লকডাউনের আকাশে উঠেছে পবিত্র চাঁদ

আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি   

মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুইটি; ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। সাধারণত আমরা, ঈদুল ফিতরকে রোজার ঈদ এবং ঈদুল-আজহাকে কোরবানির ঈদ বলে থাকি। আমাদের অফিস-আদালত ইংরেজি সন অনুযায়ী চললেও ধর্মীয় উৎসব চলে হিজরি সন অনুসারে। চাঁদের গতিদ্বারা নিরূপিত মাসের সমষ্টি হিজরি বর্ষপঞ্জি তাই চাঁদ দেখা বা ওঠার ওপরে ধর্মীয় উৎসবের তারিখ নির্ধারিত হয়। হিজরি বর্ষপঞ্জির দ্বাদশ মাস, জ্বিলহজ্জ; জ্বিলহজ্জ  মাসের দশ তারিখে শুরু কোরবানির ঈদ এবং পরপর তিনদিন অর্থাৎ ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত কোরবানি দেওয়া হয়। ঈদের নামাজ আদায় শেষে কোরবানি শুরু হয়। ঈদের নামাজ মসজিদে বা খোলা মাঠে পড়া হয়। জ্বিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে সূর্য ওঠার পর থেকে যোহরের নামাজের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কোরবানির নামাজ আদায় করা যায়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ যার যার সাধ্যমত কোরবানি দিয়ে থাকেন। কোরবানির নিয়মানুযায়ী গরু বা মহিষ সাতটি নামে এবং ছোটো পশু যেমন ছাগল-খাসি-ভেড়া এক নামে কোরবানী দিতে পারেন। নিয়মমাফিক কোরবানির মাংস তিনভাগ করে নিজের জন্য একভাগ  আর দুইভাগ আত্মীয়পরিজন ও দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর মাধ্যমে প্রাপ্ত কোরান-সুন্নাহের বিধান অনুসারে কোরবানি প্রচলিত আছে। মুসলিম ধর্মালম্বীদের বিশ্বাসে কোরবানি আল্লাহ্ এর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.) এর খোদাপ্রেমের অতুলনীয় নিষ্ঠা ও ত্যাগের মহিমাময় উজ্জ্বল পূণ্যস্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে। তবে প্রথম মানব বা আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর সময় থেকেই কোরবানি-প্রথা চালু ছিল। হযরত আদম (আ.) তাঁর দুই পুত্রকে (হাবিল ও কাবিল), তাঁদের মহান আল্লাহ্ এর উদ্দেশ্যে কোরবানি দেওয়ার কথা বলেন। তাঁরা আল্লাহ্ এর উদ্দেশ্যে কোরবানি দিলে একজনের কোরবানি কবুল হয় অন্যজনের কবুল হয় না; এই নিয়ে বিবাদ বাধে এবং কোরবানি কবুল না হওয়ায় একজন ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যজনকে খুন করে। পবিত্র কোরানশরীফে বর্ণিত আছে, “হে নবী! কিতাবিগণকে আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কবিলের ঘটনা ভালো করে বর্ণনা করো। তারা যখন কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো কিন্তু অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। ক্ষিপ্ত হয়ে সে বলল, আমি তোমাকে খুন করব! অপরজন বলল, প্রভু তো শুধু আল্লাহ-সচেতনদের কোরবানিই কবুল করেন।” (সূরা মায়েদা: ২৭ নম্বর আয়াত। আল কোরআন বাংলা মর্মবাণী। শহীদ আল বোখারী মহাজতক)।   

জ্বিলহজ্জ মাসের চাঁদ উঠলেই সাজসাজ রব ওঠে। বিভিন্ন স্থানে পশু বেচা-কেনার হাট বসে। গরু-মহিষ-ছাগল-খাসি-ভেড়া হাটে নিয়ে আসে পশুর মালিক। সীমান্ত পার হয়ে আসতে থাকে পশুর পাল। রাজধানীতে বিভিন্ন শহর থেকে খামারীরা তাঁদের গরু নিয়ে আসে। এখন অবশ্য অন-লাইনেও কোরবানির পশু বিকিকিনি হচ্ছে! ঈদের নামাজ আদায় করার পরেই কোরবানি শুরু হয়। ঈদের নামাজ মসজিদে বা খোলা মাঠে আদায় করা হয়। জ্বিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে সূর্য ওঠার পর থেকে যোহরের নামাজের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নামাজ আদায় করা যায়। কোরবানির পশুকে মহান আল্লাহ তাঁর মহিমার প্রতীক করেছেন। কোরবানি দেওয়ার সময় নিয়মানুযায়ী মহান আল্লাহ্ এর নাম উচ্চারণ করার বিধান আছে। পবিত্র কোরানে বর্ণিত আছে “কোরবানির মাংস বা রক্ত আল্লাহ্-এর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহ-এর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ-সচেনতা। এই লক্ষ্যেই কোরবানির পশুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দেয়া হয়েছে। … (হে নবী!) তুমি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দাও যে, আল্লাহ্ বিশ্বাসীদের রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ কোনো বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না।” (সূরা হজ : আয়াত নম্বর ৩৭-৩৮। আল কোরআন বাংলা মর্মবাণী। শহীদ আল বোখারী মহাজতক)।   

ঈদ মানেই আনন্দ কিন্তু এই করোনাকালের  লকডাউনে ঈদের আনন্দ কতোটা পাওয়া যাবে তা বলা মুস্কিল! শহর-বন্দর-গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস। বিশ্বের প্রায় দেশেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়! দেশে প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৮ মার্চ ২০২০। তখন লকডাউন, মাস্ক পরা, সঙ্গনিরোধসহ আরও বিধিনিষেধ মানা না মানার মধ্যেই চলছিল। ২০২১ সালে ক্রমশ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১ জুলাই ২০২১ কঠোর লকডাউন জারি হয় দেশে। এবং ঐ দিনই করোনায় ১৪৩ জন অর্থাৎ সর্Ÿোচ্চ মৃত্যু হয়। ৮ মার্চ ২০২০ থেকে ১ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত মোট শনাক্ত : ৯,২১,৫৫৯, মোট মৃত্যু: ১৪,৬৪৬ এবং মোট সুস্থ : ৮,২০,৯১৩ (০২.০৭.২০২১ প্র.আ)। কঠোর লকডাউন চলছে। তবে সংক্রমণ থেমে নেই, থেমে নেই মৃত্যু।

সংক্রমণ যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মৃত্যু এবং বেড়েই চলেছে। বর্তমানে করোনায় মৃত্যুতে শীর্ষ দশে অবস্থান করছে বাংলাদেশ (১২.০৭.২০২১ প্র.আ.)। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ রোধ করতেই দেশজুড়ে চলছে কঠোর লকডাউন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো যখনই লকডাউন শুরু হয় তখনই ঢাকা থেকে ঢাকা বসবাসকারী ছুটে চলে গ্রামে আবার যখনই লকডাউন তুলে নেয়া হয় তখনই ফিরে আসে ঢাকায়। অনেকের মুখে মাস্ক আছে অনেকের মুখে নেই! মানুষকে বাইরে বের হতে হয়! কেউ অসুস্থ স্বজনকে নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে, কেউ বা আনতে যাচ্ছে রোগীর জন্য অক্সিজেন-ওষুধ। প্রয়োজনে বাজার করা, ত্রাণের জন্য লাইন, কমমূল্যে টিসিবি-পণ্য নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে কারণ মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্ন ও চিকিৎসার বিষয়টি কিছুতেই একপাশে ঠেলে রাখা যায় না। করোনার কারণে অনেকের চাকরি হারিয়েছেন, দিন-মুজুরির কাজ চলে গেছে। অর্থনৈতিক কারণসহ নানা কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি। পারিবরিক অশান্তিতে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে কেউ কেউ। নারীদের ওপর বেড়েছে অত্যাচার, বেড়েছে বাল্যবিবাহ! এই অবরুদ্ধ সময়ে মানুষ পারিবারিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীকভাবে নানারকম অসঙ্গতির সম্মুখীন হচ্ছে।

করোনাতে মৃত্যু ঘটছে; কিন্তু শুধু করোনাতেই নয় আছে দুর্ঘটনায় মৃত্যু। ব্রীজ ভেঙে পড়া, জলে ডুবে, পুকুরে বা নদীতে ফেলে, এবরোখেবরো রাস্তাতে গাড়ি দুর্ঘটনা তো আছেই কিন্তু এই তো কয়েকদিন আগেই ধসে পড়ছে মগবাজারের দালানবাড়ি; আহত হয়েছে পঞ্চাশের অধিক, স্পটে মারা গেছে ৮ জন; পরে আরও কয়েকজন। রূপগঞ্জের একটি কারখানায় আগুন লেগে আহত-নিহত হয়েছে অসহায় বিপন্ন মানুষ। মৃত্যুর মিছিল যেন থামতেই চাইছে না। পুরানো ঘা-এর সঙ্গে নিত্য যোগ হচ্ছে নতুন ঘা, নতুন ব্যথা। সাভারে রানা প্লাজা ধসের কথা, নিমতলী, চুড়িহাট্টার আগুনে আহত-নিহত স্বজনদের আহাজারীতে এখনও বাতাস ভারী হয়ে আছে। আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে যারা তাঁদের বুকেও জমে আছে কষ্ট এবং হতাশা।

যে কোন উৎসবেই আনন্দ করে শিশুরাই বেশি। শিশুরাই নতুন কাপড়ের জন্য বায়না করে, নতুন কাপড় পেলে আনন্দহাসিতে উদ্ভাসিত হয়; আবার নতুন কাপড় না পেলে কষ্টও পায়। কিন্তু এই ঈদের সময়ে করোনায় বা দুর্ঘটনার কারণে যে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চলে গেছে কিংবা চাকরি হারিয়েছে, সেই পরিবারের শিশুরা কী করবে? তারা কোথায় কার কাছে যাবে আর যাবেই বা কয়দিন? এই করোনাসময়ে অনেক পরিবারে উপার্জন করার মতো কেউ না থাকায় শিশুকেই নামতে হয়েছে উপার্জনে। শিশুশ্রম- আইন থাকার পরেও শিশুরা বাধ্য হচ্ছে কাজ করতে এবং কম মুজুরিতে শিশুকর্মী পাওয়া যায় বলেই অনেকেই শিশুশ্রমিক রাখছে! এইভাবে বাড়ছে আমাদের শিশুশ্রম। বিষেজ্ঞদের মতে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করলে এবং ভারী কাজ করলে মানসিক বিকৃতি ঘটতে পারে, হতে পারে পঙ্গু। করোনা সময়ে ঈদ আসছে; পশুর হাটে উঠবে পশু; সামর্থ আছে যাদের তাঁরা পশু কিনবে এবং কোরবানিও হবে। আমরা, দেশের মানুষ যে যাই করি না কেন আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের দেশের ভবিষ্যতের কথা।   

কঠোর লকডাউনের আকাশে উঠেছে ঈদুল-আজহার চাঁদ। সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হাহাকারের মাঝে এসেছে এবারের ঈদুল-আজহা। সংযম ও ত্যাগের মহান আদর্শের কথা মনে করিয়ে দেয় কোরবানি; কোরবানি শব্দের অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ এবং নৈকট্য লাভ। মহান সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রেখে তাঁর দরবারে নিজেকে নিবেদন করে কোরবানি দিলে তাঁর নৈকট্য লাভ করা যাবে এবং কোরবানির মাংস বিলিবন্টনের মাধ্যমে প্রতিবেশী-স্বজন-পরিচিত মানুষের সঙ্গে আত্মিক-সম্পর্ক দৃঢ় হবে। ইসলামের আদর্শ হলো সকল মানুষকে মমত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করা! দানখয়রাতের মাধ্যমে মানুষে-মানুষের সম্পর্কের উন্নতি সাধিত হয় ও বৃদ্ধি পায় আন্তরিকতা। এই দুর্যোগের মুহূর্তে কোরবানির আদর্শ মনে রেখে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে একে অপরের সহায় হবে। দানধর্মে যাঁরা অন্যের সহায় হন আল্লাহ্ তাঁদের সহায় হন।

আফরোজা অদিতি: কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫৫টি। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার যার মধ্যে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, কবি কামিনী রায় সাহিত্য পুরস্কার, কবি জীবনানন্দ দাশ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ নারী লেখক সোসাইটির পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।

ওমেন্স নিউজ/