওষুধ খেয়ে ফের বালিশে মাথা গুঁজে দেয় আলীম। অপলা মশারি টানাতে টানাতে বলে, ‘বাবা, তুমি খাটের ওপরে ওঠে একপাশে শুয়ে পড়ো। আমি মেঝেতে শুয়ে থাকবনে।’
-নারে মা, আজ আর আমার ঘুম আসেব না। তার চাইতে আমি ধ্যান করি। তুই বরং ওর পাশে শুয়ে থাক। ফরাজুদ্দীন অনেক রাতই ঘুমায় না, ধ্যান করে কাটায়। তাই অপলা তার বাবাকে বাধা দেয় না। সে মোম নিভিয়ে দেয়।
-বাবা, ম্যাচটা এইখানে তোশকের তলায় রাখা আছে। বাইরে যাওয়ার সময় আলোটা জ্বালিয়ে নিও। নইলে আমাকে ডেকো। অন্ধকারে একা একা বাইরে যেও না যেনো।
মেয়ের কথা শুনে নিঃশব্ধে হাসে ফরাজউদ্দীন। মেয়ে তাকে নিয়ে কত ভাবে। ঠিক যেনো ছোট বাচ্চাটি তার বাপ। অথচ কত রাত কত অজায়গা কুজায়গায় কতভাবে কাটিয়েছে তার ঠিক আছে। এখনও তো গানের কিংবা ওরসের খবর পেলে চলে যায় সে শিষ্যদের নিয়ে। সাপ গোপও তাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু সে কেবল এই মেয়েটার মায়া কাটাতে পারল না এখনও। যখন ছোট ছিল সে তখন ভাবত, আর একটু বড় হয়ে নিক। তারপর নিরদ্দেশে চলে যাব। এইভাবে বাইশটা বছর কাটিয়ে দিল। এখন ভাবছে মেয়েটার একটা হিল্যে হলে তবেই সারাজীবনের জন্য পথে নামবে। কবে যে সে পুরোপুরিভাবে সংসার ছাড়তে পারবে তা ঈশ্বরই জানেন। মেয়েটার জন্য পুরোদস্তর বাউল হতে পারল না সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধ্যানমগ্ন হন ফরাজুদ্দীন।
অপলা মশারির মধ্যে ঢুকে আলীমের পাশে গুটিশুটি শুয়ে পড়ে। এত কাছে যে, ওর গরম নিঃশ্বাস ওর গায়ে এসে লাগছে। এখনও জ¦রে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মানুষটা। ভাগ্যিস অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। নইলে কি আর এত সহজে ওর পাশে এসে শুতে পারত অপলা। বাবা ঠিকই বলেন। মানুষের আত্মাটাই তো সব। নইলে আত্মাবিহীন দেহ কাঠামো তো পাখি বিহীন খাঁচাসম। এই শরীরের সত্যিই কি কোনো মূল্য আছে? অপলা গুন গুন গেয়ে ওঠে, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।’
কিন্তু অপলা কি জানে সে নিজেও আজ কত আজব আচরণ করছে? স্বয়ং তার পিতা ফরাজউদ্দীন তার এই আচরণে কম অবাক হননি। যদিও তিনি এর জন্য বহুবার মনে মনে মেয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। মেয়েটি না থাকলে তিনি এই অসুস্থ মানুষটাকে নিয়ে কি করতেন কিছুই ভেবে ওঠতে পারতেন না।
এই অচেতন মানুষটার জন্য অপলার কেমন মায়া হচ্ছে দেখ। অথচ তার বাবা যখন ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন তখন তো ওর খুব রাগ হচ্ছিল। কেবল মনে হচ্ছিল, সেদিনের শোধ নিতেই লোকটা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। পাজামার ডুরি নিয়ে হাসাহাসি করায় খুব অপমান হয়েছে তার। এখন ওকে বিয়ে করে কব্জা করতে চায়। আরও কত কিছু যে ভেবে নিয়েছিল সে। তাই তো বাবার মুখের ওপর না করে দিয়েছিল। তখন ফরাজউদ্দীন জানতে চেয়েছিল
-ক্যান, তোর কি পছন্দের কেউ আছে?
বাবার প্রশ্ন শুনে রাগ আরও বেড়ে গিয়েছিল। ভাবখানা দেখ, যেন বিশেষ কেউ না থাকলেই যার তার প্রস্তাবে রাজি হতে হবে। মুখে কেবল বলেছিল
-আমি অত কিছু বলতে পারব না। আমার ওকে স্বামী হিসাবে পছন্দ নয়। ব্যস।
এরপর মেয়েকে আর ঘাটানোর সাহস করেনি ফরাজুদ্দীন। সত্যি কথা বলতে কি মেয়েকে সে এক প্রকার ভয়ই পায়। অনেক আগে যেমন ভয় পেত ওর বৌ ওজুফাকে। আসলেই নারীদের সে বুঝে ওঠতে পারে না কিছুতেই। এখন ধ্যান করতে করতে বার বার কেবল অপলার কথা ভাবছে সে। যে লোকটাকে তার পছন্দ হয় না বলে সোজা জানিয়ে দিল এখন তার জন্যই কত মমতা ঝড়ে পড়ছে। এর কি মানে হয়? তাহলে কি ওর মত বদলেছে? নাকি একজন অসহায় মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে বলে অনুশোচনা হচ্ছে। ওর অসুস্থতার জন্য নিজেকে দায়ী মনে করে কিছুটা গ্লানি মুক্ত হতে চাইছে। অপলার ওইদিনের ব্যবহারের কারণেই কি অসুস্থ হয়েছে আলীম। হতেই পারেই। মানুষের মন খারাপ হলে শরীর তো খারাপ হবেই। বাড়ি নেই ঘর নেই, আপনজন পাশে নেই। কি অসহায় মানুষটা। ‘অসহায়’ শব্দটা নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবে সে। ব্যাপকভাবে চিন্তা করলে পৃথিবীর সব মানুষই তো অসহায়। কি ক্ষমতা আছে তার, সে তো নিয়তির হাতে বন্দি। ‘একখানে চাবি মাইরা দিছে ছাইরা/ চাবি মাইরা দিছে ছাইরা/ জনম ভরা চলতে আছে/ মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তিরি বানাইয়াছে/ মন আমার দেহ ঘড়ি।’ এবার সুর করে গেয়ে ওঠেন ফরাজউদ্দীন। তার ধ্যানটাও জমে যায়। তিনি ধ্যান করেন গানের মাধ্যমে। তিনি দেখেছেন, আসলে গানের মাধ্যমেই তার ধ্যানটা জমে ভালো। তার গলা ভালো। গলায় সুর খেলে বেশ। কিন্তু তিনি কোনো গান লিখতে পারেননি। গান না লিখতে পারলে কি বাউল বা সাধক হওয়া যায়। বড় বড় সাধকরা সবাই গান বাধতে পারতেন। তবে গানের প্রতি তার ভালোবাসা আছে। এটাই বা কম কিসে।

সকালে ঘুম থেকে ওঠে অপলা দেখে ওর বাবা মাটিতে শুয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে আস্তে আস্তে মশারির বাইরে আসে। নিঃশব্দে মশারি গুছিয়ে রাখে। ঘর দোর ঝাট দেয়। আলীমের মাথায় পানি ঢালতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু কলতলা থেকে পানি এনে মাথায় ঢালার সময় শব্দ হলেই তো ওর বাবা জেগে যাবেন। তাই রুমালখানা ভিজিয়ে নিঃশব্দে আলীমের কপালে জলপট্টি দেয় সে।
রাতে ওষুধ খাওয়ার পর জ্বর কমেছিল। এখন বেড়েছে। এই মানুষটার কিছু হয়ে গেলে বাবা তো বিপদে পড়বেন। অপলা আস্তে আস্তে আলীমের জিনিসপত্র নেড়ে চেড়ে দেখে। জিনিসপত্র তেমন নেই। একটা মেলামাইনের প্লেট, প্লাস্টিকের একটা জগ আর গ্লাস। চৌকির একপাশে টাঙানো দড়িতে কয়েকটা জামাকাপড়। সে এইগুলো গুছিয়ে রাখে।  ফরাজউদ্দীনের কোনো বাস্তববুদ্ধি নেই। মানুষ যা বলে তাই বিশ্বাস করে। যাকে তাকে আশ্রয় দেয়। এজন্য কি তাকে কম ভুগতে হয়েছে। তারপরও কোনো হেলদোল নেই। একদিন দুপুরবেলা তার বাবা বাবলু বলে একজন বাউলকে নিয়ে আসলেন সঙ্গে করে। তাকে যতœ করে খাওয়ালেন। সারা বিকেল দুজনে মিলে গল্প গুজব করলেন। অপলার কিন্তু লোকটাকে পছন্দ হয়নি। মাঝবয়সী লোকটা এমন করে তাকায় যেন চোখ দিয়েই গিলে খেতে চায়। বাবলু চলে যাওয়ার পর অপলা ফরাজউদ্দীনকে বলল
-বাবা এই লোকটাকে তুমি আর বাড়ির মধ্যেই আনবা না। গল্প কর বা গান বাজনা যা করার আলগা ঘরে করবা।
-কেন রে মা, কি হয়েছে?
-বাবা, আমি যে বড় হয়েছি তুমি কি তা বুঝতে পার?
-তাই নাকি খুব বড় হয়েছিস? তা তোর বড় হওয়ার সঙ্গে ওই লোকের বাড়িতে আসা না আসার কি সম্পর্ক?
অপলার খুব রাগ হয় তখন। তার বাবা মাঝে মধ্যে শিশুদের মত আচরণ করেন। কোনো কিছু বুঝতে চান না। এমনকি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পরও চেতন হয় না।
-বাবা, ওর নজর ভালো না।
মেয়ের কথা শুনে হা হা করে হেসে ওঠেন ফজরুদ্দীন।
-আরে দেখার মত জিনিস হলে তো সবাই দেখবে। এটাই জগতের নিয়ম। এখানে নজরের কি দোষ?
-সবাই দেখতে জানে না বাবা। দেখাটাও শিখতে হয়। এজন্যই তো সুদৃষ্টি আর কুদৃষ্টি শব্দ দুটো আছে, বুঝছেন. সাধক বাবা!
বাঃ চমৎকার! মেয়ের কথায় অভিভূত হয়ে যান ফজরুদ্দীন। সত্যিই তো দেখারও তো কিছু নিয়ম কানুন আছে। কোন জিনিস কখন, কীভাবে ও কতক্ষণ ধরে দেখতে হয় সবাই তা জানে না। জানার চেষ্টাও করে না।

চার
তিনদিন পর আলীমের হুঁস হয়। কিন্তু চেতনা ফেরার পর পরিস্থিতি বুঝতে কষ্ট হয় আলীমের। চোখে কেমন ধা ধা লাগে। মনে হয় যেন নিজের বাড়িতেই অবস্থান করছে সে। শুয়ে আছে নিজেরই ঘরের খাটে। পাশে বসে আছে তার জননী। সে আঁকুল হয়ে ডেকে ওঠে, ‘মা, মা গো।’ কিন্তু মানুষটা তার দিকে ফেরার পর ভুল ভাঙে আলীমের। নিজের আদুল গা আর লোমশ বুক নিয়ে বড়ই লজ্জায় পরে যায় সে। কিন্তু সে কালো কালো লোমে ভর্তি এই বুকটা আড়াল করে কি দিয়ে। পিরান দূরে থাক, আশেপাশে তো একখানা গামছাও নজরে পড়ছে না। বাধ্য হয়ে হাত দু খানা আড়াআড়িভাবে ফেলে নিজের লজ্জা খানিকটা নিরারণ করার চেষ্টা করে সে।
‘আমি অপলা। আপনার মাকে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি আসছেন।’
‘এসবের মানে কি, আর আমার বাড়ির ঠিকানাই বা কোথায় পেলেন আপনি?’
‘ইচ্ছা করলেই কি সব কিছু গোপন করা যায় সাধক মশাই?’
অপলা রহস্য করে হাসে। তার মুখের সামনে জলের গ্লাসটা ধরে
বলে, ‘আগে ওষুধটা খেয়ে নিন। তারপর যা বলার বাবার সঙ্গে বলবেন।’
আলীমের চেতনা ফেরার খবর পেয়ে ঘরে প্রবেশ করেন ফরাজুদ্দীন। তাকে দেখে বিছানায় ওঠে বসার চেষ্টা করে আলীম। তাতে বাধা দেন ফরাজুদ্দীন।
-ওঠো না বাবা। শুয়ে থাক। কয়টা দিন তোমার ওপর দিয়ে যেই ঝড় ঝাপটা গেল। ডাক্তার তো সন্দেহ করেছিল তোমার টাইফয়েড হয়েছে। কিন্তু তোমার ভাগ্য ভালো জ্বর সেরে গেছে। তবে তোমাকে আরও বেশ কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হবে।
-বাবা, আমার জন্য আপনাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব।
-আমাকে নয় আলীম। ধন্যবাদ দিতে হলে অপলাকে দাও। মেয়েটা এ কয়টা দিন খুব খাটাখাটনি করেছে। ও না থাকলে তোমাকে নিয়ে আমি যে কী করতাম ভাবতেই পারি না। তাছাড়া তোমার বাড়ির ঠিকানা তো অপলাই খুঁজে বের করল। এরপর তোমার মাকে চিঠিখানাও সে-ই লিখেছে। মেয়েটা আমার বড় বুদ্ধিমতী আর সাহসী হয়েছে।
-সত্যি, আপনাদের ঋণ শোধ করা মুশকিল। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।
-এটা তো সাধুদের মত কথা বললে না বাবা। তুমি তো আর ইচ্ছে করে করোনি কিছু। ভাগ্যে থাকলে খ-ানোর সাধ্য কি আর মানুষের আছে। আমরা তো তার হাতের পুতুল মাত্র।
-তারপরও সাবধনের মার নেই। আমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।
-সাবধান হলেই বা কি করতে। ওষুধ বিসুখের ওপর তো আর মানুষের হাত নেই। কপালে ভোগান্তি থাকলে ভুগতে হবেই। যত চেষ্টাই কর এড়ানো যাবে না। তবে তুমি কিন্তু সত্যি সত্যিই অপরাধ করেছ। বাড়ির লোকজনকে না বলে তোমার এভাবে নিরুদ্দেশ হওয়া ঠিক হয়নি। লুকিয়ে চুরিয়ে তো ফকির হওয়া যায় না বাবা।
-তাহলে কি করতাম? সংসার কি মানুষকে সহজে মুক্তি দেয়?
-তা দেয় না। তাই তো চেষ্টা করতে হয়। আপনজন ত্যাগ করা তো আর সহজ কাজ নয়।
আলীম তার এই কথার কোনও উত্তর খুঁজে পায় না। তাই সে চুপ থাকে। তখন তার হয়ে অপলা বলে-সংসার যদি কাউকে না ছাড়ে তাহলে তো তাকে ফাঁকি দিয়েই আসতে হয়।
-না মা, আমি তোমার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।
-তাহলে তুমিই একটা সহজ উপায় বলো।
-যার যার উপায় তাকে নিজেই খুজে বের করতে হয়। একজনের উপায় অন্যজনের কাজে আসে না।
এই বলে ওঠে আসে ফরাজউদ্দীন। আসলে এই সময় তিনি পালিয়ে এসেছেন অপলার কাছ থেকে। মাঝে মাঝে মেয়েটা এমন সব কথা বলে যে ফরাজউদ্দীন সেগুলোর কোনও উত্তর খুঁজে পায় না। এমন না শরিয়তি বা মারফতি কিংবা পরকাল কিংবা আত্মা সংক্রান্ত গভীর আলোচনায় তার কোনও উৎসাহ আছে। তবু হঠাৎ হঠাৎ এমন সব প্রশ্ন করে! মেয়েটাকে তিনি বুঝে উঠতে পারেন না আজও। অপলা কি কোনও কারণে তার ওপর বিরক্ত? তার মা না থাকার জন্য সে কি তাকেই দায়ী করছে। এই যে আলীমকে তিনি সংসার ত্যাগের পথটা বাতলে দিলেন সেটা কি তার ব্যক্তিগত ক্ষত থেকে? তার স্ত্রী তার কাছ থেকে পালিয়েছেন এজন্য কি তিনি আলীমের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার ঘটনায় ক্ষুব্ধ? নইলে তিনি তো ভালো করেই জানেন প্রতিটি মানুষই পালাতে চায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনাকে সামনে রেখে। মানুষ পালাতে চায় সমাজের কাছ থেকে, পরিবারের কাছ থেকে, আপনজনদের কাছ থেকে কখনও কখনও নিজের কাছ থেকেও কি পালাতে চায় না মানুষ! এখন যেমন ফরাজউদ্দীন নিজেকে আড়াল করতে চাইছেন সবার কাছ থেকে। এজন্যই তিনি আলগা করে এনে ধ্যানে বসেছেন। এখন আর নীরব ধ্যানে মগ্ন থাকা সম্ভব না। তিনি দোতরাটা নামিয়ে গাইতে থাকেন- ‘ওরে রূপ কোথায় । তুই আমায় নিয়ে চল গোসাই।’
এই রূপ নিয়ে একদিন আলীমের সঙ্গে তুমুল বাহাছ হয়েছিলো ফরাজউদ্দীনের। তিনি তার কাছে চানতে চেয়েছিলেন।-তুমি রূপ কি জান্?ো
-জাজিনা। তবে অনুমান করতে পারি। রূপ হচ্ছে আকার
-আর ছলনা?
-ছলনা হইতেছে মায়া।
-না এই দুইটচা শব্দের মধ্যে সামাণ্য পার্থক্য আছে।
-মায়ার ইংরেজি হইতেছে ইলুশন আর ছলনার ইংরেজি…।
-বাবা আলীম আপনি ইংরেজি শব্দ দিয়ে সব প্রশ্নের মানে খুঁজতে যাইয়েন না। একটা শব্দের সঙ্গে কত বছরের সংস্কৃতি, জীবনযাপন আর কত মানুষের ধ্যান ধারণা মিশা আছে তা আপনি জানেন না।
-আচ্ছা আমার একটা সহজ প্রশ্নের উত্তর দেন। বাউলদের কি কোনও দেশ হয়, না কি তাদের কোনও জাত হয়?
– কে বলে হয় না, আমরা মুখে মুখে তো কত কিছুই বলি। কিন্তু জাত ধর্ম ত্যাগ করা সহজ হইলেও সংস্কৃতি যাকে আপনারা কালচার বলেন সেইটা ত্যাগ করা সহজ নয়। সংস্কৃতি হইলো দীর্ঘ দিনের অভ্যাসের ফল। আপনি ইচ্ছে করলেই পানিকে জল বলতে পারবেন না।
-তাইলে শব্দেরও ধর্ম আছে? বাবা ফরাজুদ্দীন আপনি তাই বলতে চাইছেন?
-এক অর্থে দেখতে গেলে তাই। আমরা যেইসব শব্দ ব্যবহার করি পশ্চিমবঙ্গেও সাধুরা তো সেইসব শব্দ ব্যবহার করবেন না।
-অত ছোট করে সব দেখার দরকার কি?
-সমাজ সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে ওঠা অত সহজ না। সংসার ত্যাগ করাও মুখের কথা না। জলে বাস করে যে কুমীর সেও তো মাঝে মধ্যে ডাঙায় ওঠে আসে। কিন্তু আবার তো তাকে জলেই ফিরতে হয়।
-তাহলে যেসব সাধুরা সব ছেড়ে ছুড়ে এভাবে জীবন কাটাচ্ছে তাদেও আত্মত্যাগের কি কোনও মানেই নেই বাবা ফরাজউদ্দীন!
-আমি তাদের আত্মত্যাগকে অসনম্মান করছিনা। তবে তুমি ভেবে দেখো। তারা এখানেও কিন্তু মানুষজনের সঙ্গেই থাকে। সাধুরা থাকে সাধুদেও সান্নিধ্যে। এটাও তো এক ধরনের পরিবার-তাই নয় কি?
-স্পষ্ট করে বলেন।
-তোমার কথাই ধরো। তুমি তোমার পরিবার ছেড়ে আসছো। এখানে কিন্তু তুমি একা নও-একদল মানুষের সঙ্গেই থাকছো। এখন তারাই কিন্তু তোমার পরিবার।
-বাবা আলীম, আমরা যারা নিজেদেও সাধু মনে করি তারা তো প্রাত্যাহিত কাজকর্ম সবই করতেছি। আমরা খাদ্য গ্রহণ করি, মলমূত্র ত্যাগ করি, সহবাস করি-তাহলে আমরা কিসের সংসারত্যাগী? তুমি যদি অপর সাধুর স্ত্রীর দিকে কুনজর দিলা, তাকে নিয়ে পালায়ে গেলা তাহলে তোমার মধ্যে লোভ আছে, রিপু আছে। আচ্ছা লোভী মানুষ কি কখনও সাধু হতে পারে?
-এইটা কেমন কথা! তাইলে তো মরার আগে কারো সাধু হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কি আপনি লালন সাঁইকে সাধু বলবেন না?
-তার কথা বাদ দাও। তিনি যেই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে গেছেন তাকি এখন সম্ভব, এই সময়ে? আগুনে পুড়ে যেমন সোনা খাঁটি হয় তেমনি একজন মানুষকেও একটা দীর্ঘ যন্ত্রণাময় পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। নইলে মানুষ এমনি এমনি কেন সংসার ত্যাগ করতে চাইবেন?
রাত যত গভীর হতে থাকে তাদের তর্ক বিতর্কও তত বাড়তে থাকে। এতে যোগ দেয় অন্যান্য সাধুরা। নিতাই বলে-আসলে এইভাবে কিছু হবার নয়। যদি জঙ্গলে যেতে পারতাম। একদম একা নিঃসঙ্গ থাকতে পারতাম তাহলে বরং নিজেকে সাধু বলে ভাবতে পারতাম।
-আপনি কি বুদ্ধের মতো নির্বাণ লাভের কথা বলছেন? কিন্তু দীর্ঘদিন এভাবে বোদি বৃক্ষের তলায় থাকা সত্যি অকল্পনীয়। উত্তর দেয় আলীম। তার প্রশ্নের জবাবে ফরাজ বলে-
-তুমি এখানে বোধি বৃক্ষ কোথায় পাচ্ছ হে! জঙ্গলই নাই তার আবার বোধি বৃক্ষ।
নিমাই তখন হতাশ কণ্ঠে বলেন-এই পৃথিবী একদিন ধ্বংস হইবে।
-সেটা তো সবাই জানি। এটা আবার নতুন করে বলার কি আছে?
ফরাজুদ্দীন ভাবেন-আর বেশিক্ষণ তর্ক চলতে দেয়া যাবে না। এইসব তর্ক থেকে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত। তখন সাধু পল্লীতে কয়েক দিন অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করে। ফরাজউদ্দীন তাই সুর ধরেন-‘দয়াল পার কর আমারে/ দয়াল পার কর আমারে/ আমি এক অন্ধ বেকুব দিশাহারা।’

পাঁচ
অপলা আলীমের সামনে গ্লাসটা ধরে বলে-নেন, সাবুটুকু খেয়ে নেন। এরপর ওষুধ গিলতে হবে।
অপলা খুব যত্ন করে আলীমকে বিছানা থেকে তুলে আনে। তরল সাবু মুখে দিতেই বিস্বাদে মুখ কুঁচকে আলীমের। এটা নজর এড়ায়না অপলার। সে বলে-জ্বরের মুখে সব তিতা লাগে। এজন্য খানিকটা লবন আর লেবু মিশিয়ে দিয়েছি এর সঙ্গে। জোর করে গিলে ফেলুন।
ওষুধপত্র খাওয়ানো শেষে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে আলীমের মুখটা মুছিয়ে দেয় অপলা। এরপর তাকে অস্তে আস্তে বালিশে শুইয়ে দেয়।
-আপনাকে শরৎচন্দ্রের নায়িকার মতো লাগছে।
-শরৎচন্দ্র কে?
-বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক। আপনি পড়েননি?
-আমি তো লেখাপড়া জানিনা।
-কিন্তু আপনি স্কুলে গিয়েছেন শুনেছিলাম।
-সে তো শখে শখে পাড়ার মেয়েদের সাথে কয়েকদিন গিয়েছি।
-তাহলে আপনি মাকে চিঠি লিখেছেন কীভাবে?
-দু কলম চিঠি লিতে জানলেই কি লেখাপড়া শেখা হয়ে যায়? এখন কথা বাদ দিয়ে বিশ্রাম নিন।
-একা একা শুয়ে থাকতে ভাল্লাগছে না যে!
-আমার যে এখন অনেক কাজ। আপনার জন্য শৈ মাছ দিয়ে উচ্ছে আলুর ঝোল করবো। জ¦রের মুখে খুব ভালো লাগবে খেতে। এখন চুপ করে শুয়ে থাকুন। বাবা আসলে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিব। তখন মুনের সুখে বকবক করবেন।
-আপনার বাবা মুরব্বি মানুষ তার সঙ্গে কি গল্প করবো?
-আমার বাবা তো আপনার গুরু। তার সঙ্গেই তো আপনার যত বাহাস। দু’দিন জ¦রে পড়ে সব ভুলে গেলেন?
-হুম। মাথা পুরা খালি। এখন আর কিছু মনে আসছে না।
-তাইলে তো ভালোই, আপনার নতুন জন্ম হলো। সব কিছু নতুন করে শুরু করবেন।
নিজের রসিকতায় নিজেই হাসে অপলা। আর তখনই ওপরে ডান পাশের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গেজ দন্তখানা বের হয়ে আসে। যা দেখে আলীমের ঘোর লাগে। মানুষের হাসি এত সুন্দও হয়! মেয়েটাকে দু হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। এই অদ্ভুত ইচ্ছার কারণে মনে মনে খুবই লজ্জিত হয় সাধু হওয়ার জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা আলীম। আর সেই লজ্জা ঢাকতেই কিনা সে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ে। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হয় তার। জীবনে কিছুই হওয়া হলো না তার। এখন সাধু হতে আইসা কী একটা রহস্যের জালে জড়ায়ে পড়ছে সে।

প্রথম পর্ব সমাপ্ত

মাহমুদা আকতার: লেখক ও সাংবাদিক। প্রকাশিত গ্রন্থ পাঁচটি।

ওমেন্স নিউজ/